বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানি

পাইকারিতে বাড়লে খুচরায়ও দাম বাড়ানোর প্রস্তাব

আবু তাহের

বিদ্যুতের পাইকারি মূল্যহার (বাল্ক) ৫৮ শতাংশ বাড়ানোর সুপারিশ করেছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) গঠিত কারিগরি মূল্যায়ন কমিটি। ১৮ মে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) দেয়া মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাবের ওপর গণশুনানিতে সুপারিশ করা হয়। শুনানির পর গুঞ্জন উঠেছে বিদ্যুতের পাইকারি মূল্য যদি বাড়ানো হয়, তাহলে খুচরা পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হবে। বেশ কয়েকটি বিতরণ কোম্পানির সঙ্গে কথা বলে নিশ্চিত হওয়া গিয়েছে, বিদ্যুতের পাইকারি দাম বাড়ানো হলে খুচরা পর্যায়ে মূল্যবৃদ্ধির জন্য তারা কমিশনে প্রস্তাব জমা দেবে।

ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (ডিপিডিসি) ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি লিমিটেড (ডেসকো) সূত্র জানিয়েছে, পাইকারি মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাব বিইআরসি আমলে নিলে বিতরণ কোম্পানিগুলোকে সেই মূল্যে বিপিডিবির কাছ থেকে বিদ্যুৎ কিনতে হবে। সেক্ষেত্রে বিদ্যুৎ ক্রয়ে বিতরণ কোম্পানিগুলোর খরচ আরো বেড়ে যাবে। তখন সংশ্লিষ্ট মূল্য গ্রাহক পর্যায়ে সমন্বয় করতে হবে। সেক্ষেত্রে বিতরণ কোম্পানিগুলো কমিশনে মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাব দেয়া ছাড়া বিকল্প কিছু দেখছে না।

ডেসকোর ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) প্রকৌশলী মো. কাউসার আমীর আলী বণিক বার্তাকে বলেন, বিদ্যুতের পাইকারির সঙ্গে খুচরা পর্যায়ে দামের সরাসরি সম্পৃক্ততা রয়েছে। পাইকারিতে যে হারে দাম বাড়ানো হবে, আমরা সেভাবে প্রস্তাব বিইআরসিতে জমা দেব। গণশুনানিতে বিইআরসির কারিগরি কমিটি প্রায় ৫৮ শতাংশ দাম বাড়াতে সুপারিশ করেছে। সরকার সবসময় বিদ্যুতে ভর্তুকি দেয়, তা দিলে সেটি আরো কমে আসবে।

বিইআরসি সূত্রে জানা গিয়েছে, গণশুনানিতে বিদ্যুতের পাইকারি দাম প্রতি কিলোওয়াট (ঘণ্টা) টাকা ১৭ পয়সা থেকে বাড়িয়ে টাকা ১৬ পয়সা করার সুপারিশ করেছে কারিগরি মূল্যায়ন কমিটি। সে হিসেবে বিদ্যুতের দাম কিলোওয়াটপ্রতি টাকা ৯৯ পয়সা বাড়ানোর সুপারিশ করা হয়।

মূল্যায়ন কমিটি সুপারিশে জানায়, বিদ্যুৎ উৎপাদন ট্যারিফ পদ্ধতি অনুযায়ী বিপিডিবির রেট বেজের ওপর রিটার্ন বিবেচনায় সরকারি ভর্তুকি ব্যতীত ২০২১-২২ অর্থবছরে ৬৬ হাজার ৮৩৭ কোটি টাকা প্রয়োজন। সে হিসেবে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের মূল্য পড়ে টাকা ১৬ পয়সা। তবে বিপিডিবি বর্তমানে প্রতি কিলোওয়াট বিদ্যুৎ টাকা ১৭ পয়সায় বিক্রি করছে। সেই হিসেবে কিলোওয়াটপ্রতি টাকা ৯৯ পয়সা ঘাটতি থাকছে বিপিডিবির। ফলে ভর্তুকি ব্যতীত ঘাটতি পূরণে ভারিত গড়ে বিদ্যমান পাইকারি মূল্যহার ৫৭ দশমিক ৮৩ শতাংশ বাড়ানো প্রয়োজন বলে জানায় কারিগরি কমিটি। তবে সরকার ভর্তুকির পরিমাণ বিবেচনা করলে বিদ্যুতের পাইকারি মূল্যহার আবার বিবেচনা করা যেতে পারে বলে জানায় কারিগরি কমিটি।

দেশে বিদ্যুতের একক বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান বিপিডিবি। সংস্থাটির কাছ থেকে বিদ্যুৎ কিনে ছয়টি বিতরণ কোম্পানি গ্রাহক পর্যায়ে তা বিক্রি করে। বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির জন্য এককভাবে কমিশনে প্রস্তাব দেয় বিপিডিবি। বিতরণ কোম্পানিগুলো মূল্যবৃদ্ধির জন্য কোনো প্রস্তাব জমা দেয়নি। তবে পাইকারি মূল্য বাড়লে তারাও কমিশনে মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাব জমা দেবে বলে জানায়।

ডিপিডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) প্রকৌশলী বিকাশ দেওয়ান বণিক বার্তাকে বলেন, পাইকারিতে দাম বাড়লে বিপিডিবির কাছ থেকে আমাদের বেশি দামে বিদ্যুৎ কিনতে হবে। ফলে গ্রাহক পর্যায়ে দাম বাড়াতে হবে। আমরা বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করছি। এখন সরকারের ভর্তুকির ওপর নির্ভর করছে কত শতাংশ বিদ্যুতের দাম বাড়বে।

রাজশাহী রংপুর অঞ্চলে বিদ্যুৎ বিতরণে নিয়োজিত রয়েছে নর্দান ইলেকট্রিসিটি সাপ্লাই কোম্পানি লিমিটেড (নেসকো) নেসকোর ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) জাকিউল ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, নেসকো অঞ্চলে শিল্প-কারখানা কম। আবাসিকের গ্রাহক বেশি। তাদের কথা বিবেচনা করে আমাদের এগোতে হবে। যদি বিক্রি বাবদ নেসকোর বিদ্যুৎ বিতরণ খরচ উঠে আসে, তাহলে গ্রাহকের ব্যয় বাড়বে; এমন কাজ করবে না। খুচরা পর্যায়ে মূল্যবৃদ্ধির পরিকল্পনা আপাতত নেই। তবে রাজস্ব ব্যয় বেড়ে গেলে প্রস্তাব দেয়ার বিকল্প তো কিছু নেই।

বিশ্বব্যাপী জ্বালানির মূল্য বেড়ে যাওয়ায় এর আগে গ্যাসের দাম বাড়াতে গণশুনানি করে কমিশন। পেট্রোবাংলা, সঞ্চালন কোম্পানি জিটিসিএলসহ গ্যাস বিতরণ কোম্পানিগুলো ১১৭ শতাংশ মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাব জমা দেয়। কিন্তু গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির অযৌক্তিক প্রস্তাবের বিপরীতে কারিগরি মূল্যায়ন কমিটি মাত্র ২০ শতাংশ মূল্যবৃদ্ধির সুপারিশ করে। কমিশন এখনো মূল্যবৃদ্ধির বিষয়ে কোনো ঘোষণা দেয়নি।

গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির বিষয়ে চূড়ান্ত ঘোষণা আসার আগেই বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির বিষয়টি অযৌক্তিক বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। এরই মধ্যে ব্যবসায়ীদের বিভিন্ন সংগঠন গ্যাস বিদ্যুতের মূল্য না বাড়াতে সরকারের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছে। জ্বালানি খরচ বেড়ে গেলে পণ্য উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে, যার প্রভাব পড়বে ভোক্তাদের ওপর।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ইজাজ হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, মুহূর্তে গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হলে অর্থনীতিতে বিরূপ অবস্থা তৈরি হবে। ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে ভোক্তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। বিশ্বে যে অবস্থা চলছে তা একটি পরিস্থিতি। অবস্থায় গ্যাস-বিদ্যুতের মূল্য এমনভাবে বাড়ানো যাবে না, যার কারণে ব্যবসায়ীরা অসৎ কোনো পথ বেছে নেন। পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে বিইআরসির উচিত এমন সংকটপূর্ণ সময়ে কোনো একটা পরিকল্পনা দাঁড় করানো।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন