কার্ল মার্ক্সের (১৮১৮-১৮৮৩) মৃত্যুর তিন বছর পর ১৮৮৬ সালে সংগঠিত হয় মে দিবসের দুনিয়া কাঁপানো ঘটনা বা শ্রমিক অভ্যুত্থান। এর আগে মার্ক্স যখন পুঁজি গ্রন্থ নিয়ে কাজ করছেন তখন পুঁজিবাদের বিকাশের স্বরূপ বিশ্লেষণ করেছেন, একদিকে দেখেছেন এর নির্মমতা, অন্যদিকে দেখেছেন শ্রমিকদের ক্রমে সরব আবির্ভাব। তার পুঁজি গ্রন্থে কারখানা পরিদর্শকদের বহু রিপোর্ট সে সময়কার কারখানা ও শ্রমিকদের অবস্থা বর্ণনায় অন্যতম সূত্র হিসেবে ব্যবহূত হয়েছিল।
প্রায় ১৫০ বছর পর বাংলাদেশের কারখানাগুলোর অবস্থা সে রকমই, কিন্তু কোনো প্রামাণ্য দলিল নেই, কারখানা পরিদর্শক হিসেবে কোনো প্রতিষ্ঠানের সক্রিয় ভূমিকা আমরা প্রত্যাশাই করতে পারি না। সরকার কারখানা পরিদর্শকের চেয়ে শিল্প পুলিশ নিয়োগে বেশি আগ্রহী, কারণ মালিকদের সেটাই দাবি। এমন কোনো দৃষ্টান্ত নেই যে বেতন-মজুরি বকেয়া রাখা, নির্যাতন, প্রতারণার দায়ে শিল্প পুলিশ মালিকপক্ষের কাউকে কখনো আইনের আওতায় এনেছে; কিন্তু শ্রমিকদের বিরুদ্ধে তাদের অ্যাকশন নিযমিত। সেজন্য শিল্প পুলিশ মানে দাঁড়িয়েছে এমন বাহিনী, যারা মালিকদের ইচ্ছামাফিক শ্রমিকদের হয়রানি, নির্যাতন ও আটক করবে। প্রকাশ্যেই মালিকপক্ষ পুলিশ-র্যাবকে গাড়িসহ নানা উপহার দেয়, শ্রমিকরা কি দিতে পারবেন?
মজুরি শ্রমিকের জন্ম ও বিকাশের সঙ্গে পুঁজিবাদের জন্ম ও বিকাশের সম্পর্ক প্রত্যক্ষ। মজুরি শ্রমিকের সংখ্যা বৃদ্ধি ছাড়া পুঁজিবাদের অস্তিত্ব ও বিস্তার সম্ভব হয় না। সেজন্য ইউরোপে শিল্প বিপ্লবকালে একদিকে যেমন পুঁজিপতি একটি শ্রেণী হিসেবে তার আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছে, অন্যদিকে তেমনি তৈরি হয়েছে শ্রমিক শ্রেণী। একই সময়ে যুক্তরাষ্ট্রেও প্রায় একই চিত্র ছিল। কাজের সময় কিংবা মজুরির তখন ঠিক ছিল না। ক্রমেই নারী-শিশুসহ শ্রমিকদের অবর্ণনীয় জীবন পরিবর্তনের জন্য অসংখ্য প্রতিবাদ, বিক্ষোভ তৈরি হয়; সংগঠন গড়ে ওঠে। উনিশ শতকের ৬০-৭০-৮০ দশকের এসব আন্দোলনের ধারাবাহিকতাতেই ১৮৮৬ সালের মে মাসের ১ তারিখে তিন লাখের বেশি শ্রমিকের ধর্মঘটের মধ্যে শিকাগো শহরের বড় সমাবেশে হামলা হয়। গুলিতে নিহত হন শ্রমিকরা, পরে আবার প্রহসনমূলক বিচারে শ্রমিক সংগঠকদেরই ফাঁসিতে ঝোলানো হয়। এ জীবনদান বৃথা যায়নি। একসময় যে দাবিকে বলা হয়েছে উন্নয়নবিরোধী, সন্ত্রাসী, ক্রমে সারা বিশ্ব সেই দাবিই গ্রহণ করেছে, মে দিবস পরিণত হয়েছে আন্তর্জাতিক দিবসে।
পুঁজিবাদী বিশ্বব্যবস্থায় পুঁজির দ্রুত সংবর্ধনের পাশাপাশি শ্রমের সঙ্গে যুক্ত সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের অস্তিত্বের লড়াইয়ে মে দিবসের কথাই তাই আসে বারবার। অব্যাহত প্রান্তিকীকরণ ও নিপীড়নমূলক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে তাদের বিকশিত হওয়ার তাগিদ দেয় মে দিবস। এ লড়াইয়ের দুর্বলতা থাকলে তা শ্রমিক শ্রেণীকে কতটা হীন অবস্থায় ফেলতে পারে, বাংলাদেশ তার দৃষ্টান্ত। ২০১৩ সালে রানা প্লাজা ধসে হাজারো শ্রমিক মারা গেল, এ রকম ধসের পরও দেশে নিরাপত্তা, মজুরি ও সংগঠনের অধিকারের যে হাল তা এ দুর্বলতারই প্রকাশ। এ দুর্বলতার কারণেই দেশীয় লুটেরা পুঁজিপতি ও আন্তর্জাতিক মুনাফাখোরদের সীমাহীন লোভ ও তাদের রাজনৈতিক কর্তৃত্বের ফলাফল হিসেবে বারবার কারখানা পরিণত হয় গণকবরে। গত বছর রূপগঞ্জে পুড়ে নিহত হলেন ৫০ জনেরও বেশি শ্রমিক, নির্মাণ শ্রমিক নিহত হচ্ছেন নিয়মিত। এগুলোর কোনো প্রতিকার নেই, আর ঘটবে না—এ রকম অবস্থা সৃষ্টির কোনো চেষ্টাও নেই।
বাংলাদেশে গত কয়েক দশকে সমাজ ও অর্থনীতির মধ্যে যে পরিবর্তনগুলো হয়েছে, তার একটি বড় বহিঃপ্রকাশ হচ্ছে শ্রমিক শ্রেণীর গঠনের পরিবর্তন। বিভিন্ন অর্থনৈতিক সংস্কারের নামে ৮০ দশক থেকে অনেক রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষিত হয়েছে। সর্বশেষ বৃহৎ শিল্পপ্রতিষ্ঠান আদমজী পাটকল বন্ধ হয়েছে, অবশিষ্ট কারখানাগুলো বন্ধ বা দখল হওয়ার প্রক্রিয়া চলছে মুখ্যত জমি দখলের প্রকল্পের অংশ হিসেবে। ১৯৮০ দশক পর্যন্ত এ রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের শ্রমিকরাই ছিলেন দেশের শিল্প শ্রমিকদের প্রধান সংগঠিত অংশ। সরকার নির্বিশেষে রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প-কারখানা বন্ধ করার প্রক্রিয়াটি শুধু রাষ্ট্রায়ত্ত সম্পদ ব্যক্তি দখলে নেয়ার প্রক্রিয়াই নয়, এটি একই সঙ্গে শিল্প শ্রমিকদের সংগঠিত শক্তিকে ভেঙে দেয়ার দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্পের অংশ। বর্তমান সময়ে বাংলাদেশে শিল্প খাতের মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প খাতের অবস্থ্থান খুবই প্রান্তিক। একই কারণে ইউনিয়নভুক্ত শ্রমিকদের সংখ্যাও তুলনায় অনেক কম। রফতানিমুখী খাত হিসেবে গার্মেন্ট শিল্প খাতের মধ্যে এখন প্রাধান্যে। সবচেয়ে বেশিসংখ্যক শ্রমিক এ খাতেই নিয়োজিত। এ খাত অনেক বেশি আলোচিত হলেও এখানেও ইউনিয়নের সংখ্যা হাতেগোনা, অন্যান্য সংগঠনের অবস্থাও খুবই দুর্বল।
অন্যদিকে গত কয়েক দশকে একই অর্থনৈতিক সংস্কার প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে উদ্ভূত হয়েছে কয়েক হাজার দখলদার চোরাই কোটিপতি। উৎপাদনশীল প্রক্রিয়া অব্যাহত এবং বিকশিত করার চেয়ে অতিশোষণ, দখল, লুণ্ঠন ও পাচারের মধ্য দিয়ে দ্রুত কোটিপতি হওয়াই তাদের লক্ষ্য। বাংলাদেশের রাজনীতি অর্থনীতি প্রধানত তাদের দ্বারাই পরিচালিত। সেই কারণে জনগণের বৃহত্তম অংশ শ্রমিক ও শ্রমজীবী মানুষ তাদের ন্যূনতম গণতান্ত্রিক অধিকার থেকে বঞ্চিত। বেশির ভাগ শিল্প-কারখানায় ন্যূনতম বাঁচার মতো মজুরি, ৮ ঘণ্টা শ্রম দিবস, নিয়োগপত্র. সাপ্তাহিক ছুটি, কাজ ও কর্মপরিবেশের নিরাপত্তা সব বা অধিকাংশই অনুপস্থিত। ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার প্রতিষ্ঠা এখনো অব্যাহত নিপীড়ন ও প্রতারণার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের বিষয়। ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার নিয়ে কাজ করার জন্য ধরপাকড়, হামলা, নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে প্রায়ই। যতগুলো আছে তার মধ্যে পোষা ইউনিয়নেরই আধিক্য।
গার্মেন্ট শিল্প বিকাশের মধ্য দিয়ে শ্রমিক শ্রেণীর গঠনে লিঙ্গীয় পরিবর্তন উল্লেখযোগ্য মাত্রায় হয়েছে। এ খাতে অধিকাংশ শ্রমিকই নারী। এর বাইরেও বিভিন্ন পেশাতেই নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে। অব্যাহত বঞ্চনা ও নিপীড়ন মোকাবেলা করতে গিয়ে নারী শ্রমিক এক নতুন প্রতিবাদী সামাজিক শক্তিতে পরিণত হয়েছেন। নারী ক্ষমতায়নের বহু গল্প শুনি আমরা, কিন্তু প্রতিদিনের খবরের কাগজে এ শ্রমজীবী নারীর নিরাপত্তাহীনতার, খুন, ধর্ষণ, হয়রানির খবর আসে।
পুঁজির বর্তমান চাহিদা ও বিন্যাসের কারণে বর্তমানে প্রায় সব খাতেই অস্থায়ী, দিনভিত্তিক, খণ্ডকালীন, চুক্তিভিত্তিক, ইনফরমাল বা অপ্রাতিষ্ঠানিক শ্রমজীবী মানুষের সংখ্যাই এখন ক্রমবর্ধমান। অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে শ্রমিকের সংখ্যা সর্বোচ্চ, যারা একেবারেই অসংগঠিত এবং চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে টিকে থাকার চেষ্টাই তাদের জীবন। মে দিবসের মূল যে দাবি ৮ ঘণ্টা কাজ করে বাঁচার মতো মজুরি, তা থেকে বাংলাদেশের সব পর্যায়ের শ্রমিক, মেহনতি মানুষসহ শিক্ষিত মজুররাও অনেক দূরে।
সংগঠিত হওয়ার সুযোগ শিক্ষিত শ্রমজীবী মানুষদের জন্যও খুবই ক্ষীণ। সে কারণে ব্যাংক, বীমা, মিডিয়া, এনজিও, বেসরকারি স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়, ক্লিনিক সর্বত্রই কাজের ও আয়ের নিরাপত্তা দেখা যায় না। এসব প্রতিষ্ঠানে কর্মরত মানুষদের যেকোনো সময় ছাঁটাই করা, তাদের ওপর অন্যায় অবিচারের প্রতিকারের কোনো সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেই। সরকার সর্বত্রই নীরব দর্শক। বিশ্বজুড়ে পুঁজিবাদী দেশগুলোর মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের স্বার্থ দেখায় আইনগত, প্রাতিষ্ঠানিক তদারকি ব্যবস্থায় বাংলাদেশের মতো এতটা নিষ্ক্রিয় সরকার কমই দেখা যায়।
দারিদ্র্য আর বঞ্চনার মধ্যে যে মানুষেরা আছে, তাদের জীবনে কোনো উল্লেখযোগ্য উন্নতি ছাড়াই বাংলাদেশে মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) আর গড় মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি পেয়েছে বহুগুণ। পরিসংখ্যানের চাতুর্য আর গড় হিসাবের প্রতারণায় ঢাকা থাকছে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের জীবনের নির্মমতা। কৃষিতে কৃষকরা, গার্মেন্ট কারখানায় শ্রমিকরা আর প্রবাসী শ্রমিকের রক্ত আর ঘাম দিয়ে তৈরি হচ্ছে প্রবৃদ্ধির উঁচু হার। অন্যদিকে বাণিজ্যিকীকরণের ফলে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার খরচ বেড়ে গেছে। পরিবহন ব্যয়, বাসাভাড়া বেড়েছে। করোনাকালে কাজ ও আয়ের বিপর্যয়ে পড়েছে বেশির ভাগ মানুষ। বিশ্বরেকর্ড করা সব প্রকল্প ব্যয়ের অর্থ জোগাতে সরকারের সর্বব্যাপী সম্পদ সন্ধানে কর ফি, গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বেড়েছে, এতে প্রকৃত আয় কমে গেছে বেশির ভাগ মানুষের। দেশের মানুষের জীবিকা-সংস্থানকে উচ্ছেদ করে, নদী ব্যবস্থা আর বাংলাদেশের প্রাণ-প্রকৃতি পরিবেশকে ধ্বংস করে পুঁজিবাদ বিকাশ প্রক্রিয়ায় জিডিপি বেড়েছে কিন্তু স্থায়ী স্থিতিশীল পরিবেশসম্মত সম্মানজনক কাজের সুযোগ বাড়েনি।
বিশ্বের সব অঞ্চলেই পুঁজির ক্রিয়ার মধ্য দিয়ে তার কাছে শ্রমশক্তি বিক্রির মানুষ, অর্থাৎ মজুরেরও বিস্তার ঘটে সমাজের বিভিন্ন স্তরে বহুদূর। সেজন্য শুধু শিল্প খাতের মধ্যেই শ্রমিক পরিচয় সীমাবদ্ধ রাখলে পুঁজির আধিপত্য ও ক্রিয়ার প্রকৃত চিত্র পাওয়া যায় না। প্রযুক্তি বিকাশের মধ্য দিয়ে শ্রমশক্তি বিক্রেতাদের মধ্যে বহুধরন তৈরি হয়েছে। আপাতদৃষ্টিতে মধ্যবিত্ত কিন্তু সর্বক্ষণ অনিশ্চিত কাজে নিয়োজিত ডিগ্রিপ্রাপ্ত এখন অনেকেই। প্রকৃতপক্ষে শ্রমশক্তি ও মেধাশক্তি পুঁজির কাছে বিক্রি করে উদ্বৃত্ত মূল্য সম্প্রসারণে ভূমিকা রাখছেন এ রকম নারী-পুরুষের সংখ্যাই সমাজে শতকরা ৯৯ ভাগ। ‘আমরা ৯৯%’ স্লোগান দিয়ে বিশ্বজুড়ে এ পরিচয়ই নতুনভাবে নির্মিত হচ্ছে। তাই মে দিবসের লড়াই শুধু কারখানা শ্রমিকের নয়, তথাকথিত মধ্যবিত্ত শিক্ষিত মজুরদেরও লড়াই।
আনু মুহাম্মদ: অর্থনীতিবিদ; জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক; সর্বজনকথা’র সম্পাদক