আলোকপাত

ভারত যেভাবে নাগরিকের তথ্যপ্রাপ্তির অধিকার সামলাচ্ছে

মোহাম্মদ জমির

চলতি মাসে প্রকাশ হয়েছে ভারতের কেন্দ্রীয় তথ্য কমিশনের (সিআইসি) বার্ষিক প্রতিবেদন। প্রতিবেদনের সংক্ষিপ্ত নাম এআর। দেশটির তথ্য অধিকারকর্মী ভেনকাটেশ নায়াক প্রতিবেদন থেকে মজার কিছু বিষয় তুলে ধরেছেন, যা আলোচনার দাবি রাখে।

এআর প্রতিবেদনটি ভারতে ২০০৫ সালে প্রবর্তিত তথ্য অধিকার আইনের ২৫ নং ধারার সঙ্গে সংগতি রেখে প্রস্তুত করা হয়েছে। তাতে সরকারি কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষগুলোর কাছে গৃহীত প্রত্যাখ্যাত আরটিআই আবেদন, প্রথম আবেদন, দ্বিতীয় আবেদনসহ সম্পর্কিত পরিসংখ্যান তুলে ধরা হয়েছে।

খ্যাতিমান বিশ্লেষক নায়াক উল্লেখ করেছেন, প্রতিবেদনটি ইংগিত দেয় যে সিআইসিতে নিবন্ধিত হাজার ২৭৫ কেন্দ্রীয় পর্যায়ের প্রতিষ্ঠানের মধ্যে হাজার ১৮২টি প্রতিষ্ঠান পরিসংখ্যান পেশ করেছে। এটিকে ৯৫ দশমিক ৯১ শতাংশ কমপ্লায়েন্স পরিপালন বলা যেতে পারে।

চমত্কারভাবে এটিও উল্লেখ করা হয়েছে যে ২০১৯-২০ সালের বিপরীতে ২০২০-২১ সালে কেন্দ্রীয় পর্যায়ের নিবন্ধিত সরকারি প্রতিষ্ঠান ৮২টি বাড়লেও সংখ্যা ২০১২-১৩ সালের তুলনায় বেশ কম, যখন হাজার ৩৩৩টি সরকারি প্রতিষ্ঠান সিআইসিতে নিবন্ধিত হয়েছিল। একইভাবে এখানে আরেকটি দিকও আছে, যেটি মনোযোগ আকর্ষণ করা হয়েছে। সেটি হলো আরটিআই আবেদনের বৈদ্যুতিক উপায়ে জমা দেয়ার জন্য স্থাপিত অনলাইন ফ্যাসিলিটি অনুযায়ী সেখানে কেন্দ্রীয়ভাবে হাজার ৪৬৪টি সরকারি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এটা ইংগিত দেয় যে ভারতে আরটিআই আইনের ১৬ বছরের বাস্তবায়ন সত্ত্বেও সব সরকারি কর্তৃপক্ষ আরটিআই-সংশ্লিষ্ট রিটার্ন পূরণের জন্য দায়িত্বশীলতার সঙ্গে সিআইসির নিবন্ধনভুক্ত হচ্ছে না, এমনকি যারা নিবন্ধিত তাদের মধ্যেও সম্পর্কিত তথ্য প্রদানে শৈথিল্য লক্ষণীয়। ২০০-২৮০টি প্রতিষ্ঠান তাদের রিপোর্টিং বাধ্যবাধকতার শর্ত পূরণ করে না।

উল্লেখ করা দরকার যে, ২০২০-২১ সাল একটি অতিমারীর বছর। সময় করোনা সংক্রমণ ঠেকাতে লকডাউন আরোপ করা হয় এবং প্রতিষ্ঠানগুলোকেও ওয়ার্ক ফ্রম হোমের কথা বলা হয়। ব্যবস্থা কয়েকশ সরকারি প্রতিষ্ঠানের নৈপুণ্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। কাজেই সবর্শেষ এআর প্রতিবেদনের ক্ষেত্রে অবশ্যই মাথায় রাখতে হবে।

তবু মজার বিষয় হলো, এআর প্রতিবেদনের তথ্যানুযায়ী ২০২০-২১ সালে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোয় তথ্যের জন্য আবেদনপ্রাপ্তির সংখ্যা ২০১৯-২০ সালের তুলনায় কেবল দশমিক ৯৫ শতাংশ কম ছিল। এটা খুব সামান্য অবনমন আগের বছরের তুলনায়২০০৫ সালে আরটিআই বাস্তবায়নের পর থেকে যে বছর রেকর্ড সর্বোচ্চ আবেদন জমা পড়েছিল। উল্লেখ করা যেতে পারে যে, ওই প্রতিবেদনে উপস্থাপিত তথ্য ইউনিয়ন টেরিটরিজ (ইউটি) প্রশাসন থেকে আসা আরটিআই আবেদনের পরিসংখ্যানও অন্তর্ভুক্ত। থেকে মনে হয় ২০২০-২১ সালে আরটিআই আবেদনের সংখ্যা হ্রাস তেমন তাত্পর্যজনক কোনো বিষয় নয় এবং এক্ষেত্রে অতিমারী বড় কোনো বিপর্যয়কারী হিসেবেও প্রমাণ হয়নি। বরং তার পরিবর্তে ইংগিত মেলে যে, আগের চেয়ে অনেক বেশি বিভিন্ন মন্ত্রণালয় থেকে সাধারণ নাগরিকরা তথ্য চাওয়ার ব্যাপারে আগ্রহী হয়েছে।

তবে মজার বিষয় হলো, অতিমারী বছরে আরটিআই আবেদন পাওয়ার সংখ্যা সবচেয়ে বেশি কমেছে অর্থ মন্ত্রণালয় করপোরেট বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে। আগের বছরের তুলনায় ২০২০-২১ সালে অর্থ মন্ত্রণালয়ে আবেদন জমা কম পড়েছে ২১ হাজার ৬৫৭টি এবং করপোরেট-বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে কম পড়েছে ২০ হাজার ২৭৯টি। অতিমারী বছরে এক হাজারের বেশি আবেদন কম পড়া অন্য মন্ত্রণালয়গুলোর মধ্যে রয়েছে রেলপথ মন্ত্রণালয় (১৭ হাজার ৯৮৬), মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রণালয় ( হাজার ৭১১) এবং প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ( হাজার ৮১২) অন্তত হাজার আবেদন কম পাওয়া আরো কিছু মন্ত্রণালয়ের মধ্যে আছে তেল প্রাকৃতিক গ্যাস মন্ত্রণালয় ( হাজার ৩৬৪), কৃষি কৃষক কল্যাণ মন্ত্রণালয় ( হাজার ৬৮৭), সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় ( হাজার ৩৫৫), পরিবেশ বন মন্ত্রণালয় ( হাজার ৮৮৭), মহাকাশ বিভাগ ( হাজার ৫৫০), দক্ষতা উন্নয়ন উদ্যোগ মন্ত্রণালয় ( হাজার ২৭৪) এবং যুব ক্রীড়াবিষয়ক মন্ত্রণালয় ( হাজার ২৩০)

এক্ষেত্রে নায়াক এটিও তাত্পর্যপূর্ণভাবে উল্লেখ করেছেন যে, আগের বছরের তুলনায় ২০২০-২১ সালে সুপ্রিম কোর্ট হাজার ১১টি আরটিআই আবেদন কম পেয়েছে। একইভাবে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়েও আগের বছরের চেয়ে মোট ৫৫২টি আবেদন কম জমা পড়েছে। ভারতের রাষ্ট্রপতি ভবনেও অতিমারী বছরে ৪৬১টি আবেদন কম জমা পড়েছে।

অবশ্য অতিমারী বছরে আরটিআই আবেদন জমা পড়ার নিম্নমুখী প্রবণতার মধ্যেও কিছু মন্ত্রণালয় বিভাগে আগের বছরের তুলনায় ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতার কথা জানিয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ে আগের বছরের (৩৩ হাজার ৭৩৩ আবেদন) চেয়ে ২০২০-২১ সময়ে (৬০ হাজার ৪২৩) আরটিআই আবেদন ৭৯ দশমিক শতাংশ বেড়েছে। আরো কয়েকটি মন্ত্রণালয় সরকারি প্রতিষ্ঠানেও আরটিআই আবেদন জমা প্রদানের হার বেড়েছে। যেমন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে বেড়েছে ৪৮ দশমিক ১১ শতাংশ, শ্রম কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ে বেড়েছে ৪১ দশমিক ১৮ শতাংশ, ইলেকট্রনিকস তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ে বেড়েছে ৩৩ দশমিক ৩৭ শতাংশ, বেসামরিক পরিবহন মন্ত্রণালয়ে বেড়েছে ৩৩ দশমিক ৯৪ শতাংশ, তথ্য সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ে বেড়েছে ১৩ দশমিক ৯৫ শতাংশ, নারী শিশু উন্নয়ন মন্ত্রণালয়ে বেড়েছে ১০ দশমিক ৯০ শতাংশ, মিনিস্ট্রি অব পারসোনেল, পাবলিক গ্রিভেন্সেস অ্যান্ড পেনশনসে বেড়েছে ১০ দশমিক ৩০ শতাংশ, আইন বিচার মন্ত্রণালয়ে বেড়েছে দশমিক ৬৭ শতাংশ, কয়লা মন্ত্রণালয়ে বেড়েছে দশমিক শতাংশ, বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ে বেড়েছে দশমিক ৪১ শতাংশ, সামাজিক ন্যায়বিচার ক্ষমতায়ন মন্ত্রণালয়ে বেড়েছে দশমিক ৪০ শতাংশ, গৃহায়ন নগরবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে বেড়েছে দশমিক ১২ শতাংশ এবং বিজ্ঞান প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ে বেড়েছে দশমিক শতাংশ। আরটিআই আবেদন জমা দেয়ার হার বাড়ায় আরো কিছু সরকারি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে দিল্লি হাইকোর্ট (৪২ দশমিক ৯৭ শতাংশ), ভারতীয় বিমান বাহিনী কার্যালয়ে (৪০ দশমিক ৭০ শতাংশ) এবং মন্ত্রিপরিষদ সচিবালয়ে ( দশমিক ৬৫ শতাংশ) বলতে গেলে এসব বেশ লক্ষণীয় অগ্রগতি বৈকি।

এদিকে আরটিআই আবেদন প্রসেসিংয়ে অব্যাহত অচলাবস্থার একটি প্রবণতা বিরাজমান। এআর প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে নায়াক উল্লেখ করেছেন যে, অতিমারী বছরের (২০২০-২১) শুরুতে লাখ ৪৮ হাজার আরটিআই আবেদন প্রসেসিং স্থগিত থেকেছে। এটি ২০১৮-১৯ সাল থেকে ২০১৯-২০২০ সালে স্থগিত হওয়া আবেদনের চেয়ে ১২ দশমিক ৪৫ শতাংশ বেশি। সবচেয়ে বেশি আবেদন স্থগিত থেকেছে ভারতীয় সেনাবাহিনীতে। প্রতিষ্ঠানটিতে স্থগিত হয়েছে সর্বোচ্চ লাখ হাজার ৬০১টি আবেদন। মজার বিষয় হলো, নায়াক পর্যবেক্ষণ করেছেন যে, তথ্য সঠিক আছে কি নেই সেই সন্দেহের দোহাই তুলে আগের বছরেও প্রতিষ্ঠানটিতে প্রায় সমপরিমাণ আবেদন স্থগিত করা হয়েছে। স্থগিতাবস্থার এর পরের ধাপে রয়েছে মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ে ২০২০-২১ সালে ৬২ হাজার ৬৮২টি আবেদন স্থগিত হয়েছে, আগের বছরে যা ছিল ৫০ হাজার ৮৮৭টি। এর পরের অবস্থান গৃহায়ন নগরবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের। মন্ত্রণালয়ে আগের বছরের ২৮ হাজার ৫১৫টির বিপরীতে ২০২০-২১ সালে স্থগিত হয়েছে ৩৫ হাজার ৬২৬টি আবেদন। চতুর্থ অবস্থানে থাকা শ্রম কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ে আগের বছরে হাজার ৩৫৫টি আবেদনের বিপরীতে ২০২০-২১ সালে স্থগিত হয়েছে হাজার ৭৯০টি আবেদন। আর পঞ্চম অবস্থানে থাকা সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ে আগের বছরে হাজার ৮৫০টি আবেদনের বিপরীতে ২০২০-২১ সালের অতিমারী বছরে স্থগিত হয়েছে হাজার ২৮২টি আবেদন।

অবশ্য স্থগিতাবস্থার বিষয়টি ভালোভালো এবং খুব সতর্কতার সঙ্গে সামলাতে পেরেছে রেলপথ মন্ত্রণালয়। মাত্র হাজার ৪৪৩টি স্থগিত আবেদন নিয়ে ২০২০-২১ সালে আলোচ্য মন্ত্রণালয় প্রায় তিন-চতুর্থাংশ স্থগিতাবস্থা কমাতে পেরেছে। আগের বছরে যেখানে আবেদনের সংখ্যা ছিল ১৩ হাজার ১৯৩। একইভাবে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়েও স্থগিতাবস্থার হার কমে এসেছে। আগের বছরে যেখানে হাজার ৬২৮টি আরটিআই আবেদন স্থগিত ছিল, ২০২০-২১ সময়ে সেটি কমে হাজার ৯৭২তে নেমে এসেছে।

নায়াক এবং অন্য বিশ্লেষকরাযারা ওয়েব পোর্টালে সিআইসি-এআর প্রতিবেদন খতিয়ে দেখেছেআরেকটা স্পর্শকাতর বিষয়ও সামনে এনেছেন। সেটি হলো অতিমারী বছরে পেশকৃত আবেদনের সংখ্যা এবং সংগৃহীত আবেদন ফির পরিমাণের মধ্যে বড় অসংগতি দৃশ্যমান। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে আরটিআই অ্যাপ্লিকেশনের ট্রান্সফারের কারণে এটা হয়ে থাকতে পারে। দেখা যাচ্ছে, ভারতীয় তথ্য অধিকার আইনের () নং ধারার অধীন হস্তান্তরিত হওয়া আরটিআই আবেদনকে প্রতিটি সরকারি প্রতিষ্ঠান নতুন আবেদন হিসেবে বিবেচনা করে এবং সেটিকে মোট সংখ্যার সঙ্গে যোগ করে।

অন্য কথায় বলতে গেলে, একই আরটিআই আবেদন সরকারি কর্তৃপক্ষগুলোর মধ্যে যতবারই হস্তান্তরিত হয় তার ওপর ভিত্তি করে সেগুলোকে ততবারই গণনা করা হয়ে থাকতে পারে। তদুপরি একই সরকারি প্রতিষ্ঠানে এক সিপিআইও থেকে আরেক সিপিআইওর কাছে ফরওয়ার্ডের ক্ষেত্রেও দ্বৈত গণনা হয়ে থাকতে পারে। এটা সত্যি হলে মোট সংখ্যাও স্বাভাবিকভাবে বড় দেখাবে। কাজেই এসব বিষয় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে খুব যত্নের সঙ্গে খতিয়ে দেখতে হবে।

আমি আশা করি যে আমাদের তথ্য কমিশন এবং দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশের তথ্য কমিশনও উল্লিখিত ভারতীয় তথ্য কমিশনের প্রতিবেদনটি ভালো করে পড়বে এবং পরবর্তী বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশের আগে প্রয়োজনীয় তথ্য বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে অত্যাবশ্যকীয় সতর্কতা অবলম্বন করবে। সর্বোপরি আরো গঠনমূলক ভবিষ্যৎ বিনির্মাণে পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়ামূলক সম্পৃক্ততা বাড়ানোর উদ্যোগ তারা নেবে।

 

মোহাম্মদ জমির: সাবেক রাষ্ট্রদূত সাবেক প্রধান তথ্য কমিশনার

[email protected]

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন