ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল গড়ে উঠেছে আটটি রাজ্য নিয়ে। এ আট রাজ্যকে ‘সেভেন সিস্টার্স (আসাম, অরুণাচল, মনিপুর, মেঘালয়, মিজোরাম, নাগাল্যান্ড ও ত্রিপুরা) অ্যান্ড ওয়ান ব্রাদার (সিকিম)’ নামেও অভিহিত করা হয়। গোটা ভারতে জাতিগত ও ভৌগোলিক বৈচিত্র্য সবচেয়ে বেশি দেখা যায় এ অঞ্চলেই। এ আট রাজ্যকে ধরা হয় ভারতের ভূরাজনৈতিকভাবে সবচেয়ে সংবেদনশীল এলাকা হিসেবে।
উত্তর-পূর্ব ভারতের আঞ্চলিক সীমান্তের ৯৮ শতাংশই আন্তর্জাতিক, যার মোট পরিমাণ ৫ হাজার ১৮২ কিলোমিটার। এসব সীমানা রয়েছে বাংলাদেশ, চীন, নেপাল, ভুটান ও মিয়ানমারের সঙ্গে। বাকি ২ শতাংশ সীমানা রয়েছে ভারতের অন্যান্য রাজ্যের সঙ্গে। অঞ্চলটির মোট আয়তন ২ লাখ ৬২ হাজার ২৩০ বর্গকিলোমিটার, যা ভারতের মোট আয়তনের প্রায় ৮ শতাংশ। ব্রহ্মপুত্রসহ এ অঞ্চলের বৃহৎ আন্তঃসীমান্ত নদীগুলোর বড় একটি অংশ এ এলাকার ওপর দিয়ে প্রবাহিত। প্রাকৃতিক ও খনিজ সম্পদের প্রাচুর্য থাকলেও অবকাঠামোগত উন্নয়নের দিক থেকে অঞ্চলটি পিছিয়ে। দারিদ্র্যও রয়েছে। সাড়ে চার কোটি জনসংখ্যার অঞ্চলটিতে জাতিগোষ্ঠী রয়েছে ২২০টি। ইতিহাস, সংস্কৃতি ও ক্ষমতাকাঠামোর দিক থেকে প্রতিটি রাজ্যই একে অন্যের চেয়ে ভিন্ন। আবার পার্বত্য ও বনভূমি নিয়ে গঠিত রাজ্যগুলোয় পাহাড়ি ও সমতলের বাসিন্দাদের মধ্যেও অবকাঠামোগত নানা বৈষম্য দেখা যায়। এ বৈষম্যের কারণে গত কয়েক দশকে এ অঞ্চলে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের তত্পরতা ছিল অনেক বেশি। নিরাপত্তা ও স্থিতিশীল পরিবেশের ঘাটতির কারণে অঞ্চলটির অর্থনৈতিক সম্ভাবনাকেও খুব একটা কাজে লাগানো যায়নি। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় অঞ্চলটিতে বিচ্ছিন্নতাবাদী তত্পরতা অনেকটাই কমে গিয়েছে।
ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় উন্নয়নবিষয়ক মন্ত্রী জি কিষাণ রেড্ডি গতকাল এক আলোচনায় বলেছেন, বিচ্ছিন্নতাবাদীদের তত্পরতা কমে আসায় অঞ্চলটিতে শান্তি ও সম্ভাবনার নতুন অধ্যায় শুরু হয়েছে। ২০১৪ সালে অঞ্চলটিতে বিচ্ছিন্নতাবাদজনিত সহিংসতার ঘটনা ঘটেছিল ৮২৪টি। ২০২০ সালের মধ্যেই তা নেমে এসেছে ১৬৩টিতে। বিচ্ছিন্নতাবাদী তত্পরতা কমে আসায় অঞ্চলটিতে বেসামরিক নাগরিক ও নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের মৃত্যুর ঘটনাও অনেকটাই কমে এসেছে। বিদ্রোহী দলগুলোর সঙ্গে সই হওয়া নানা চুক্তি এবং তাদের পুনর্বাসনে গৃহীত নানা আর্থিক প্যাকেজ অঞ্চলটিতে শান্তি ও স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার বিষয়ে বড় ধরনের ভূমিকা রেখেছে। একই সঙ্গে অঞ্চলটির উন্নয়নে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের বাজেট সহায়তাও এখন অনেক বেড়েছে। ২০১৪ সালে এ অঞ্চলের জন্য বাজেট বরাদ্দ ছিল ৩৬ হাজার ১০৮ কোটি রুপি। ২০২২-২৩ অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭৬ হাজার ৪০ কোটি রুপিতে। এছাড়া অঞ্চলটির সড়ক, রেল ও আকাশপথে কানেক্টিভিটি বাড়ানোর বিষয়েও ভারত সরকারের পক্ষ থেকে নানা প্রকল্প নেয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ, চীন, মিয়ানমার, ভুটান ও নেপাল সীমান্তবর্তী এলাকা উত্তর-পূূর্ব ভারত দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনৈতিক হটস্পটগুলোর অন্যতম। এলাকাটির অবস্থান দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ঠিক সংযোগস্থলে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উত্তর-পূর্ব ভারতের সীমান্তবর্তী দেশগুলোর সুরক্ষার স্বার্থেই এলাকাটির শান্তি ও স্থিতিশীলতা প্রয়োজন। অতীতেও দেশগুলোর নিরাপত্তা পরিস্থিতিতে এ অঞ্চলের পরিবেশ বড় ধরনের প্রভাবক হিসেবে কাজ করার নিদর্শন রয়েছে।
নিরাপত্তা পরিস্থিতি অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে আসায় এ অঞ্চলে আরোপিত বিশেষ জরুরি নিরাপত্তা আইনগুলোও এখন শিথিল করে আনা হচ্ছে। বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দমনে ১৯৫৮ সালে উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ভারতের সশস্ত্র বাহিনীকে বিশেষ ক্ষমতা দিয়ে জারি করা হয়েছিল আর্মড ফোর্সেস স্পেশাল পাওয়ার অ্যাক্ট (এএফএসপিএ)। প্রথমে মনিপুর রাজ্যে এ আইনের প্রয়োগ শুরু হয়েছিল। পরে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের তত্পরতা বাড়ায় উত্তর-পূর্ব ভারতের অন্যান্য এলাকাকেও এর আওতায় নিয়ে আসা হয়। বর্তমানে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসায় আইনটির আওতাধীন এলাকার পরিমাণও কমিয়ে আনা হয়েছে। সর্বশেষ গত মাসে এক ঘোষণায় অঞ্চলটির বড় একটি অংশ থেকে আইনটি প্রত্যাহার করে নেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন ভারতীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ।
আন্তর্জাতিক ভূরাজনীতির পর্যবেক্ষকদের ভাষ্য অনুযায়ী, প্রতিবেশী দুটি দেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের অনেকটাই নির্ভর করে সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোর পরিবেশের ওপর। সীমান্ত এলাকায় বিচ্ছিন্নতাবাদী তত্পরতা বেড়ে গেলে তা বাণিজ্য ও পর্যটনের বিকাশের পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। একই সঙ্গে এর ধারাবাহিকতায় প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সন্দেহেরও অবকাশ তৈরি হয়। উত্তর-পূর্ব ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী তত্পরতা অতীতে এ অঞ্চলের প্রতিবেশী প্রায় সব দেশের জন্যই বিব্রতকর পরিস্থিতির কারণ হয়েছিল। বর্তমানে সংঘাত কমে আসায় এ অঞ্চলকেন্দ্রিক ব্যবসা-বাণিজ্য ও অবকাঠামোগত উন্নয়নের এক অভূতপূর্ব সুযোগ তৈরি হয়েছে। এ অঞ্চল ঘিরে দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় বাণিজ্যের প্রসার ঘটানোর এমন সুযোগ গত কয়েক দশকে আসেনি।
দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সংযোগস্থল উত্তর-পূর্ব ভারতের ভৌগোলিক ও বাণিজ্যিক অবস্থানকে কাজে না লাগাতে পারার পেছনে বিচ্ছিন্নতাবাদী তত্পরতাকেই দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের ভাষ্যমতে, বর্তমান শান্তিপূর্ণ পরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে এ অঞ্চলের কানেক্টিভিটি ও অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগ বাড়ানোর সুযোগ তৈরি হয়েছে। এ সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে পারলে ভবিষ্যতে আঞ্চলিক বাণিজ্য, কানেক্টিভিটিসহ আরো অনেক দিক দিয়েই দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো লাভবান হতে পারবে।
বিচ্ছিন্নতাবাদী তত্পরতা ছাড়াও উত্তর-পূর্ব ভারতের দুর্গম ও জটিল ভূগঠনকে এখানকার পশ্চাত্পদতার বড় কারণ হিসেবে দেখছেন অর্থনীতিবিদ ও নীতিনির্ধারকরা। আবার অর্থনৈতিক বিশ্বায়নের যুগে এ অঞ্চলের উন্নয়নের অপরিহার্যতাও বড় হয়ে উঠেছে বলে মনে করছেন তারা। তাদের বক্তব্য অনুযায়ী, ভারতের ‘লুক ইস্ট’ (পুবে দেখো) ও এর ধারাবাহিকতায় গৃহীত ‘অ্যাক্ট ইস্ট’ (পুবে চলো) নীতি বাস্তবায়নের জন্য দেশটির উত্তর-পূর্বাঞ্চল হলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এলাকা। শুধু ভারত নয়, বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিকভাবে বিমসটেক জোটভুক্ত অন্য দেশগুলোর (বাংলাদেশ, ভুটান, মিয়ানমার, নেপাল, শ্রীলংকা ও থাইল্যান্ড) সমৃদ্ধিতেও বড় ধরনের ভূমিকা রাখতে পারে অঞ্চলটি। বিষয়টি অনুধাবন করতে পারছে ভারত সরকারও। এরই ধারাবাহিকতায় সাম্প্রতিক বছরগুলোয় উত্তর-পূর্বাঞ্চলের কানেক্টিভিটি ও অবকাঠামোগত উন্নয়নে বিনিয়োগ বাড়িয়েছে দেশটি।
তবে এসব বিনিয়োগের জন্য সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতার মাত্রা বাড়ানো প্রয়োজন বলে মনে করছেন সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, উত্তর-পূর্ব ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী সহিংসতার ঘটনা কমে আসার বিষয়টি নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের জন্য ভালো খবর। এখন পর্যন্ত এলাকার অর্থনীতির খুব একটা বিকাশ হয়নি। এখানকার মধ্যবিত্ত ভোক্তা শ্রেণীটি এখনো সেভাবে বিকশিত হয়নি। এখানকার দুর্বল অর্থনীতি গড়ে উঠেছে মূলত কৃষি, বনজ ও খনিজ সম্পদের ওপর ভিত্তি করে। লাগোয়া অংশ হিসেবে এখানকার পরিস্থিতির সঙ্গে বাংলাদেশেরও নিরাপত্তা স্বার্থ রয়েছে। এলাকাটি খানিকটা বিচ্ছিন্ন। এ জায়গার সুযোগগুলোকে কাজে লাগাতে হলে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর মধ্যে সহযোগিতার বাতাবরণ আরো শক্তিশালী হওয়া প্রয়োজন।
বর্তমানে উত্তর-পূর্ব ভারত আঞ্চলিক কানেক্টিভিটির একটি বড় হাব হয়ে উঠছে। এশিয়ান হাইওয়েসহ দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যে সংযোগ স্থাপনকারী বেশ কয়েকটি বাস্তবায়নাধীন এবং পরিকল্পনাধীন সড়ক-রেল নেটওয়ার্ক এ অঞ্চলের ওপর দিয়ে গিয়েছে। এছাড়া জলবিদ্যুৎসহ আরো অনেক অবকাঠামোগত উন্নয়ন প্রকল্পও এখানে বাস্তবায়নাধীন।
ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুরের ইনস্টিটিউট অব সাউথ এশিয়ান স্টাডিজের ননরেসিডেন্ট সিনিয়র ফেলো এবং নয়াদিল্লিভিত্তিক থিংকট্যাংক প্রতিষ্ঠান বিবেকানন্দ ইন্টারন্যাশনাল ফাউন্ডেশনের নেবারহুড স্টাডিজ সেন্টারের প্রধান ড. শ্রীরাধা দত্ত মনে করছেন উত্তর-পূর্ব ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংঘাত কমে আসায় বাংলাদেশের জন্য লাভবান হওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, বাংলাদেশের নিরাপত্তার জন্য উত্তর-পূর্ব ভারতের পরিস্থিতি স্থিতিশীল হওয়াটা খুবই জরুরি। অঞ্চলটির সঙ্গে বাংলাদেশের শক্তিশালী অর্থনৈতিক সংযোগ রয়েছে। উত্তর-পূর্ব ভারতের বাংলাদেশের ওপর নির্ভরতা অনেক বেশি। পরিস্থিতি ভালো হওয়ায় বাণিজ্য খাতে অনেক বাধা দূর হওয়ার পাশাপাশি এখন তা আরো জোরালো হয়েছে। বাংলাদেশী বিনিয়োগকারীরাও এখন সেখানে বিনিয়োগ নিয়ে যাচ্ছেন।