নুহাশ হুমায়ূনের ‘মশারী’ স্বল্প কিন্তু অল্প না

দীপংকর দীপন, চলচ্চিত্র পরিচালক

নুহাশ হুমায়ূন

“আচ্ছা মশারীর ইংরেজি কী? নেট? মাসকিটো নেট? দি প্রটেক্টর , তখন আমাদের প্রডিউসার বললো- ইংরেজি করতে হবে কেন? নাম মশারীই থাকুক। আমাদের খুব পছন্দ হলো ওর কথা। ছবির নাম রাখলাম, মশারী। জাস্ট মশারী।  বিদেশীদের আমরা বাংলা শেখাবো।” বলছিল নুহাশ। মশারী স্বল্প দৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের বিশেষ প্রদর্শনীতে। 

নুহাশ হুমায়ূনের স্বল্প দৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র মশারীর একটি বিশেষ প্রদর্শনীর কথা বলছি। ২০ মিনিটের ছবি মশারী। সবাই ছবি দেখলো আর আমি একজন নির্মাতাকে আর তার নির্মাণ দেখলাম। ডিসটোপিয়ান গল্প। বিষাক্ত মশার প্রাদুর্ভাব হয়েছে পৃথিবীতে। সাথে মশা মনস্টার, ভ্যাম্পায়ার। পুরো পৃথিবীর বেশির ভাগ মানুষ মরে গেছে। বার বার মাইকিং করে বলা হচ্ছে, সন্ধ্যার পরে কোন ভাবেই মশারীর বাইরে না থাকতে। শহরে অল্প কিছু মানুষ বেঁচে রয়েছে। সেই শহরের দুই বোন। তাদের নিজেদের রক্ষার গল্পই মশারী।  

প্লট অসাধারণ ভাবে চিত্রায়ন করেছে নুহাশ। এভাবে দেখানোর ক্ষমতা একটি নির্মাতাকে মাপার একটি ভাল মাপকাঠি। আমি নুহাশের মধ্যে এক দুর্দান্ত  চলচ্চিত্র  নির্মাতার বৈশিষ্ট্য দেখেছি। আমার বারবার মনে হচ্ছিল ইশশ নুহাশকে যদি একটা প্যানাভিশন ক্যামেরা আর টিম দিতে পারতাম এই ছবি শুট করার সময়! একটা ১৫ লাখ টাকা আর ১৫ কোটি টাকার ক্যামেরার পিকচার কোয়ালিটির যে পার্থক্য সেই পার্থক্য ছাড়া মশারীর সব কিছু আন্তর্জাতিক মানের। আমার কয়েকবার মনে হয়েছে ‘চিলড্রেন অব মেন’-এর মতো কিছু দেখছি। এই যা, এখন কেউ আবার বলবে- আমি বেশি প্রশংসা করে ফেলি। বাংলাদেশী সিনেমার ক্ষেত্রে আমার একটু পক্ষপাত আছে। বিষয়টি মিথ্যা নয়। তবে আজ সেরকম কিছু নয়। আজ ছবির গুনেই বলছি।  আজ একটু ব্যাখ্যা  করে বলি, একটি ছবির যে কয়েকটি মূল বিষয়ের উপর ছবির ইমপ্যাক্ট তৈরি হয়, সেগুলো বিচারে সচেষ্ট হই তার সবই ছিল এই ছবিতে।  

অসাধারণ ভিজুয়াল তৈরি করেছে নুহাশ ও তার টিম। চেনা বাংলাদেশ ভীষণ অন্য ভাবে দেখিয়েছে, সিনেমাটোগ্রাফি-আর্ট-কালার-লাইট মিলে ডিসটোপিয়ান, ভাইরাস আক্রান্ত এক শহরের ছবি দেখিয়েছে। যেটা দেখে অচেনা একটি অনুভূতি হচ্ছিল। যেটা এই ছবিটাতে ভীষণ দরকার ছিল। দুই বোনের বাড়ী যেখানে দেখিয়েছে, সেটা আরো ভালো, আবছায়া রাতের আলো, হেইজ এর ফিল সব মিলিয়ে একদম ঠিকঠাক। না একটু বেশি না একটু কম। আমার একদম ঠিক ঠাক লেগেছে। 

ডিসটোপিয়ান গল্প পৃথিবীতে অনেক হয়েছে। সেই ভিড়ে আনফানসো কুয়ারন এর ‘চিলড্রেন অন মেন’ও আছে। গল্পটাকে সেই লেভেলে নিয়ে গেছে নুহাশ। নয়ার-হরর-জম্বি-সব মিলে একটা এমন জায়গায় পৌঁছেছে ছবিটা।  কখনও লিঞ্চ, কখনো ডেল তরোর ছাপ পাচ্ছিলাম। কখনো বডি হরর বা ক্রোনেনবার্গ। সব মিলিয়ে একটি আন্তর্জাতিক মান ছুঁতে পেয়েছে সে। আমি যে বাড়িয়ে বলছি না, তার প্রমাণ মানুষ সামনে পাবে। 

সুনেরাহ জাস্ট অসাধারণ অভিনয় করেছে। কী সুন্দর ক্যারেক্টারটা ধরেছে ও; এবং শেষ পর্যন্ত চরিত্রটি  ছাড়ে নাই। এই প্লটের বিশ্বাসযোগ্যতাই বড় চ্যালেঞ্জ। সেখানে ভীষণ কনভিনসিং অভিনয় করেছে ও। ইমপ্যাক্টফুল উঁচু মানের অভিনয়। আবারও প্রমাণ হয় সুনেরাহ অসাধারণ অভিনেত্রী। শুধু তাকে ঠিকমতো ব্যবহার করার জন্য ক্যারেক্টার চাই। সুনেরার ছোট বোন চরিত্রে অনেরাও খুব অসামান্য। তাকে যেহেতু আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনি না, জানি না সে এই রকমই কিনা। তার আর কোনো কাজও দেখিনি।  অ্যাক্ট্রেস হিসাবে তাকে বিচার করতে পারছি না। কিন্তু এই ছবিতে সে অসাধারণ করেছে। মিশে গেছে ছবির সাথে। আমার মাঝে মাঝে মনে হয় কে বেশি ভালো করছে? সুনেরা নাকি অনেরা, সে এক মধুর যন্ত্রণা! 

 সিন মেকিং বলতে আমি বুঝি শটের সাথে শট জোড়া দেয়া এবং সেই সাথে সিনের সাথে সিন।  যেখানে শেষে গিয়ে মনে হয় পুরো ছবিটা আসলে একটি সিন।  আপনার মনেই হবে না আপনি শট দেখছেন, মনে হবে আপনি সেখানেই আছেন। এটা তখনই হয়, যখন আপনি যা দেখতে চান অবচেতনে পরিচালক সেটাই দেখায়। শটগুলো শক্তিশালী আর জোড়া দেয়াটা ( সম্পাদনা)  বুদ্ধিদীপ্ত হলেই কেবল এই অনুভূতি হয়। যা মশারীতে পুরোপুরি পেরেছেন নুহাশ। 

আবহে- স্কোরে একটা ডিসটোপিয়ান ফিল তৈরি করা খুব দরকার ছিল এই ছবিটাকে। শুরুতে একটি মাইকিং আছে। যেখানে ভোকালটা ছিল প্রীতমের। সেটা থেকে শুরু করে  ফলি , এস এফ এক্স আর ব্যাক গ্রাউন্ড মিউজিক সব মিলে শব্দের যে জগত নুহাশের দল গড়েছে তাতে ভয় আছে, সাসপেন্স আছে, থ্রিল আছে, আছে বিষন্নতা। ভয় আর বিষন্নতা মিশেল, মশারীর বড় গুন। ছবির এন্ড টাইটেলে একটা বাংলা গানের অভাবে বোধ করছিলাম। ন ডরাই এর যন্ত্রণার মত জেফার এর কোনো ট্র্যাক। সেটা পাইনি। অতৃপ্তি এই একটা জায়গাতেই।

মশারীর ইন্টারন্যাশনাল স্বীকৃতি অনেক। অনেক ভালো ভালো জায়গায় অনেক বড় ফিল্ম মেকারের সাথে নুহাশের মশারী দেখানো হয়েছে সেখানে। এসেছে স্বীকৃতি, পুরষ্কার। এছাড়া ইন্টারন্যাশনাল এজেন্টরা নুহাশের সাথে যুক্ত হয়েছে। প্রশংসা পেয়েছে অনেক। সামনেও অনেক জায়গায় যাবার আছে।  ফিল্ম ফেস্টিভালে সবাই আর্ট হাউজের দিকে ঝোঁকে। নুহাশ গেছে মেইনস্ট্রিমের দিকে। আর মেইনস্ট্রিম যখন ফেস্টিভালে স্বীকৃতি পায়, সেটা সারা পৃথিবীতে খুব আলোড়িত হয়। নির্মাতার নিজের মত করে কাজ করতে আর সমস্যা হয় না, স্টুডিও তার সাথে যুক্ত হয়ে যায়।  নুহাশের সাথে সেটাই ঘটবে বলে আমার বিশ্বাস।

 নুহাশকে সত্যি আমার আন্তর্জাতিক মানের ফিল্ম মেকার মনে হয়েছে। তবে নুহাশকে পথ চলতে হবে আরো অনেক পথ। যে পথের স্টেশনে টিকেট কিনতে পেরেছে নুহাশ, ট্রেনটা এখনো আসেনি। সে অপেক্ষা করছে স্টেশনে, গোটা দশেক ট্রেন বদলে তারপর অনেক দূরের কোনো গন্তব্যে যাবার জন্য। সাথে নিয়ে যাবে বাংলাদেশকে। কেন এটা মনে করিয়ে দিলাম? কারণ নুহাশকে আমার একটু বেশি আত্মবিশ্বাসী মনে হয়েছে। যেটা খুব জরুরী আবার রিস্কিও । নুহাশ হুমায়ূনের “ষ” সিরিজটি প্রমাণ দিয়েছে এই আত্মবিশ্বাসের ভিত্তি অনেক গভীরে। তাই নুহাশ আশাবাদী করে। স্বপ্ন দেখতে স্বপ্ন দেখায়।  

লেখাটা শেষ করব মশারীর টিম নিয়ে। টিমটা অসাধারণ । বার বার টাকা ফুরিয়ে গেছে, টাকা জোগাড় করে কাজ হচ্ছে, যাকে মুম্বাইওয়ালা বলে যুগার। এই যুগারের উপর তৈরি হয়ে অনুরাগ কাশ্যপসহ  ইনডিপেনডেন্ট চলচ্চিত্র নির্মাতাদের প্রথম দিককার ছবি গুলো। জোগাড় করতে করতে এই টিম বানিয়ে ফেলেছে সত্যিকারের আন্তর্জাতিক মানের একটি ছবি। 

সেদিন মশারীর বিশেষ প্রদর্শনী থেকে একটা ভালোলাগা নিয়ে বের হয়েছি। সেখান থেকে বেরিয়ে গেছি বাপ্পা মজুমদারের স্টুডিওতে। সেখানে ‘অপারেশন সুন্দরবন’ ছবির একটি গানের রেকর্ডিং চলছিল। চা বিরতিতে বাপ্পাদা বলেছিলেন, বাংলা সিনেমার ভবিষ্যৎ কি দাদা? উত্তরে বলেছিলাম, সিনেমা হলের ভবিষ্যৎ বলতে পারি না, তবে বাংলা সিনেমার ভবিষ্যৎ নিয়ে আমি খুব আশাবাদী। কারণ কেবলেই আমি মশারীর একটি প্রাইভেট স্ক্রিনিং থেকে এলাম। নুহাশের কাজ দেখে এলাম।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন