মহামারীর ধাক্কা সামলে ওঠার আগেই নাজুক বিশ্ব অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলছে ইউক্রেন যুদ্ধ। এতে নিত্যপণ্যের দামে হঠাৎই ঊর্ধ্বগতি দেখা দিয়েছে। এ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বিপর্যস্ত সরবরাহ ব্যবস্থার ওপর সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
গতকাল রাতে জাতিসংঘ মহাসচিবের সঙ্গে প্রথমবারের মতো ‘চ্যাম্পিয়নস গ্রুপ অব গ্লোবাল ক্রাইসিস রেসপন্স ফর ফুড, এনার্জি অ্যান্ড ফাইন্যান্স’-এর বৈঠকে যোগ দিয়ে এ আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী। অনুষ্ঠানে গণভবন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হন সরকারপ্রধান। বৈঠকে আমন্ত্রণ জানানোয় জাতিসংঘ মহাসচিব এন্তোনিও গুতেরেসকে ধন্যবাদ জানান শেখ হাসিনা।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, সংকট মোকাবেলায় প্রয়োজন হলো বৈশ্বিক সরবরাহ ব্যবস্থার বিঘ্ন কাটানো। পণ্যের ক্রমবর্ধমান মূল্য নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করবে এটি। এছাড়া উন্নত অর্থনীতি ও বহুপক্ষীয় আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে; শুল্কমুক্ত-কোটামুক্ত বাজারে প্রবেশাধিকার দেয়ার পাশাপাশি আরো সহজলভ্য আর্থিক ব্যবস্থা থাকতে হবে।
তিনি বলেন, ইউক্রেন যুদ্ধ এমন একটা সময়ে এসেছে যখন পুরো বিশ্ব কভিড-১৯ মহামারী থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছে। এরই মধ্যে নাজুক হয়ে পড়া বিশ্ব অর্থনীতির ওপর এটা গুরুতর চাপ হয়ে উঠছে।
বিশ্বজুড়ে আর্থিক এ সংকট মোকাবেলায় নিজেকে গ্লোবাল সাউথের একজন প্রতিনিধি হিসেবে তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, আমি এ সংকটে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত লাখো মানুষের কণ্ঠস্বরকে এ টেবিলে পৌঁছে দিচ্ছি। স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) এবং উন্নয়নশীল ক্ষুদ্র দ্বীপরাষ্ট্রগুলোকে (এসআইডি) সবচেয়ে বেশি ক্ষতি বইতে হচ্ছে। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে তাদের জন্য সহায়তার সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থা করতে হবে।
সংকট মোকাবেলায় নিজের ভাবনা তুলে ধরে এ সময় চারটি প্রস্তাব রাখেন প্রধানমন্ত্রী। প্রথম প্রস্তাবে তিনি বলেন, আমাদের বৈশ্বিক সংহতি জোরদার এবং সুসমন্বিত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এক্ষেত্রে জি৭, জি২০, ওইসিডি এবং আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর গুরুদায়িত্ব রয়েছে। এ গ্রুপের স্টিয়ারিং কমিটিতে প্রধান সব আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো রয়েছে। সংকট মোকাবেলায় বাস্তবায়নযোগ্য সুপারিশগুলো তৈরির জন্য আমরা তাদের পূর্ণ সমর্থন দেব।
দ্বিতীয় প্রস্তাব তুলে ধরে তিনি বলেন, তাত্ক্ষণিক প্রয়োজন হলো বৈশ্বিক লজিস্টিক এবং সরবরাহ ব্যবস্থার ব্যাঘাত মোকাবেলা করা। এটা পণ্যের ক্রমবর্ধমান মূল্য নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করবে। বৈশ্বিক বাণিজ্য ও রফতানি আয় পুনরুজ্জীবিত করার লক্ষ্যে বিশেষ করে স্বল্পোন্নত দেশ এবং অন্যান্য দুর্বল দেশগুলোর জন্য আন্তর্জাতিক সমর্থনও থাকতে হবে। এছাড়া উন্নত অর্থনীতি ও বহুপক্ষীয় আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে, শুল্কমুক্ত-কোটামুক্ত বাজারে প্রবেশাধিকার ও আরো সহজলভ্য আর্থিক ব্যবস্থা থাকতে হবে। শেখ হাসিনা তার তৃতীয় প্রস্তাবে বলেন, কার্যকর খাদ্য সঞ্চয় ও বিতরণ ব্যবস্থার জন্য কৃষি খাতের জন্য প্রযুক্তি সহায়তা এবং বিনিয়োগের ওপর আরো বেশি মনোযোগ দেয়া জরুরি। তিনি জানান, নবায়যোগ্য জ্বালানি খাতে বিশেষ করে এলডিসিগুলোয় ব্যবসার ক্ষেত্রে আনকোরা অনেক সুযোগ রয়েছে।
এ বিষয়গুলো এগিয়ে নিতে বিদ্যমান উত্তর-দক্ষিণ, দক্ষিণ-দক্ষিণ এবং ত্রিপক্ষীয় সহযোগিতা বাড়ানো যেতে পারে জানিয়ে এক্ষেত্রে বেসরকারি খাতের সম্পৃক্ততার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
শেষ প্রস্তাবে ৪৮ সদস্যের ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরামের সভাপতি হিসেবে এসআইডি ও জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ নিম্নাঞ্চলীয় দেশগুলোর জন্য কাজের সুযোগ পাওয়ার কথা তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী। সেসব দেশে কৃষি-খাদ্য ব্যবস্থা গুরুতর চাপের মধ্যে রয়েছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
এ সময় জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় বাংলাদেশের উদ্যোগ তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, আমাদের জাতীয় উন্নয়ন যাত্রায় উদ্ভাবনী অনেক জলবায়ু কার্যক্রম রয়েছে। আমরা অন্যদের সুবিধার জন্য জলবায়ু পরিবর্তন, জীব-বৈচিত্র্যের ক্ষতি এবং পরিবেশগত অবক্ষয়ের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আমাদের জ্ঞান, বোঝাপড়া ও অভিজ্ঞতা তাদের জানাতে চাই।
শেখ হাসিনা বলেন, জাতি হিসেবে ভয়ংকর সব চ্যালেঞ্জের মুখেও আমাদের সহনশীলতার পরিচিতি রয়েছে। কভিড-১৯ মহামারী তার সর্বশেষ উদাহরণ। মহামারী থেকে রক্ষা পেতে বাংলাদেশের প্রচেষ্টার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, আমাদের মহামারী পুনরুদ্ধারের প্রচেষ্টা জীবন-জীবিকা রক্ষার মধ্যে একটি সতর্ক ভারসাম্য দিয়ে চিহ্নিত করা হয়েছিল। আমরা আমাদের পুনরুদ্ধার প্রচেষ্টায় সবচেয়ে দুর্বল ব্যক্তিদের সামনে রেখেছি। যারা সবচেয়ে পিছিয়ে রয়েছে, তাদের সহায়তা দিতে আমরা সামাজিক সুরক্ষার ক্ষেত্রগুলোকে বিস্তৃত করেছি।
তিনি বলেন, ভ্যাকসিন কেনার জন্য সময়মতো পদক্ষেপ নেয়ায় বড় একটি স্বাস্থ্য সংকট এড়ানো সম্ভব হয়েছে। তাতে জীবন রক্ষা পেয়েছে।
রফতানি খাত এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে (এসএমই) সহায়তা দিতে বাস্তবসম্মত উদ্যোগের কথা তুলে ধরে ২৩ বিলিয়ন ডলারের প্রণোদনা প্যাকেজ চালুর কথা জানান প্রধানমন্ত্রী। এসব পদক্ষেপের কারণে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশের বেশি অর্জন সম্ভব হয়েছে বলে জানান তিনি।
বাংলাদেশ খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে এবং জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছে জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, তবে ইউক্রেন যুদ্ধ পরিস্থিতিকে অত্যন্ত অস্থিতিশীল করে তুলেছে। সরবরাহের স্বল্পতা এবং খাদ্য, জ্বালানিসহ অন্যান্য পণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি এরই মধ্যে সাধারণ মানুষের জীবনের ওপর মারাত্মক চাপ সৃষ্টি করেছে।