প্যাসিফিক জিন্স

পাঁচ বছরে ব্যবসা দ্বিগুণ করার পরিকল্পনা দ্বিতীয় প্রজন্মের

রাশেদ এইচ চৌধুরী, চট্টগ্রাম ব্যুরো

বিশ্ববাজারে ডেনিম কাপড়ে তৈরি পোশাকের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের যে প্রতিষ্ঠানটির নাম উল্লেখ করতেই হয়, সেটি হলো প্যাসিফিক জিন্স গ্রুপ। ১৯৯৪ সালে এককভাবে প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তোলেন চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী মো. নাছির উদ্দিন। ব্যবসায় প্রথমদিকের বার্ষিক লেনদেনের পরিমাণ ছিল মিলিয়ন ডলার। দ্বিতীয় প্রজন্মের হাতে পরিচালিত প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক টার্নওভার এখন ৪৫০ মিলিয়ন ডলার। আর আগামী পাঁচ বছরে সংখ্যাকে দ্বিগুণ করতে চান প্যাসিফিক জিন্স গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক চট্টগ্রাম চেম্বারের সহসভাপতি সৈয়দ মোহাম্মদ তানভীর। বাবার কাছ থেকে শেখা ব্যবসায়িক শিক্ষা নিয়েই তিনিসহ গ্রুপের ৩৫ হাজার সদস্য পথ চলছেন বলে জানালেন তিনি।

থাইল্যান্ডের একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গত ২৮ ফেব্রুয়ারি মারা যান মো. নাছির উদ্দিন। তবে জীবদ্দশাতেই গ্রুপটির মিশন-ভিশন ঠিক করে দিয়ে গেছেন তিনি। এর অন্যতম হলো প্রথম ধাপে ২০২৮ সালের মধ্যে বার্ষিক টার্নওভার বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করা। এজন্য সুনির্দিষ্ট কিছু গাইডলাইনও দিয়ে গেছেন তিনি। প্রতিষ্ঠানে মডার্ন ম্যানেজমেন্ট কনসেপ্ট চালু রাখা, কোম্পানির লভ্যাংশ না তুলে পরবর্তী বিনিয়োগের উদ্যোগ নেয়ার নির্দেশনা রয়েছে এর মধ্যে।

বড় পরিসরে ব্যবসা পরিচালনা করলেও ব্যাংক কিংবা আর্থিক কোনো প্রতিষ্ঠানের কাছে এখন প্যাসিফিক জিন্স গ্রুপের কোনো দায় নেই। ব্যাপারে মো. নাছির উদ্দিনই উত্তরসূরিদের সচেতন করে গেছেন, যা পালন করে চলেছেন দ্বিতীয় প্রজন্মের সদস্যরা। এছাড়া প্রতিষ্ঠানের প্রবৃদ্ধি বজায় রাখতে প্রতিনিয়ত গবেষণা এবং উদ্ভাবন কার্যক্রমে অর্থ ব্যয় মনোযোগী থাকার নির্দেশনাও দিয়ে গেছেন তিনি।

খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, সাধারণত আমাদের দেশে কোনো প্রতিষ্ঠাতার মৃত্যু হলে সে প্রতিষ্ঠানের ভিত নড়ে যায়। বিশেষ করে পারিবারিক ব্যবসাগুলো চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে। সম্পর্ক, ক্ষমতা, প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের সঙ্গে সমন্বয়; এসব নিয়ে টালমাটাল হয়ে পড়ে প্রতিষ্ঠান পরিচালনা ব্যবস্থা। বিশেষ করে চট্টগ্রামে অনেক প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রেই দেখা গেছে, প্রথম প্রজন্মের মতো প্রজ্ঞা দিয়ে বেশির ভাগ পারিবারিক ব্যবসারই হাল ধরতে পারেনি দ্বিতীয় প্রজন্ম। সে হিসেবে এখন পর্যন্ত নিজেদের অবস্থান আরো শক্তিশালী করেছে প্যাসিফিক জিন্স গ্রুপ।

বিষয়ে জানতে চাইলে গ্রুপটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক চট্টগ্রাম চেম্বারের সহসভাপতি সৈয়দ মোহাম্মদ তানভীর বণিক বার্তাকে বলেন, আমার বাবা স্বপ্ন দেখতেন এবং তা বাস্তবে রূপ দিতেন। ব্যবসা পরিচালনায় অনেক প্রতিকূল অবস্থা তিনি অত্যন্ত ধৈর্যের সঙ্গে মোকাবেলা করেছেন। রাজনীতিতে সম্পৃক্ত না হয়েও মানুষের জন্য কাজ করে গিয়েছেন। ব্যবসা পরিচালনায় আমার যেটুকু শিক্ষা, সেটি তার কাছ থেকে পাওয়া। শুধু সন্তানদেরই নয়, তার অনুপস্থিতিতে প্রতিষ্ঠানের কর্মযজ্ঞ সামলানোর ধারণাটি ৩৫ হাজার সদস্যের মধ্যেই বুনে দিয়ে গেছেন তিনি। ব্যবসার প্রসার ঘটিয়েছেন ঐকান্তিক প্রচেষ্টা, মেধা, শ্রম আর দূরদর্শিতার সঙ্গে।

তানভীর আরো বলেন, ব্যবসায়িক ধারণায় বাবা ব্লু-ওশান স্ট্র্যাটেজিকে প্রাধান্য দিতেন। ব্যবসার টেকসই সম্প্রসারণের জন্য তিনি যথাযথভাবে প্রাতিষ্ঠানিক সুশাসন প্রয়োগ করতেন। তার কাছ থেকেই টিমওয়ার্কের গুরুত্ব বুঝেছি। আমিও তার দর্শন দিয়েই ব্যবসাকে দেখার চেষ্টা করি। ব্যবসা পরিচালনায় তার দর্শনকে সামনে রেখেই আগামী সাত বছরের মধ্যে বার্ষিক টার্নওভার বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করার লক্ষ্য ঠিক করেছি। এজন্য উৎপাদন ব্যবস্থাকে গ্লোবাল লাইফ সলিউশন বেজড করার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছি। পাশাপাশি বাবার মতো সামাজিক দায়বদ্ধতার ক্ষেত্রেও সচেষ্ট থাকব।

রফতানিমুখী পোশাক খাতের উদ্যোক্তাদের কাছে দিকপাল হিসেবে পরিচিত প্রয়াত মো. নাছির উদ্দিন জীবনের শুরুতে ট্রেডিং, ফিশ প্রসেসিং, শিপ ব্রেকিং ব্যবসা করেছেন। এমনকি দিয়েছিলেন জুতার দোকানও। ১৯৮৪ সালে বস্ত্র খাতে নিজেকে সম্পৃক্ত করেন। দুজন বিনিয়োগকারীকে সঙ্গে নিয়ে মাত্র ২০০ শ্রমিক দিয়ে এনজেডএন ফ্যাশন নামের কারখানা দিয়ে শুরু করেন। এরপর ১৯৯৪ সালে এককভাবেই গড়ে তোলেন প্যাসিফিক জিন্স। সেই প্রতিষ্ঠানে এখন কর্মী সংখ্যা ৩৫ হাজার। তাদের প্রস্তুত করা পণ্য রফতানি হচ্ছে বিশ্বের ৪০টি দেশে।

প্যাসিফিক জিন্স গ্রুপ দেশের সেরা রফতানিকারক হিসেবে বহু বছর ধরে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতিপ্রাপ্ত। রফতানিতে উল্লেখযোগ্য অবদানের জন্য ২৫ বার জাতীয় রফতানি ট্রফি পেয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। মো. নাছির উদ্দিন শুধু সিইপিজেডেই গড়ে তুলেছেন সাতটি বড় কারখানা। ইপিজেড ক্যাটাগরিতে স্বর্ণ, রৌপ্য ব্রোঞ্জ তিনটি পদকই রয়েছে প্যাসিফিক জিন্সের ঝুলিতে।

প্রতিষ্ঠানটির উত্তরণের বিষয়ে কথা হয় চট্টগ্রাম চেম্বারের সভাপতি মাহবুবুল আলমের সঙ্গে। তিনি বলেন, প্রতিষ্ঠাতার প্রয়াণের পর পরবর্তী প্রজন্মের হাতে ব্যবসা আরো বড় হওয়ার ক্ষেত্রে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ সামনে চলে আসে। সেক্ষেত্রে যিনি গড়েছেন তার জীবদ্দশাতেই প্রাতিষ্ঠানিক কার্যক্রমে সুশৃঙ্খল কাঠামো তৈরি করা না গেলে বড় ঝুঁকি তৈরি হয়। প্যাসিফিক জিন্স গ্রুপের বেলায় দ্বিতীয় প্রজন্মের নেতৃত্ব বেশ আশাব্যঞ্জক। প্রয়াত নাছির উদ্দিন জীবদ্দশাতেই তার উত্তরসূরিদের হাতেকলমে সব শিখিয়ে গিয়েছেন। আমি বিশ্বাস করি, দেশের কর্মসংস্থান বৃদ্ধি রফতানিতে আরো বড় পরিসরে নেতৃত্ব দেবে তার প্রতিষ্ঠান।

ওয়েল গ্রুপের পরিচালক বিজিএমইএর প্রথম সহসভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, দেশের অনেক প্রতিষ্ঠানই এখন দ্বিতীয় প্রজন্মের হাতে গেছে। তাদের উচিত পোশাক খাতের ব্যবসার অব্যাহত চাপ সামলানোর মানসিকতা বা দক্ষতা গড়ে তোলা। যেমনটি করে দেখিয়েছে প্যাসিফিক জিন্সের দ্বিতীয় প্রজন্ম।

প্যাসিফিক জিন্স গ্রুপ এরই মধ্যে ব্যবসায়িক পরিকল্পনা ঠিক করেছে। এখন রফতানিমুখী পোশাক খাতে গ্লোবাল লাইফ সলিউশন প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। অর্থাৎ একজন মানুষের সকাল থেকে শুরু করে রাতে ঘুমানোর আগ পর্যন্ত যত ধরনের পোশাক দরকার হয়, তার সবই প্রস্তুত করবে প্যাসিফিক জিন্স। আগামী পাঁচ বছরে ব্যবসা দ্বিগুণ করতে মোটা দাগে পাঁচ ধরনের নীতি নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা প্রতিষ্ঠানটির। এগুলো হলো একীভবন, গতি, উদ্ভাবন, মান স্থায়িত্ব নিশ্চিত করা। আর মাধ্যমেই ২০২৮ সালের মধ্যে প্যাসিফিক জিন্স গ্রুপ বার্ষিক টার্নওভার বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করতে চায়।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন