নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম রেকর্ড উচ্চতায় পৌঁছেছে। ডলারের ঘাটতি মোকাবেলায় সংকোচন করা হয়েছে আমদানি। সাম্প্রতিক ভূরাজনৈতিক উত্তেজনায় পর্যটন ও রফতানি বাজারও সীমাবদ্ধ হয়েছে। মুশকিল হয়ে পড়েছে পর্বতসম বৈদেশিক ঋণের অর্থ পরিশোধ করা। এ অবস্থায় জ্বালানি তেলের উচ্চমূল্য খাদের কিনারে থাকা শ্রীলংকার অর্থনৈতিক সংকটকে আর প্রকট করে তুলেছে।
এপির খবরে বলা হয়েছে, এরই মধ্যে দেশটির যানবাহনের ট্যাংকারগুলো খালি হয়ে গেছে। বিদ্যুৎ বিভ্রাট শিক্ষার্থীদের অধ্যয়ন থেকে বঞ্চিত করছে। জ্বালানি সংকটে বন্ধ রাখা হচ্ছে শপিংমলের শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা। জ্বালানি তেলের দাম ব্যারেলপ্রতি ১২০ ডলারের কাছাকাছি চলে যাওয়ায় শ্রীলংকার অর্থনীতি এমন গভীর সংকটে পড়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
বৈদেশিক মুদ্রার অভাবের কারণে দক্ষিণ এশীয় দ্বীপ দেশটিতে কর্তৃপক্ষ গাড়ি ও সার আমদানি সীমাবদ্ধ করেছিল। এখন অর্থনীতিকে চলমান রাখতে প্রয়োজনীয় জ্বালানি তেল কিনতে আরো বেশি অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে। ফলে ডলারের ক্রমহ্রাসমান মজুদ নিঃশেষের দিকে যাচ্ছে। বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোয় পর্যাপ্ত জ্বালানি সরবরাহ করতে না পারায় কর্তৃপক্ষ দিনে সর্বোচ্চ সাড়ে ৭ ঘণ্টা পর্যন্ত দেশজুড়ে বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন রাখতে বাধ্য হচ্ছে। বিকল্প জ্বালানি হাইড্রো পাওয়ার প্রায়ই শুষ্ক মৌসুমে কম উৎপাদিত হয়। মে মাসে মৌসুমি বৃষ্টির মাধ্যমে এ জ্বালানির উৎপাদন শুরু হয়।
শ্রীলংকার পাবলিক ইউটিলিটি কমিশনের চেয়ারম্যান জনকা রত্নায়েকে সাংবাদিকদের বলেন, আমরা চাহিদা অনুযায়ী ডিজেল, ন্যাপথা ও ফার্নেস অয়েল পাচ্ছি না। এ পরিস্থিতিতে আমরা বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন রাখতে বাধ্য হচ্ছি।
জ্বালানি সংকটের কারণে দেশটির পরিবহন খাতও স্থবিরতার মুখে পড়েছে। লাখ লাখ শ্রমিক নিয়োজিত পরিবহন পরিষেবায়। ডিজেলের অভাবে বাসগুলো কখনো কখনো মাঝপথেই থেমে যাচ্ছে। সাতটি যাত্রীবাহী বাসের মালিক রবীন্দ্র মেন্ডিস বলেন, জ্বালানি সংকটের কারণে এরই মধ্যে আমার চারটি বাস বন্ধ করে দিয়েছি। ডিজেলের ঘাটতি আমাদের ভয়াবহ সংকটে ফেলে দিয়েছে।
শ্রীলংকার জ্বালানিমন্ত্রী উদয়া গাম্মানপিলা বলেন, উচ্চ জ্বালানি তেলের দাম প্রকৃতপক্ষে বৈদেশিক মুদ্রার সংকটে অতিরিক্ত বোঝা তৈরি করেছে। যানবাহন ও পাওয়ার জেনারেটরের জন্য বাড়িতে ডিজেল মজুদ করা ঠেকাতে জ্বালানি কেনার সীমাও বেঁধে দেয়া হয়েছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, অবকাঠামো প্রকল্পের জন্য নেয়া বিদেশী ঋণ ফেরত দিতে লড়াই করছে শ্রীলংকা। আর এ প্রকল্পগুলো থেকে সরাসরি আয়ের পথও নেই। এ অবস্থায় চলতি বছরের ৭০০ কোটি ডলারের বৈদেশিক ঋণের মধ্যে আগামী জুলাইয়ে ১০০ কোটি ডলার পরিশোধ করতে হবে। ডলারের রিজার্ভ কম থাকায় ব্যাংকগুলো গুঁড়ো দুধ, ওষুধ ও জ্বালানির মতো প্রয়োজনীয় পণ্যগুলোর আমদানির জন্য এলসি খুলতে চাচ্ছে না।
উদয়া গাম্মানপিলা বলেন, অর্থ প্রদানের জন্য জ্বালানিভর্তি জাহাজগুলো পণ্য খালাসের অপেক্ষায় আছে। এ বিলম্বের কারণে সীমিত মজুদ বাজারে ছাড়া হচ্ছে এবং জ্বালানি তেল স্টেশনগুলোয় বিক্রি সীমাবদ্ধ করা হয়েছে। আমাদের সংকট মূলত জ্বালানি কিংবা বিদ্যুৎ উৎপাদনের নয়। আমরা আসলে বৈদেশিক মুদ্রার সংকটে আছি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ভারত থেকে প্রত্যাশিত ১০০ কোটি ডলারের ঋণ অর্থনৈতিক সংকটকে কিছুটা সহজ করতে পারে। তবে ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসন বৈদেশিক মুদ্রার গুরুত্বপূর্ণ উৎস ঝুঁকিতে পড়েছে। ইউক্রেনীয় ও রুশ পর্যটকরা দেশটির বৈদেশিক মুদ্রার গুরুত্বপূর্ণ একটি উৎস।
রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিকবিষয়ক বিশ্লেষক রাঙ্গা কালানসুরিয়া বলেন, শ্রীলংকার চা ও পর্যটনের জন্য ইউক্রেন ও রাশিয়া উভয়ই গুরুত্বপূর্ণ বাজার। দুই দেশের যুদ্ধের কারণে এ পথও বন্ধ হয়ে গেছে। প্রকৃতপক্ষে আমরা এরই মধ্যে আগুনে ঝাঁপ দিয়ে ফেলেছি এবং পরিস্থিতি কোথায় নিয়ে যাবে তা আমরা কেউ জানি না।
এ বিষয়ে শ্রীলংকার বাণিজ্য ও শিল্প সমিতির জোট সিলন চেম্বার অব কমার্সের প্রধান অর্থনীতিবিদ শিরান ফার্নান্দো বলেন, এ পরিস্থিতি বড় উদ্বেগের। কারণ বেশির ভাগ ব্যবসায়ের জন্য ব্যয় বেড়েছে। ছোট থেকে বড় কোনো প্রতিষ্ঠানই এ সংকটের বাইরে নেই।