বিশ্ব অর্থনীতি

উন্নত অর্থনীতির চেয়ে উন্নয়নশীল দেশগুলো কেন দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে

ড্যানি রডরিক

উন্নয়ন অর্থনীতির প্রধান একটা ধারণা হলো, উৎপাদন প্রক্রিয়ার দ্বৈতবাদ (প্রডাক্টিভ ডুয়ালিজম) নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ডব্লিউ আর্থার লুইসের মতো যারা উন্নয়ন অর্থনীতি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তারা ধারণা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে উল্লেখ করেছেন, উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারকারী ছোট আধুনিক এবং ব্যাপকতর নিম্ন উৎপাদনশীলতার বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত বড় সনাতনী’— দুই খাত নিয়ে দরিদ্র দেশগুলো বিভক্ত। উন্নত দেশগুলোর বিপরীতে ডুয়ালিজম দীর্ঘদিন ধরে উন্নয়নশীল দেশগুলোর বৈশিষ্ট্য ছিল। গতানুগতিক নয়া ধ্রুপদী অর্থনীতি থেকে এটি উন্নয়ন অর্থনীতিকে একটি স্বতন্ত্র অধ্যয়নের শাখা হিসেবে চিহ্নিত করেছিল।

এরই ধারাবাহিকতায় স্বভাবতই উন্নয়ন নীতিতে আয়, শিক্ষা, স্বাস্থ্য জীবনমান উন্নয়নে বৈষম্য নিরসনের ওপর বেশি গুরুত্ব দেয়া হতো। উন্নয়ন নীতির কাজ ছিল নতুন প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থার মাধ্যমে ডুয়ালিজমকে মোকাবেলা করা। ধারণা করা হয়েছিল, নতুন ব্যবস্থা বাজারকে বদলে দেবে এবং উৎপাদিকা সুযোগের প্রবেশাধিকার বিস্তৃত করবে।   

১৯৫০ ১৯৬০-এর দশকে বৈশিষ্ট্যের পেছনে কিছু যুক্তি থাকলেও পরবর্তী সময়ে সেটি আর প্রাসঙ্গিক থাকেনি। এর একটা কারণ হলো উন্নত উন্নয়নশীল দেশগুলো সম্পর্কে অধ্যয়নের জন্য যে পদ্ধতিগুলো ব্যবহার হতো, সেগুলো একীভূত হয়ে গিয়েছিল। আজকের দিনে উন্নয়ন অর্থনীতি আবশ্যিকভাবে রাষ্ট্রীয় অর্থব্যবস্থা, শ্রম অর্থনীতি, শিল্প অর্থনীতি কিংবা নিম্ন আয় বিন্যাসের ক্ষেত্রে সামষ্টিক অর্থনীতির মানসম্মত কাঠামোর প্রয়োগ। তবে আরো তাত্পর্যপূর্ণ মজার বিষয় হলো, উৎপাদন প্রক্রিয়ার ডুয়ালিজম এখন উন্নত অর্থনীতিগুলোরও গুরুত্বপূর্ণ দৃশ্যমান বৈশিষ্ট্যে পরিণত হয়েছে।

২০১৭ সালে প্রকাশিত দ্য ভ্যানিশিং মিডল ক্লাস গ্রন্থে এমআইটির অর্থনৈতিক ইতিহাসবিদ পিটার টেমিন উল্লেখ করেছেন, দ্বৈত অর্থনীতির লুইস মডেল অব্যাহতভাবে যুক্তরাষ্ট্রের পরিস্থিতিতেও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। বি-শিল্পায়ন, বিশ্বায়ন, পেশাজীবী পুঁজিপতিদের অনুকূল প্রযুক্তি এবং শ্রমিকের ক্রমহ্রাসমান সুরক্ষাসহ কয়েকটি ফ্যাক্টর প্রকৃতপক্ষে সফল পিছিয়ে থাকাদের মধ্যে একটি ক্রমপ্রসারমাণ ব্যবধান তৈরি করেছে। সেখানেও অর্থনীতির দরিদ্র ধনী অংশের মধ্যকার ব্যবধান চিহ্নিত হয়েছে, শিক্ষাগত অর্জন অব্যাহতভাবে শ্রমবাজারকে প্রভাবিত করেছে এবং আঞ্চলিক বৈষম্য বিস্তৃত হয়েছে।

ইউরোপে শক্তিশালী কল্যাণরাষ্ট্রের কারণে বৈষম্য সেভাবে দেখা যায়নি, কিন্তু বর্তমানে দেশগুলোতেও নেতিবাচক বিষয়গুলো দৃষ্টিগোচর হচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে ইউরোপেও প্রতিষ্ঠান অঞ্চলের মধ্যকার এগিয়ে থাকা পিছিয়ে থাকাদের ব্যবধান বেড়েছে এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণী অনেকটা সংকুচিত হয়েছে।

ফলে দীর্ঘদিন ধরে উন্নয়নশীল অর্থনীতির নীতিনির্ধারকরা যেসব প্রশ্ন নিয়ে ভাবিত ছিলেন, উন্নত অর্থনীতির নীতিনির্ধারকরাও এখন সেই একই প্রশ্নের মুখোমুখি হচ্ছেন। আর তা হলো, কীভাবে বিনিয়োগ আকর্ষণ, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, দক্ষতা বৃদ্ধি, উদ্যোগের প্রসার এবং ঋণ প্রযুক্তিতে প্রবেশাধিকার বাড়ানো যায়। সংক্ষেপে বলতে গেলে কীভাবে জাতীয় অর্থনীতির অধিক প্রাগ্রসর উৎপাদনক্ষম অংশের সঙ্গে অন্য অংশের ব্যবধান কমানো যায়।

প্রারম্ভিক কারণের ভিন্নতা হতে পারে, তবে একজন উন্নয়ন অর্থনীতিবিদের কাছে কর্মসংস্থানে পিছিয়ে থাকা যেকোনো অঞ্চলের সমস্যাগুলো অতিচেনা। আর তা হলো, উৎপাদনশীল কর্মসংস্থানের ঘাটতি, অপরাধ মাদক গ্রহণের মতো সামাজিক সমস্যার বিস্তার এবং বিভিন্ন সামাজিক ব্যবসায়িক গোষ্ঠীর মধ্যে সরকারের প্রতি আস্থাহীনতা। ধরনের একটা কাঠামোগত বিন্যাসে বর্ণগত বা জাতিগত সংখ্যালঘু, সাম্প্রতিক অভিবাসী কিংবা স্বল্পশিক্ষিত কর্মীরা যেসব প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হচ্ছে সেগুলো উত্তরণ করাই হলো উন্নয়ন অর্থনীতির মূল বিষয়।

সত্যি বলতে কি, উন্নত অর্থনীতিতে পিছিয়ে পড়া এলাকাগুলোয় বিপুল আর্থিক সম্পদের অভিগম্যতা থাকতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রে বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যের সরকার স্থানীয় সরকারগুলো বড় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানকে আকর্ষণ করতে অদক্ষভাবে কর প্রণোদনা অন্য ভর্তুকিতে বিপুল অর্থ খরচ করে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে কাঠামোগত আমলাতান্ত্রিক প্রতিবন্ধকতার মধ্যে করপোরেটদের কাজ করতে হয়, যা দরিদ্র দেশে কাজ করা তাদের প্রতিযোগীদের কাছেও বেশ পরিচিত একটা প্রপঞ্চ। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের একজন অভিজ্ঞ প্র্যাকটিশনার যেমনটা বলেছেন, আমরা সবকিছুর কেন্দ্রে বটে, তবে কোনো কিছুর ওপর আমাদের নিয়ন্ত্রণ নেই।

উল্লেখ করা দরকার, বিদ্যমান সমাধানগুলোর ক্ষেত্রে তারাও একই ধরনের সীমাবদ্ধতার মুখোমুখি। ডুয়ালিজম অতিক্রমণে শিল্পায়নই গতানুগতিক হাতিয়ার হিসেবে এখনো থেকে গেছে। শ্রমিকরা উৎপাদনশীল খাতে যত বেশি নিয়োজিত হবেন তত বেশি মজুরি বাড়বে এবং অর্থনীতির সার্বিক উৎপাদনশীলতাও বাড়বে। কিন্তু উন্নয়নশীল উন্নত অর্থনীতিতে বিপুল কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে উৎপাদনশীল খাত তার সক্ষমতা হারিয়েছে স্বয়ংক্রিয়তা শ্রমসাশ্রয়ী প্রযুুক্তি উদ্ভাবনের কারণে। এমনকি দক্ষিণ কোরিয়া বা জার্মানির মতো শক্তিশালী শিল্প খাত থাকা দেশগুলোয়ও উৎপাদন খাতের কর্মসংস্থান সংকুচিত (মোট কর্মসংস্থানের অংশ হিসেবে) হয়েছে।

কাজেই উচ্চ নিম্ন আয় উভয় ধরনের দেশগুলোয় ভবিষ্যতে অর্থনৈতিক উন্নয়নে আরো বেশি সেবা এবং ক্ষুদ্র মাঝারি উদ্যোগের (এসএমই) ওপর নির্ভর করবে। ফলে শ্রমবাজারের সরবরাহ চাহিদার দিক লক্ষ করে উভয় ধরনের অর্থনীতিরই সমন্বিত নীতি গ্রহণ করা প্রয়োজন। একই সঙ্গে প্রতিষ্ঠানগুলোকে সমর্থন জোগাতে দরকার দক্ষতা বৃদ্ধিমূলক প্রশিক্ষণ। ভালো চাকরির জন্য যেমন প্রয়োজন ভালো প্রতিষ্ঠান, তেমনি ভালো প্রতিষ্ঠানের জন্য প্রয়োজন ভালো কর্মী। বিষয়টি পরিপূরক।

সম্পদসহ এসব উৎপাদনবাদী নিরীক্ষা এবং সহায়ক সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতির সমর্থন জোগাতে প্রয়োজন হবে জাতীয় নীতি কাঠামো। সুনির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে বর্তমানে পুঁজি ব্যাপকভাবে শিক্ষিত পেশাজীবীদের প্রতি অনুকূল প্রযুক্তিগত পরিবর্তনে উৎসাহিত করা। এক্ষেত্রে জাতীয় উদ্ভাবন নীতিগুলো পুনর্বিবেচনা করতে হবে। উদ্ভাবনের গতিমুখে নতুন করে দৃষ্টি দিতে হবে। একই সঙ্গে শ্রম বাজার সম্পর্কিত চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় বিদ্যমান শ্রমশক্তির দক্ষতা প্রতিস্থাপনের পরিবর্তে দক্ষতা বাড়ায় এমন প্রযুক্তি প্রসারিত করতে হবে। ধনী দরিদ্র উভয় দেশই এসব চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি।

যখন অর্থনীতিবিদরা বৈশ্বিক অভিমুখিতা নিয়ে কথা বলেন তখন তারা সাধারণত বিষয়টি মাথায় রাখেন যে উন্নত অর্থনীতির তুলনায় উন্নয়নশীল দেশগুলো দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হলো, বর্তমানে আমরা ঊর্ধ্বমুখী অভিমুখিতার চেয়ে নিম্নমুখী অভিমুখিতার অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হচ্ছি। উন্নত দেশের সমস্যাগুলো দরিদ্র দেশে প্রাপ্ত সমস্যাগুলোর মতো মনে হচ্ছে। উন্নয়নশীল দেশগুলোর অর্থনীতি অধ্যয়নে ব্যবহূত মডেল কাঠামোগুলো ধারাবাহিকভাবে ধনী দেশগুলোর মুখোমুখি হওয়া সমস্যাগুলোর ক্ষেত্রেও প্রাসঙ্গিক বলে প্রমাণ হচ্ছে।

[স্বত্ব:
প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
]

 

ড্যানি রডরিক: হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের জন এফ কেনেডি স্কুল অব গভর্নমেন্টের আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক অর্থনীতির অধ্যাপক

ভাষান্তর: হুমায়ুন কবির  

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন