বিদেশী বিনিয়োগকারীদের পর্যবেক্ষণ

ধীরগতিতে বাস্তবায়ন হচ্ছে অর্থনৈতিক অঞ্চল

বদরুল আলম

দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করতে পরিকল্পিত শিল্পায়ন বাস্তবায়নের পথে রয়েছে বাংলাদেশ। সরকারের লক্ষ্য আছে ২০৩০ সালের মধ্যে ১০০ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার। এসব অঞ্চলে স্থানীয় বিনিয়োগের পাশাপাশি বিদেশী বিনিয়োগের প্রত্যাশা রয়েছে। এরই মধ্যে জাপান, ভারত চীনের জন্য পৃথক অর্থনৈতিক অঞ্চলের কার্যক্রমও কম-বেশি এগিয়েছে। তবে এসব অর্থনৈতিক অঞ্চলের অগ্রগতি নিয়ে খুব একটা সন্তুষ্ট নন বিদেশী বিনিয়োগকারীরা। দেশের অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলো ধীরগতিতে বাস্তবায়ন হচ্ছে বলে সম্প্রতি তাদের পক্ষ থেকে পর্যবেক্ষণ দেয়া হয়েছে।

দেশে বিদেশী বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতিনিধিত্ব করছে ফরেন ইনভেস্টরস চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এফআইসিসিআই) মোট ৩৫টি দেশের বিনিয়োগকারীদের প্রতিনিধিত্ব করছে সংগঠনটি। দেশে মোট প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগের (এফডিআই) ৯০ শতাংশই এসেছে এফআইসিসিআই সদস্য প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে। ব্যাংক আর্থিক খাত থেকে শুরু করে সিমেন্ট, সিরামিক, কেমিক্যাল, নির্মাণ আবাসন, পরামর্শ, এফএফসিজি, গ্যাস-বিদ্যুৎ, চামড়া চামড়াজাত, পোশাক, পরিবহনের মতো খাতগুলোয় বিনিয়োগ রয়েছে প্রতিষ্ঠানগুলোর। সম্প্রতি সংগঠনটির পক্ষ থেকে দেশে বাস্তবায়নাধীন অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোর উন্নয়ন সম্পর্কে পর্যবেক্ষণ দিয়ে একটি প্রকাশনা বের করা হয়েছে।

এতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলো স্থাপন হচ্ছে ধীরগতিতে। ২০১০ সালের নভেম্বরে বাংলাদেশ ইকোনমিক জোনস আইন ২০১০-এর আওতায় বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা) প্রতিষ্ঠা করে সরকার। উদ্যোগ গ্রহণ করা হয় ২০৩০ সালের মধ্যে দেশব্যাপী ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার। অঞ্চলগুলোয় বিনিয়োগের মাধ্যমে কারখানা গড়ে ব্যবসা পরিচালনা করতে স্থানীয় বিদেশী সব বিনিয়োগকারীকেই উৎসাহ দিচ্ছে সরকার।

এফআইসিসিআই জানিয়েছে, ৬৮টি সরকারি এবং ২৯টি বেসরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চলসহ সরকার এখন পর্যন্ত ৯৭টি জোনের অনুমোদন দিয়েছে। যদিও এর মধ্যে পুরোপুরি চালু হওয়া বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের (এসইজেড) সংখ্যা খুবই কম। প্রস্তাবিত অঞ্চলগুলোর বেশির ভাগই সম্ভাব্যতা যাচাই, জমি অধিগ্রহণ অঞ্চলভিত্তিক সামাজিক এবং পরিবেশগত উদ্যোগ চিহ্নিত করার পর্যায়ে রয়েছে। অগ্রগতিতে বাধা সৃষ্টি করছে তীব্র জমিস্বল্পতা জটিল জমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া। ফলে এসইজেড প্রতিষ্ঠার কাজটি সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে।

এফআইসিসিআই পর্যবেক্ষণের সঙ্গে একমত না হলেও পুরোপুরি ভিন্ন মত দিতে পারছেন না বেজাসংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, একটি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠায় অনেক সময়ের প্রয়োজন হয়। সম্ভাব্যতা যাচাই করতেই চলে যায় এক বছর। কাজটিও বেজা করে না। সরকারি বেসরকারি সংস্থাগুলো কাজটি করে। টেন্ডারের প্রক্রিয়ায় অনেক সময় চলে যায়। ডিপিপি প্রণয়ন করে এগুলোর অনুমোদনেও সময় ব্যয় হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে কারখানা নিয়ে পরিবেশ অধিদপ্তরের আপত্তি আসে। এছাড়া অনেক ক্ষেত্রে উদ্যোক্তাদের কাছ থেকেও সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না।

জানতে চাইলে অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র সচিব বেজার নির্বাহী চেয়ারম্যান শেখ ইউসুফ হারুন বণিক বার্তাকে বলেন, সময় ব্যয়ের এত ক্ষেত্র থাকার পরও অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠায় অগ্রগতি নেই বলা যাবে না। এখন পর্যন্ত সম্ভাব্যতা যাচাই থেকে শুরু করে আরো অগ্রগতি আছে এবং কার্যক্রম চলমান আছে এমন অঞ্চল ৪৮টি। এগুলোর কিছু সম্ভাব্যতা যাচাই পর্যায়ে, কিছু অঞ্চল আছে সেগুলো প্রস্তুত আছে, কিছু অঞ্চলের ডিপিপি প্রণয়ন করে একনেকে আছে অনুমোদনের জন্য। অর্থনৈতিক অঞ্চল হতে সময় লাগে, রাতারাতি হয় না। তবে বেজা বসে আছে এমনটা নয়। অনেক ধাপ পার হতে হয়। ধরনের পদ্ধতিগত প্রক্রিয়াগত বিষয় অনুসরণেই সময় লাগছে।

বিদেশী বিনিয়োগকারী বেজায় বিনিয়োগকারীদের প্রতিনিধিরা বলছেন, সরকারের পক্ষ থেকে একটি অর্থনৈতিক অঞ্চলও যদি সফল কার্যকর অর্থনৈতিক অঞ্চল হিসেবে দেখানো সম্ভব হতো, তাহলে সব বিনিয়োগকারীর জন্য ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা সামনে তুলে ধরা সম্ভব হতো। তাদের বলা যেত, ধরনের পরিকল্পিত বিনিয়োগই বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ। অর্থনৈতিক অঞ্চল উন্নয়নে প্রথম ধাপের অবকাঠামো উন্নয়নের গতিও অনেকটাই শ্লথ হয়ে পড়েছে। অনেক আইন আছে, যেগুলোর আরো অনেক স্বচ্ছতা প্রয়োজন। পরিষেবা মূল্য নিয়েও প্রশ্ন আছে। পানিসংক্রান্ত নীতির বিষয়েও স্পষ্টতার প্রয়োজন আছে।  

জানতে চাইলে এফআইসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি বর্তমানে বাংলাদেশ ইকোনমিক জোন ইনভেস্টরস অ্যাসোসিয়েশনের সহসভাপতি রুপালী চৌধুরী বণিক বার্তাকে বলেন, অবকাঠামো উন্নয়ন দ্রুততার সঙ্গে হওয়া প্রয়োজন। পাশাপাশি যে আইনগুলো আছে, সেগুলো অন্তত প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়া প্রয়োজন। ভারতে অনেক জোনে জিএসটি নেয়া হয় না। বাংলাদেশে শুধু করপোরেট কর কিছুটা কমিয়ে দেয়া হচ্ছে। ভারত ভিয়েতনামের সঙ্গে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলো প্রতিযোগিতা সক্ষমতাসম্পন্ন হতে হবে। শুধু কম মজুরির শ্রম দিয়ে হবে না।

বিষয়ে ফরেন ইনভেস্টরস চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ বাংলাদেশের সভাপতি নাসের এজাজ বিজয় বলেন, সরকারের ১০০ এসইজেড বাস্তবায়নে আমাদের পূর্ণ সমর্থন আছে। এটি বাস্তবায়ন হলে প্রথমত আমাদের সীমিত ভূমির দক্ষ ব্যবহার নিশ্চিত হবে। দ্বিতীয়ত, লক্ষ্যভিত্তিক অবকাঠামো নির্মাণের কারণে উৎপাদনশীলতাও বাড়বে। একই সঙ্গে অর্জন হবে কমপ্লায়েন্স মানও। বিশ্বব্যাংকের ডুয়িং বিজনেস ইনডেক্সে ভূমির সীমাবদ্ধতা বা ইউটিলিটি সংযোগের মতো যেসব দুর্বলতার কথা উঠে এসেছে, সেগুলোও দূর করা যাবে। স্বীকার করছি, মহামারীর প্রাদুর্ভাবের কারণে কিছু চ্যালেঞ্জ তৈরি হওয়ায় এসইজেডগুলো বাস্তবায়নের গতি কিছুটা ধীর হয়েছে। তবে নানা জটিলতা সত্ত্বেও মিরসরাইয়ের মতো উচ্চাভিলাষী প্রকল্পগুলোর কাজ এগিয়ে যাচ্ছে। আড়াইহাজার এসইজেডের কাজও ভালোই এগিয়ে চলেছে। আমাদের প্রত্যাশা, এসইজেডগুলোর মধ্যে গড়ে তোলা শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো ভালো করবে, যা অন্যান্য স্থানীয় বিদেশী বিনিয়োগকারীদেরও বাংলাদেশে আকর্ষণ করে নিয়ে আসবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন