দেশে আমদানীকৃত কোনো পণ্যের দাম বাড়লে সহসাই সেটি কমে না। সাম্প্রতিক সময়ে ভোজ্যতেলের ক্ষেত্রে এটি আবার প্রমাণিত হলো। গতকাল বণিক বার্তায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্ববাজারে ভোজ্যতেলের মূল্যহ্রাস পাওয়ার ১২ দিন অতিবাহিত হলেও দেশে দাম সমন্বয়ের কোনো উদ্যোগ নেই। দাম বাড়াতে ব্যবসায়ীরা যতটা উচ্চকিত হন দাম কমাতে ঠিক ততটাই নিষ্প্রভ থাকেন বলে অভিযোগ রয়েছে। সন্দেহ নেই অতিরিক্ত মুনাফা লাভের প্রবণতা থেকে ব্যবসায়ীরা এমনটি করেন। কিন্তু হতাশার বিষয় হলো, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় তথা সরকারের আচরণও একই। ভোজ্যতেলের দাম বাড়ানোর সময় ব্যবসায়ীদের প্রস্তাব বিবেচনায় নিতে কোনো সময়ক্ষেপণ না করা হলে এখন কেন করা হচ্ছে, তার কোনো সদুত্তর বাণিজ্য মন্ত্রণালয় দিতে পারছে না। ব্যবসায়ী নেতারাই প্রস্তাব দিয়েছিলেন ১৫ দিন পর ভোজ্যতেলের দাম সমন্বয়ের। তাহলে এখন কেন সে উদ্যোগ না নিয়ে নানা অজুহাত দাঁড় করানো হচ্ছে—হ্রাসকৃত মূল্যে তারা এখনো কোনো ভোজ্যতেল আনেননি। দাম বাড়ানোর সময় তো এমন কথা শোনা যায়নি। এক্ষেত্রে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উদাসীনতা মোটেই কাম্য নয়। টনপ্রতি ভোজ্যতেলের দাম ১০০ ডলারের বেশি কমেছে বলে খবর মিলছে। প্রত্যাশা থাকবে, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ই দাম সমন্বয়ে দ্রুত উদ্যোগ নেবে। এক্ষেত্রে কোনোভাবেই সময়ক্ষেপণ করা যৌক্তিক নয়।
আন্তর্জাতিক বাজারে ভোজ্যতেলের দাম নিয়মিত ওঠানামা করে। আন্তর্জাতিক বাজারদর অনুযায়ী, আমদানিকারক দেশগুলো নিজস্ব বাজারে তেলের সরবরাহ মূল্য নির্ধারণ করে থাকে। খুচরা পর্যায়ে তেলের দাম নির্ধারণে সারা বিশ্বের অভিজ্ঞতায় প্রধানত তিনটি পদ্ধতি লক্ষ করা যায়। এক. বাজার নির্ধারিত; দুই. একদর পদ্ধতি; তিন. সর্বোচ্চ মূল্য বেঁধে দেয়া। তেলের দাম নির্ধারণে প্রচলিত তিনটি পদ্ধতির মধ্যে অধিকাংশ দেশ মার্কেট ডিটারমাইন্ড অর্থাৎ বাজারদরের সঙ্গে নিয়মিত সমন্বয় পদ্ধতি মেনে চলে। এছাড়া কিছু দেশে আছে প্রাইস সিলিং বা সর্বোচ্চ মূল্য বেঁধে দেয়ার পদ্ধতি এবং সবচেয়ে কঠোর পদ্ধতি হলো ফিক্সড প্রাইস বা একদর পদ্ধতি। ফিক্সড প্রাইস সরকার নির্ধারিত থাকে। আর সিলিং হলো মার্কেট প্রাইসের সঙ্গেই থাকে তবে একটা সর্বোচ্চ মূল্যের উপরে উঠতে পারে না। সেই সময়টায় হয়তো সরকার ভর্তুকি দেয়। আর মার্কেট প্রাইসের সঙ্গে সম্পর্কিত যেটা তাদের সমন্বয়ের কোনো নির্দিষ্ট সীমা নেই। যতবার খুশি তারা দাম সমন্বয় করতে পারে। ঘন ঘন করতে পারে, দুই মাস ধরে নাও করতে পারে। এটা আন্তর্জাতিক বাজারদরের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত। বাংলাদেশ সরকার কোনটি অনুসরণ করে তা বোঝা ও বলা মুশকিল। কারণ সরকার দাম নির্ধারণ করে দিলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে বাজারে সে দামে পণ্য মেলে না। এটি যেমন ভোজ্যতেলের ক্ষেত্রে সত্য, তেমনি এলএনজির ক্ষেত্রে সত্য। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, সরকার দাম বাড়ানোর ঘোষণা না দিলেও বাজারে এর দাম বেড়ে যায়। পরবর্তী সময়ে সরকার সেটির বৈধতাই দেয়। ভোজ্যতেলের বাজারের ক্ষেত্রে এবারো একই প্রবণতা দেখা গেল। ব্যবসায়ীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে দ্রুততম সময়ের মধ্যে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ভোজ্যতেলের দাম সমন্বয় করেছে। কিন্তু পরক্ষণে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমে এলেও স্থানীয় বাজারে মূল্য পুনর্নির্ধারণে সরকার বা ব্যবসায়ী কারো তরফ থেকে উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এক্ষেত্রে যথাযথ ভূমিকা রাখতে সমর্থ হয়নি। এতে ব্যবসায়ীদের মধ্যে অতিরিক্ত মুনাফা লাভের সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে আর ভোক্তা বাধ্য হচ্ছে বেশি দামে ভোজ্যতেল কিনতে, যা মধ্যম আয়ের দেশের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়।
বাংলাদেশের নিকট প্রতিবেশী ভারতে তেলের দাম প্রতিনিয়ত পরিবর্তন হয় বাজারমূল্যের সঙ্গে সমন্বয় করে। কিন্তু দাম অতিরিক্ত বেড়ে গেলে রাজ্যভেদে ভর্তুকিও প্রদান করা হয়। জ্বালানি তেলের ক্ষেত্রে ভারতে ডায়নামিক ডেইলি প্রাইসিং মেথড নামের একটি পদ্ধতি ২০১৭ সালে চালু হয়। বাজারদর অনুযায়ী এ পদ্ধতিতে প্রতিদিনই দাম সমন্বয়ের সুযোগ আছে। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে আফগানিস্তানেও বাজারমূল্যের সঙ্গে তেলের দাম নিয়মিত সমন্বয় করা হয়। বাংলাদেশে তেলের দাম নির্ধারণ হয় সরকারের নির্বাহী আদেশে ফিক্সড প্রাইস মেথডে। তেলের মূল্য কাঠামোটি প্রতিযোগিতামূলক হওয়া দরকার। অর্থাৎ বৈশ্বিক বাজারে মূল্যের যে ওঠানামা তার সঙ্গে মিলিয়ে একটি নির্দিষ্ট পার্থক্য রেখে অভ্যন্তরীণ পর্যায়ে সমন্বয় করা। যেটি কিনা ভারতে হয়ে থাকে। এমন একটি কাঠামো বাংলাদেশও বিবেচনা করতে পারে।
ভোজ্যতেলের প্রায় ৮৮ ভাগ আমদানি করছে চারটি প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ‘সিন্ডিকেট’ করে দাম বাড়ানোর অভিযোগ নতুন নয়। এক্ষেত্রে আরো বেশিসংখ্যক প্রতিষ্ঠানকে আমদানির সুযোগ দেয়া হলে পরিস্থিতি এমন অস্বাভাবিক পর্যায়ে গিয়ে ঠেকত না। বিলম্বে হলেও সরকারের দ্রুত এখন তা-ই করা জরুরি। এতে একদিকে যেমন প্রতিযোগিতা বাড়বে, অন্যদিকে ইচ্ছামতো দাম বাড়ানোর সুযোগ থাকবে না। সময়মতো চাহিদা অনুযায়ী পদক্ষেপ না নেয়ার কারণে ভোক্তার ওপর যে অস্বাভাবিক চাপ সৃষ্টি হয়েছে, এর সুরাহা সরকারকেই করতে হবে। আমাদের অভিজ্ঞতায় আছে, অতীতে পেঁয়াজ নিয়ে কীভাবে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করা হয়েছিল। বাজারের স্বাভাবিক ধর্ম, সরবরাহ নির্বিঘ্ন রাখলে দাম কমবে। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমে এলেও দেশের বাজারে তা সমন্বয়ের দ্রুত উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন।
অত্যাবশ্যকীয় ভোগ্যপণ্য নিয়ন্ত্রণ ও মূল্যনির্ধারণের শর্ত হিসেবে ব্যবসায়ী কিংবা সরকার চাইলে এসব পণ্যের দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাজার পর্যালোচনা করে দাম পুনর্নির্ধারণ করতে পারে। এক্ষেত্রে সাধারণত যেকোনো একটি পক্ষ নিজ নিজ স্বার্থ বিবেচনা করে প্রথম উদ্যোগ নেয়। আর ব্যবসায়ীরা সাধারণত মুনাফার চিন্তা থেকে দাম কমানোর প্রস্তাব দেন না। ফলে সরকার তথা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কেই দাম কমানোর উদ্যোগটি নিতে হবে। দাম বাড়ানোর ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক বাজারের অজুহাত দিলেও দাম কমানোর ক্ষেত্রে বিশ্ববাজার আর বিবেচনায় নেন না ব্যবসায়ীরা, যা মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়সহ সরকারি সংস্থাগুলোকেই এগিয়ে আসতে হবে। হতাশার বিষয় দুই সপ্তাহে বিশ্বব্যাপী দাম কমলেও এখন পর্যন্ত ভোজ্যতেলের দাম নতুন করে নির্ধারণের ক্ষেত্রে কোনো পক্ষই তত্পর হয়নি। এক্ষেত্রে সরকারের দ্রুত হস্তক্ষেপ প্রত্যাশা করছি।
আন্তর্জাতিক বাজারে ভোজ্যতেলের দাম বাড়লে সরকারের ওপর যে চাপ পড়ে, সেটা সামাল দেয়ার জন্য দাম না বাড়িয়ে সামনে কোনো পথ থাকে না। অর্থাৎ চাপটা জনগণ ভাগ করে নেয়। বাস্তবতা বিবেচনায় নিয়ে যখন জনগণকে দাম বৃদ্ধির চাপটি নিতে হয়, তখন দাম কমলে এর স্বস্তিটাও জনগণকে দেয়া উচিত। ভোজ্যতেলের দাম কমানো নিয়ে সময়ক্ষেপণ অনেক হয়েছে। ব্যবসায়ীরা যথেষ্ট মুনাফা করেছেন। দেশের মানুষের স্বার্থে আন্তর্জাতিক বাজারের অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে দ্রুত ভোজ্যতেলের দাম সমন্বয় করা হোক।