ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকট

নিজেকে দেউলিয়া ঘোষণা শ্রীলংকার

বণিক বার্তা ডেস্ক

প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসের পদত্যাগের দাবিতে বিক্ষোভরত শ্রীলংকানরা ছবি: রয়টার্স

চরম আর্থিক সংকটের মুখে দ্বীপরাষ্ট্র শ্রীলংকা। খাদ্য, জ্বালানি, জরুরি ওষুধসহ নানা সমস্যায় জর্জরিত দেশটিতে সরকারবিরোধী বিক্ষোভ অব্যাহত রয়েছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে সংসদ সদস্য-মন্ত্রীদের পদত্যাগ, বিরোধীদের নিয়ে ক্ষমতাসীনদের জাতীয় সরকার গঠনের মরিয়া প্রচেষ্টা কোনো কিছুই স্বস্তি বয়ে আনছে না স্বর্ণদ্বীপখ্যাত শ্রীলংকায়। অবস্থায় গতকাল নিজেকে এক প্রকার দেউলিয়া ঘোষণা করে দিয়েছে দেশটি। একতরফাভাবেই বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ স্থগিত ঘোষণা করেছে দেশটির অর্থ মন্ত্রণালয়।

দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক গতকাল এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, বিদ্যমান পরিস্থিতিতে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ অসম্ভব হয়ে পড়েছে। জ্বালানির মতো অপরিহার্য প্রয়োজনীয় উপকরণ আমদানি চালু রাখতে দেশটির রিজার্ভ সংরক্ষণ প্রয়োজন।

শ্রীলংকার রিজার্ভ গত দুই বছরে দুই-তৃতীয়াংশ কমে গেছে। করহ্রাস, কভিড-১৯ মহামারীর কারণে পর্যটননির্ভর অর্থনীতির ক্ষয়ক্ষতি এবং সরকারের উচ্চাভিলাষী প্রকল্প ব্যয়গুলোকে এখন সংকটের জন্য দায়ী করা হচ্ছে। চলমান পরিস্থিতিতে এক মাস ধরে জ্বালানি, বিদ্যুৎ, খাবার ওষুধ সংকটের প্রতিবাদে গোটা শ্রীলংকায় বিক্ষোভ চলছে।

দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর পি নন্দলাল বীরাসিংহে গতকাল সাংবাদিকদের বলেন, বর্তমান অবস্থায় আমাদের অপরিহার্য আমদানির দিকে নজর দিতে হচ্ছে। বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ নিয়ে ভাবার মতো অবস্থা নেই। এটা (বৈদেশিক ঋণ) এখন এমন পর্যায়ে আছে যে ঋণ পরিশোধ চ্যালেঞ্জিং অসম্ভব।

এক বিবৃতিতে শ্রীলংকার অর্থ মন্ত্রণালয় জানায়, ১৯৪৮ সালে যুক্তরাজ্যের কাছ থেকে স্বাধীনতা পাওয়ার পর থেকে শ্রীলংকার ঋণ পরিশোধের নিখুঁত রেকর্ড রয়েছে। তবে সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহে শ্রীলংকার আর্থিক অবস্থানের অবনতি হয়েছে, যাতে বৈদেশিক সরকারি ঋণ পরিশোধের বাধ্যবাধকতা অনুসরণ করা অসম্ভব হয়ে পড়েছে। তাই যেসব বিদেশী সরকার সংস্থা বিভিন্ন সময় শ্রীলংকাকে ঋণ দিয়েছে, তারা চাইলে সে ঋণকে ক্যাপিটালাইজ করতে পারে। অর্থাৎ প্রাপ্য সুদের পরিমাণকে মূলধনের সঙ্গে যোগ করে দিতে পারে অথবা ঋণের অর্থ শ্রীলংকান রুপিতে পরিশোধের বিকল্প বেছে নিতে পারে। জরুরি ভিত্তিতে পণ্য আমদানির জন্য প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ প্রায় শেষ হয়ে আসায় উদ্যোগ নিতে বাধ্য হয়েছে দেশটির সরকার। উদ্যোগকে শেষ ভরসা হিসেবে বিবৃতিতে উল্লেখ করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়, যাতে দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতির আরো অবনতি না হয়। এতে বলা হয়, শ্রীলংকার তাত্ক্ষণিকভাবে নিজেকে ঋণখেলাপি ঘোষণা করার অর্থ হলো আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের সহায়তায় একটি পুনরুদ্ধার কর্মসূচি শুরুর প্রাক্কালে সব ঋণদাতার সঙ্গে ন্যায্য ন্যায়সংগত আচরণ নিশ্চিত করা।

বিবৃতিতে আরো উল্লেখ করা হয়েছে, সরকার এখন জরুরি কিছু পদক্ষেপ নিচ্ছে, যাতে জনগণের আর্থিক অবস্থার আর বড় অবনতি না ঘটে।

এদিকে জরুরি ওষুধ কেনার জন্য বিশ্বব্যাংক ১০ মিলিয়ন ডলার মঞ্জুর করেছে। নবনিযুক্ত অর্থমন্ত্রী আলি সাবরি বিষয়টি নিশ্চিত করে জানিয়েছেন, বিশ্বব্যাংক তাত্ক্ষণিকভাবে জরুরি ওষুধ কেনার জন্য ১০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার অনুদান অনুমোদন দিয়েছে। এক টেলিভিশন অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, বিশ্বব্যাংকের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনার পর এই অনুমোদন দিয়েছে সংস্থাটি। তিনি আরো জানানজরুরি ওষুধ গ্যাসসহ অন্যান্য অপরিহার্য কেনাকাটার জন্য শিগগিরই আরো ৫০ কোটি মার্কিন ডলার অনুদান দেবে।

এছাড়া রাজনৈতিকভাবেও একঘরে হয়ে পড়েছে গোতাবায়া সরকার। অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের জন্য জোটের ১১ সদস্য যারা স্বতন্ত্র হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন, তারা প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। দেশটির সংবাদমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, জাতীয় সরকার গঠনের প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে জোটের ১১ সদস্যকে ডেকেছিলেন প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসে। তবে সে আমন্ত্রণে সাড়া দেননি তারা।

এদিকে সোমবার রাতে টেলিভিশনে ভাষণ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসে। ভাষণে তিনি দেশবাসীকে ধৈর্য ধরতে বলেছেন। তিনি বলেন, মানুষের দুর্দশা লাঘবে সরকার দিনরাত কাজ করছে। আমরা মানুষের ভোগান্তি বুঝতে পেরেছি। আমাদের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করতে হবে। সময় তিনি তামিল বিদ্রোহীদের প্রসঙ্গ টেনে বলেন, আমরা ৩০ বছরের যুদ্ধ যেভাবে শেষ করেছিলাম সেভাবে সমস্যার সমাধান করব।

দেশজুড়ে অব্যাহত বিক্ষোভের মুখে পুরো মন্ত্রিসভা পদত্যাগ করলেও পদ ছাড়েননি প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসে তার ভাই প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসে। তারা সংকট উত্তরণে জাতীয় সরকার গঠনে বিরোধীদের প্রস্তাব দিচ্ছেন। তবে রাজাপাকসে পরিবারের বিরুদ্ধেই দেশজুড়ে বিক্ষোভ অব্যাহত রয়েছে। অবস্থায় মাহিন্দা রাজাপাকসে তার ভাষণে, জনগণকে ধৈর্য ধরার বিক্ষোভ বন্ধ করার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, আপনারা যত বিক্ষোভ করবেন ডলার সংস্থানের ক্ষেত্রে আমাদের তত ক্ষতি হবে।

মাহিন্দা রাজাপাকসে বলেন, সরকার প্রতি সেকেন্ড ব্যয় করছে কীভাবে সমস্যার সমাধান করা যায় তার উপায় বের করতে। আমার পরিবারকে অপবাদ দেয়া হচ্ছে। আমি সেটাও সহ্য করছি। আপনারা সে সংস্কারের দাবি করছেন তা এখন অগ্রাধিকার বিষয় নয়। প্রথম কাজ হলো সংকট উত্তরণ।

তবে পদত্যাগ প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, পার্লামেন্ট প্রত্যাখ্যান করাটা হবে বিপজ্জনক।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন