আতঙ্কে শেয়ার বিক্রি করছেন সাধারণ বিনিয়োগকারী, দ্বিধায় প্রাতিষ্ঠানিকরা

নিজস্ব প্রতিবেদক

বাংলাদেশ থেকে সাড়ে তিন হাজার মাইলেরও বেশি দূরত্বে থাকলেও ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের আঁচ ভালোই টের পাওয়া যাচ্ছে দেশের পুঁজিবাজারে। গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণের পর থেকেই অস্থির হয়ে উঠেছে দেশের পুঁজিবাজার। সময়ে প্রায় ৫০০ পয়েন্ট হারিয়েছে সূচক। একদিকে আতঙ্কে শেয়ার বিক্রি করছেন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা, অন্যদিকে তারল্য সংকটসহ বিভিন্ন কারণে দ্বিধাদ্বন্দ্বের মধ্যে রয়েছে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা।

বাজার বিশ্লেষণে দেখা যায়, গতকাল লেনদেন শুরুর পর থেকেই বিনিয়োগকারীদের শেয়ার বিক্রির চাপে পয়েন্ট হারাতে থাকে সূচক। মাঝে কিছুটা ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলেও শেষ পর্যন্ত সূচকের পতনের মধ্য দিয়ে পুঁজিবাজারে লেনদেন শেষ হয়েছে। গতকাল দিন শেষে ১৮২ পয়েন্ট বা দশমিক ৭৪ শতাংশ কমে হাজার ৪৫৭ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে ডিএসইএক্স। আগের কার্যদিবসে যা ছিল হাজার ৬৩৯ পয়েন্টে। এটি বছরে পুঁজিবাজারে একদিনে সবচেয়ে বড় দরপতন। ফলে সাত মাস আগের অবস্থানে ফিরে গেছে সূচক। গতকাল সূচকের পতনে সবচেয়ে বেশি অবদান ছিল বেক্সিমকো লিমিটেড, স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস, ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো বাংলাদেশ কোম্পানি (বিএটিবিসি), বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস লাফার্জহোলসিম বাংলাদেশের শেয়ারের।

বাজারসংশ্লিষ্টরা বলছেন, ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের কারণে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের  ক্রমবর্ধমান মূল্যবৃদ্ধি, দেশের মূল্যস্ফীতি পরিস্থিতিসহ বেশকিছু ইস্যুতে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আতঙ্ক কাজ করছে। কারণে গতকাল বিনিয়োগকারীদের মধ্যে যেকোনো মূল্যে শেয়ার বিক্রি করে দেয়ার প্রবণতা দেখা গেছে। অন্যদিকে তারল্য সংকটসহ বিভিন্ন কারণে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগ সক্ষমতায় ঘাটতি রয়েছে। ফলে প্রয়োজনের সময় অনেক ক্ষেত্রেই তারা বাজারকে সহায়তা করতে পারছে না। এর মধ্যেও কিছু প্রতিষ্ঠান পড়তি বাজারে বিনিয়োগ করছে। অন্যদিকে কেউ কেউ নিষ্ক্রিয় থেকে পরবর্তী পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে।

পুঁজিবাজারের দরপতনের পরিপ্রেক্ষিতে গতকাল বাজারসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রধান নির্বাহীরা নিজেদের মধ্যে পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করেছেন। সেখানে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের সক্ষমতা ঘাটতির বিষয়টি উঠে আসে। এক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় তহবিলের জোগান দিয়ে প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতা বাড়ানোর বিষয়ে গুরুত্বারোপ করা হয়।

জানতে চাইলে ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশনের (ডিবিএ) প্রেসিডেন্ট রিচার্ড ডি রোজারিও বণিক বার্তাকে বলেন, বিদ্যমান বাজার পরিস্থিতিতে করণীয় নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা দ্বিধাদ্বন্দ্বের মধ্যে রয়েছেন। এর কারণ হচ্ছে আমাদের কাছে বিনিয়োগের জন্য পর্যাপ্ত তহবিলের সংকট রয়েছে। বর্তমান বাজার পরিস্থিতিতে বিনিয়োগকারীদের আতঙ্ক দূর করতে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ বাড়ানো প্রয়োজন। এজন্য পুঁজিবাজারের প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের তহবিল সরবরাহ করতে হবে। পাশাপাশি বাড়াতে হবে রাষ্ট্রায়ত্ত বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশের (আইসিবি) সক্ষমতাও। বাজারের আকার বিবেচনায় আইসিবির মতো আরো কিছু প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার প্রয়োজন রয়েছে। বাজারের ক্রান্তিকালে মিউচুয়াল ফান্ডগুলো সহায়তা করে থাকে। কিন্তু আমাদের এখানে মিউচুয়াল ফান্ডগুলো সেভাবে ভূমিকা রাখতে পারছে না। ফান্ডগুলো যাতে পুঁজিবাজারে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে সেটিও নিশ্চিত করতে হবে।

ডিএসইর ব্লু-চিপ সূচক ডিএস-৩০ গতকাল ৬৪ পয়েন্ট কমে হাজার ৩৭৪ পয়েন্ট দাঁড়িয়েছে। আগের দিন শেষে যা ছিল হাজার ৪৩৯ পয়েন্টে। শরিয়াহ সূচক ডিএসইএস গতকাল দিন শেষে প্রায় ৩৭ পয়েন্ট কমে হাজার ৩৯৪ পয়েন্টে অবস্থান করছে। আগের দিন শেষে যা ছিল হাজার ৪৩১ পয়েন্টে।

ডিএসইতে গতকাল ৭৪০ কোটি টাকার শেয়ার লেনদেন হয়েছে। যেখানে আগের কার্যদিবসে লেনদেন ছিল ৬৫১ কোটি টাকা। এদিন ডিএসইতে লেনদেন হওয়া ৩৭৯টি কোম্পানি, মিউচুয়াল ফান্ড করপোরেট বন্ডের মধ্যে দিন শেষে দর বেড়েছে মাত্র ৭টির, কমেছে ৩৬৪টির আর অপরিবর্তিত ছিল ৮টি সিকিউরিটিজের বাজারদর।

খাতভিত্তিক লেনদেনচিত্রে দেখা যায়, গতকাল ডিএসইর মোট লেনদেনের ১৩ শতাংশ দখলে নিয়ে শীর্ষে অবস্থান করছে বস্ত্র খাত। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১২ দশমিক শতাংশ দখলে নিয়েছে ওষুধ রসায়ন খাত। ১০ দশমিক শতাংশ লেনদেনের ভিত্তিতে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে বিবিধ খাত। চতুর্থ অবস্থানে থাকা প্রকৌশল খাতের দখলে ছিল লেনদেনের দশমিক শতাংশ। এছাড়া ব্যাংক খাতের দখলে ছিল মোট লেনদেনের দশমিক শতাংশ। গতকাল সব খাতের শেয়ারেই নেতিবাচক রিটার্ন এসেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি দশমিক শতাংশ নেতিবাচক রিটার্ন ছিল সিমেন্ট খাতে।

ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের পাশাপাশি বছরের মধ্যে হাজার কোটি টাকারও বেশি ঋণাত্মক ইকুইটির সমন্বয়ে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) নির্দেশনার কারণে বাজারে কিছুটা নেতিবাচব প্রভাব পড়েছে। এতে গত মাসে বেশকিছু ফোর্সড সেল হয়েছে। অবস্থায় বিনিয়োগকারীদের শঙ্কা দূর করতে ঋণাত্মক ইকুইটি সমন্বয়ের সময়সীমা ২০২৩ সাল পর্যন্ত বাড়িয়েছে কমিশন।

বিদ্যমান বাজার পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক মুখপাত্র মোহাম্মদ রেজাউল করিম বণিক বার্তাকে বলেন, ইউক্রেন-রাশিয়া সংঘাত ছাড়া অন্য যেসব বিষয় বাজারে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে বলে মনে করা হচ্ছে কমিশন সেগুলো প্রশমনের উদ্যোগ নিয়েছে। প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের তারল্য সংকট দূর করতে কমিশন কাজ করছে। ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো যাতে নির্ধারিত সীমার মধ্যে থেকে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ বৃদ্ধি করে সে বিষয়েও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে কাজ চলছে। আশা করছি বাজার দ্রুতই ঘুরে দাঁড়াবে। এজন্য বিনিয়োগকারীদের আতঙ্কিত না হয়ে দীর্ঘমেয়াদে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।

ডিএসইতে গতকাল লেনদেনের শীর্ষে থাকা কোম্পানিগুলো হলো বেক্সিমকো লিমিটেড, বিএসসি, বিএটিবিসি, ওরিয়ন ফার্মা, ফরচুন সুজ, লাফার্জহোলসিম বাংলাদেশ, ডেল্টা লাইফ ইন্স্যুরেন্স, সাইফ পাওয়ারটেক, স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস ইউনিয়ন ব্যাংক।

এক্সচেঞ্জটিতে গতকাল দর বৃদ্ধির শীর্ষে থাকা কোম্পানিগুলোর মধ্যে রয়েছে বিডি কম, তমিজ উদ্দিন টেক্সটাইল, এডিএন টেলিকম, ডাচ-বাংলা ব্যাংক, রবি আজিয়াটা, পদ্মা অয়েল প্রাইম ফাইন্যান্স ফার্স্ট মিউচুয়াল ফান্ড।

অন্যদিকে গতকাল ডিএসইতে দরপতনের শীর্ষে থাকা কোম্পানিগুলোর মধ্যে রয়েছে মেঘনা কনডেন্সড মিল্ক, আরামিট সিমেন্ট, ভ্যানগার্ড এএমএল রূপালী ব্যাংক ব্যালান্সড ফান্ড, এনভয় টেক্সটাইল, এপেক্স স্পিনিং, জুট স্পিনার্স, এশিয়া ইন্স্যুরেন্স, কপারটেক, এএফসি এগ্রো ইমাম বাটন।

দেশের আরেক পুঁজিবাজার চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) প্রধান সূচক সিএসসিএক্স গতকাল ২৭২ পয়েন্ট কমে ১১ হাজার ২৯৬ পয়েন্টে অবস্থান করছে। আগের কার্যদিবসে সূচকটির অবস্থান ছিল ১১ হাজার ৬৬৮ পয়েন্টে। সিএসইর সব শেয়ারের সূচক সিএএসপিআই গতকাল ৪৫৫ পয়েন্ট কমে ১৮ হাজার ৯৮৯ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে। এর আগের কার্যদিবসে সূচকটির অবস্থান ছিল ১৯ হাজার ৪৪৪ পয়েন্টে। এদিন এক্সচেঞ্জটিতে লেনদেন হওয়া ২৯৪টি কোম্পানি মিউচুয়াল ফান্ডের মধ্যে দর বেড়েছে ১৯টির, কমেছে ২৫৪টির আর অপরিবর্তিত ছিল ২১টির বাজারদর। গতকাল সিএসইতে মোট ২০ কোটি ৭০ লাখ টাকার সিকিউরিটিজ হাতবদল হয়েছে, আগের কার্যদিবসে যা ছিল ১৭ কোটি ৮০ লাখ টাকা।

বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমবিএ) প্রেসিডেন্ট মো. ছায়েদুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, গতকাল পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীদের আতঙ্কিত হয়ে শেয়ার বিক্রি করতে দেখা গেছে। কিন্তু এই অহেতুক আতঙ্কের কোনো যৌক্তিকতা দেখছি না আমি। ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী-নির্ভর পুঁজিবাজার হওয়ার কারণে তাদের কাছ থেকে যখন অনেক বেশি বিক্রয় চাপ আসে তখন সেটির বড় প্রভাব পড়তে দেখা যায়। প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা বিদ্যমান পরিস্থিতি তাদের ব্যবসায়িক কৌশল অনুসারে বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। আশা করছি আজ থেকেই পুঁজিবাজার ঘুরে দাঁড়াবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন