চট্টগ্রাম বন্দর কি কূটনৈতিক সম্পর্কের নতুন ট্রাম্প কার্ড

সাইফ বাপ্পী

পণ্য বাণিজ্যে চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার নিয়ে আগ্রহ রয়েছে ভারতের। সায় রয়েছে বাংলাদেশেরও। নিয়ে দুই দেশের মধ্যে চুক্তিও রয়েছে। যদিও বাস্তবায়ন পর্যায়ে তা এখন পর্যন্ত খুব বেশিদূর এগোয়নি। আবার বন্দরটির উন্নয়ন কার্যক্রমে বিনিয়োগ রয়েছে চীনেরও। বাংলাদেশ চীনের মধ্যকার সম্পর্ক উন্নয়নে চট্টগ্রাম বন্দরের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে বলে অভিমত অনেক বিশ্লেষকেরই। চীন ভারতের মধ্যে সম্পর্কের ভারসাম্য রক্ষায় বন্দরটি বাংলাদেশের জন্য ট্রাম্প কার্ড হয়ে উঠতে পারে বলে মনে করছেন পর্যবেক্ষকরা।

ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর তার সাম্প্রতিক সফর চলাকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করেছেন। সময় জয়শঙ্করের মাধ্যমে ভারতকে চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহারের আমন্ত্রণ জানান প্রধানমন্ত্রী। ওই সময় দুই দেশের মধ্যে আন্তঃসীমান্ত যোগাযোগ কানেক্টিভিটি জোরদার করা নিয়েও আলোচনা হয়। ত্রিপুরা-আসামসহ ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় ভূমিবেষ্টিত রাজ্যগুলোর উন্নয়নে চট্টগ্রাম বন্দরের সম্ভাব্য ভূমিকা নিয়ে পর্যবেক্ষক মহলেও আলোচনা হয়েছে অনেক।

এর আগে ২০১৯ সালে অনেকটা একই রকমের আরেক প্রস্তাবে চীনের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় প্রদেশগুলোকে চট্টগ্রাম মোংলা বন্দর ব্যবহারের আমন্ত্রণ জানিয়েছিল বাংলাদেশ। ওই সময়ের পর থেকে বাংলাদেশ বেইজিংয়ের সম্পর্ক আরো শক্তিশালী হয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দর এশীয় দুই পরাশক্তির সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের ভারসাম্য রক্ষায় বড় ভূমিকা রাখতে যাচ্ছে বলে মনে করছেন আন্তর্জাতিক ভূরাজনীতির পর্যবেক্ষকরা।

ভারতীয় থিংকট্যাংক প্রতিষ্ঠান ওআরএফ ফাউন্ডেশনের এক সাম্প্রতিক পর্যবেক্ষণে বলা হয়, ভারত চীন দুই দেশই চট্টগ্রাম বন্দর নিয়ে আগ্রহী। দুই দেশের সঙ্গেই ইতিবাচক লাভজনক সম্পর্ক বজায় রাখার মাধ্যমে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনের জন্য বাংলাদেশের ট্রাম্প কার্ড হয়ে উঠতে পারে বন্দরটি।

সমুদ্রকেন্দ্রিক আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের জন্য ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলো দীর্ঘদিন ধরেই কলকাতা বন্দরের ওপর নির্ভরশীল। এজন্য রাজ্যগুলো থেকে কলকাতা বন্দর পর্যন্ত পণ্য পরিবহন করতে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হয়। দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে গিয়ে রাজ্যগুলোর পণ্য বাণিজ্য হয়ে উঠেছে অনেকটাই সময় ব্যয়সাপেক্ষ। সমস্যার সবচেয়ে ভালো সমাধান হিসেবে দেখা হচ্ছে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বন্দরকে।

আঞ্চলিক ভূরাজনীতিতেও ভারতের কাছে সমান গুরুত্ববহ চট্টগ্রাম বন্দর। দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতিতে মুহূর্তে বড় প্রভাবক হয়ে উঠেছে আঞ্চলিক উপ-আঞ্চলিক কানেক্টিভিটি। বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (বিআরআই) আওতায় বঙ্গোপসাগরকেন্দ্রিক কানেক্টিভিটিতে প্রচুর বিনিয়োগ করছে চীন। এর জবাবে অ্যাক্ট ইস্ট (পূর্বদিকে সক্রিয়তা বাড়ানো) নীতিমালার আওতায় ২০১৪ সাল থেকেই নিজ সীমান্তের পূর্বদিকে সক্রিয়তা বাড়াচ্ছে ভারত। দুর্গম পাহাড়ি এলাকা নিয়ে গঠিত অঞ্চলটি এখন দেশটির আঞ্চলিক ও উপ-আঞ্চলিক কানেক্টিভিটি-সংক্রান্ত পরিকল্পনার কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে এসেছে। যদিও এক্ষেত্রে বড় সমস্যা দেশটির উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর কোনোটির সঙ্গেই সমুদ্রের কোনো সংযোগ নেই।

উপরন্তু ভারত মহাসাগরে ভূরাজনৈতিক প্রভাব নিয়ে প্রতিযোগিতা চলছে বেইজিং নয়াদিল্লির। এ প্রতিযোগিতা বঙ্গোপসাগরকে ভারতের মনোযোগের কেন্দ্রে নিয়ে এসেছে আঞ্চলিক জোট সার্কের পরিবর্তে বঙ্গোপসাগরভিত্তিক বিমসটেকেই (বে অব বেঙ্গল ইনিশিয়েটিভ ফর মাল্টিসেক্টরাল টেকনিকাল অ্যান্ড ইকোনমিক কোঅপারেশন) বেশি সক্রিয় ভারত। দক্ষিণ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যকার গেটওয়ে হিসেবে মুহূর্তে বিমসটেক অঞ্চলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্রবন্দরগুলোর একটি চট্টগ্রাম বন্দর।

বাংলাদেশ ভারতের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক আরো শক্তিশালী করে তোলার ক্ষেত্রে বন্দরটি বড় ধরনের ভূমিকা রাখতে যাচ্ছে বলে মনে করছেন কলকাতায় ওআরএফ ফাউন্ডেশনের স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ প্রোগ্রামের জুনিয়র ফেলো সোহিনী বোস। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, চট্টগ্রাম বন্দর ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর কাছাকাছি অবস্থিত। যথাযথা বহুমাত্রিক যোগাযোগ ব্যবস্থার মাধ্যমে সংযোগ গড়ে তোলা গেলে রাজ্যগুলোর জন্য সমুদ্রের প্রবেশপথ হতে পারে বন্দরটি। এতে ভারতের জন্য দেশটির উত্তর-পূর্বাঞ্চলের উন্নয়ন কার্যক্রম আরো সহজ হয়ে উঠবে। একই সঙ্গে তা চট্টগ্রাম বন্দরের ট্রাফিক বাড়াবে। প্রতিবেশী দুই দেশের মধ্যে কানেক্টিভিটিরও উন্নয়ন হবে। আরো বৃহৎ পরিসরে বলতে গেলে, তা দুই দেশের মধ্যে ক্রমবর্ধমান সম্পর্ককে আরো শক্তিশালী করে তোলার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখবে। 

২০১৫ সালে বাংলাদেশ ভারতের মধ্যে কোস্টাল শিপিং এগ্রিমেন্ট সই হয়। এর আওতায় চট্টগ্রাম মোংলা বন্দরের মাধ্যমে ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় বন্দরগুলোর সঙ্গে উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর যোগাযোগ তৈরির সুযোগ তৈরি হয়। ২০১৮ সালের অক্টোবরে বাংলাদেশ ভারতের মধ্যে এগ্রিমেন্ট অন দি ইউজ অব চট্টগ্রাম অ্যান্ড মোংলা পোর্ট ফর মুভমেন্ট অব গুডস অ্যান্ড ফ্রম ইন্ডিয়া চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তি অনুযায়ী, বাংলাদেশের মোংলা চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোয় মালামাল পরিবহনের সুযোগ পাবে ভারত। এজন্য দেশটিকে বন্দর পরিবহন ব্যবহারের খরচ বহন করতে হবে।

এর আওতায় ২০২০ সালের জুলাইয়ে ট্রানজিট পণ্যবাহী কনটেইনার নিয়ে একটি জাহাজ কলকাতা বন্দর থেকে যাত্রা করে চট্টগ্রাম বন্দরে এসে পৌঁছয়। আখাউড়া স্থলবন্দর দিয়ে প্রথমবারের মতো চট্টগ্রাম বন্দরের সঙ্গে সংযুক্ত হয় ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য। এসব পণ্য আনা হয়েছিল পরীক্ষামূলকভাবে। এর পর থেকে গত বছরের মার্চে ফেনী নদীতে ত্রিপুরা চট্টগ্রামের মধ্যে সংযোগ স্থাপনকারী মৈত্রী সেতুর উদ্বোধন হওয়া ছাড়া কার্যক্রমের আর কোনো উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি দেখা যায়নি।

বিষয়ে চট্টগ্রাম বন্দরের পরিচালক (ট্রাফিক) এনামুল করিম বণিক বার্তাকে বলেন, পণ্য বাণিজ্যে চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহারের জন্য ভারতের নতুন কিছু করার দরকার নেই। স্বাক্ষরিত চুক্তির আওতায় তারা চাইলেই সুবিধামতো সময়ে চট্টগ্রাম মোংলা বন্দর ব্যবহার করতে পারে।

সাতচল্লিশের দেশভাগের পরও ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর বাংলাদেশী বন্দর ব্যবহারের সুযোগ ছিল। ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পর সে সুযোগ বন্ধ হয়ে যায়। এর পর থেকেই চট্টগ্রাম বন্দরের প্রবেশাধিকার পাওয়ার চেষ্টা চালিয়েছে ভারত। দেশটির উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর সবচেয়ে কাছাকাছি বন্দর কলকাতায়। উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলো থেকে সেখানে পণ্য পরিবহনের একমাত্র উপায় ছিল শিলিগুড়ি করিডোর, যা চিকেন নেক নামেও পরিচিত। দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে গিয়ে উত্তরপূর্বাঞ্চলীয় ভারতীয় রাজ্যগুলোর পণ্য পরিবহনের সময় খরচ হতো অনেক বেশি। বিষয়টি অঞ্চলটির সার্বিক উন্নয়নেও বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। তবে বাংলাদেশ ভারতের মধ্যকার ট্রানজিট-ট্রান্সশিপমেন্ট চুক্তিগুলোর পর সমস্যার অনেকটাই সমাধান হয়েছে।

ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুরের ইনস্টিটিউট অব সাউথ এশিয়ান স্টাডিজের ননরেসিডেন্ট সিনিয়র ফেলো এবং নয়াদিল্লিভিত্তিক থিংকট্যাংক প্রতিষ্ঠান বিবেকানন্দ ইন্টারন্যাশনাল ফাউন্ডেশনের নেবারহুড স্টাডিজ সেন্টারের প্রধান . শ্রীরাধা দত্ত মনে করছেন, চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহারের সুযোগ বাংলাদেশ ভারত উভয় পক্ষকেই লাভবান করবে। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, শুধু আন্তর্জাতিক বাণিজ্য নয়, ভারতের অন্যান্য অংশের সঙ্গে উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর সংযোগের উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারে চট্টগ্রাম বন্দর। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বাংলাদেশ থেকেও উত্তর-পূর্ব ভারতে বিনিয়োগ আসছে। উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলো চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহারের সুযোগ পেলে দুই দেশেই পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে কৃষিপণ্যের ভ্যালু চেইন গড়ে তোলা সম্ভব হবে। রিজিওনাল ভ্যালু চেইন বলতে যা বোঝায়, দক্ষিণ এশিয়ায় তা এখনো সেভাবে গড়ে ওঠেনি। চট্টগ্রাম বন্দরকে কেন্দ্র করে অর্থনৈতিক করিডোর গড়ে উঠলে সে সুযোগ তৈরি হবে। হয়তো কিছু বছরের মধ্যেই আমরা দেখতে পারব, চট্টগ্রাম বন্দরকে ঘিরে বাণিজ্যিক কার্যক্রমে বড় ধরনের উল্লম্ফন হয়েছে। উপ-আঞ্চলিক কানেক্টিভিটির মাধ্যমে ভারত, বাংলাদেশ, নেপাল, ভুটানের বাণিজ্য সম্প্রসারণের একটি চেষ্টা অনেক দিন ধরেই চলমান রয়েছে। যদিও এখনো তা সেভাবে সম্প্রসারণ করা যায়নি। চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব।


(প্রতিবেদনটি তৈরিতে ওআরএফ ফাউন্ডেশনের স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ প্রোগ্রামের জুনিয়র ফেলো সোহিনী বোসের সাম্প্রতিক এক নিবন্ধ থেকে সহায়তা নেয়া হয়েছে।)

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন