পাইওনিয়ার ইন্স্যুরেন্সের শেয়ার কারসাজি

বিএসইসির তদন্তেও এনআরবি ব্যাংকের সম্পৃক্ততার প্রমাণ মিলেছে

নিজস্ব প্রতিবেদক

পাইওনিয়ার ইন্স্যুরেন্সের শেয়ার কারসাজির সঙ্গে জড়িত থাকার দায়ে এনআরবি ব্যাংককে ৪৯ লাখ ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এরপর গত নভেম্বরে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) পক্ষ থেকেও পুঁজিবাজারে ব্যাংকটির বিনিয়োগে যে সিকিউরিটিজ আইন লঙ্ঘন হয়েছে, সেটি খতিয়ে দেখতে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিশনের তদন্তেও শেয়ার কারসাজির সঙ্গে ব্যাংকটির সম্পৃক্ততার প্রমাণ পাওয়া গেছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ব্যাংকটির ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকিং ইউনিটের সব সদস্যসহ প্রধান অর্থ কর্মকর্তার (সিএফও) বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছে কমিশন।

এনআরবি ব্যাংক নির্ধারিত সীমার বাইরে গিয়ে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করেছে। তদন্তে এর সত্যতা পাওয়ায় ব্যাংকটিকে জরিমানা করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। অন্যদিকে একজন বিনিয়োগকারী কমিশনের কাছে ব্যাংকটির ধরনের কর্মকাণ্ডের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন বলে অভিযোগ করেন। কারণে ব্যাংকটির পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে কোনো ধরনের সিকিউরিটিজ আইন লঙ্ঘন করেছে কিনা, সেটি খতিয়ে দেখার জন্য গত বছরের নভেম্বর একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে বিএসইসি। বিএসইসির অতিরিক্ত পরিচালক মোহাম্মদ গোলাম কিবরিয়াকে প্রধান করে গঠিত কমিটির অন্য দুই সদস্য হলেন বিএসইসির উপপরিচালক মো. সিরাজুল ইসলাম ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) উপব্যবস্থাপক গিয়াস উদ্দীন। কমিটিকে ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়।

সম্প্রতি কমিটি তাদের তদন্ত প্রতিবেদন কমিশনের কাছে জমা দিয়েছে। তদন্তে এনআরবি ব্যাংকের সিএফও কামরুল হাসান বহিরাগতদের সহযোগিতায় অনৈতিক ব্যবসায়িক কার্যকলাপে জড়িত ছিলেন বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে। তার নিয়মবহির্ভূত কর্মকাণ্ডের কারণে ব্যাংকটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং বহিরাগতসহ তিনি লাভবান হয়েছেন। তাই তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নিতে সুপারিশ করে বিএসইসির তদন্ত কমিটি। সিএফওর পাশাপাশি এনআরবি ব্যাংকের ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকিং ইউনিটের সব সদস্য অন্য কর্মকর্তাদের ক্ষেত্রে শেয়ার কারসাজির দায় খুঁজে পেয়েছে তদন্ত কমিটি। অর্পিত দায়িত্ব যথাযথ পালন করতে ব্যর্থ হয়েছেন তারা। কারণে তাদের বিরুদ্ধেও বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা হয়েছে।

বহিরাগতদের কাছে ব্যাংকের নথি ফাঁস করার সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করেছে বিএসইসির কমিটি। এক্ষেত্রে ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদ, ব্যবস্থাপনা বিনিয়োগ কমিটি তাদের অভ্যন্তরীণ অডিট রিপোর্ট পরিচালনা পর্ষদের সভার কার্যবিবরণীর গোপনীয়তা সংরক্ষণে ব্যর্থ হয়েছে বলে মনে করছে কমিটি।

বিএসইসি সূত্রে জানা গেছে, তদন্তে পাওনিয়ার ইন্স্যুরেন্সের শেয়ারে আইন লঙ্ঘন করে বিনিয়োগের প্রমাণ পাওয়া গেছে। এর সঙ্গে জড়িতদের বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে বিষয়টি কমিশনের এনফোর্সমেন্ট বিভাগের কাছে পাঠানো হয়েছে। তারা আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করে সংশ্লিষ্টদের শাস্তি নিশ্চিত করবে।  পাশাপাশি তদন্তে যাদের সংশ্লিষ্টটা পাওয়া গেছে, তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য এনআরবি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের কাছে চিঠি পাঠানো হয়েছে। এক্ষেত্রে ব্যাংক কর্তৃক কী ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে, সেটি ২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে কমিশনকে অবহিত করতে বলা হয়েছে।

বিষয়ে জানতে চাইলে বিএসইসির কমিশনার অধ্যাপক . শেখ শামসুদ্দিন আহমেদ বণিক বার্তাকে বলেন, আমাদের তদন্তে যাদের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে, তাদের বিরুদ্ধে এনফোর্সমেন্ট বিভাগের মাধ্যমে ব্যবস্থা নেয়ার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। পাশাপাশি জড়িতদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নিতে ব্যাংকটিকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

শেয়ার কারসাজির সঙ্গে ব্যাংকটির পর্ষদের সংশ্লিষ্টতা দায় রয়েছে কিনা এবং থাকলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, যাদের বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ পাওয়া যাবে, তাদেরই শাস্তির আওতায় আনা হবে।

২০২০ সালের জুন থেকে ২০২১ সালের জুন সময়ে পাইওনিয়ার ইন্স্যুরেন্সের শেয়ারদর অস্বাভাবিক হারে বাড়ে। এতে এনআরবি ব্যাংক জড়িত বলে প্রমাণ পেয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। পাইওনিয়ার ইন্স্যুরেন্সের শেয়ারদর ২০২১ সালের ১৪ জুন ২১৫ টাকায় ওঠে, যা এক বছর আগেও ছিল ২৯ টাকা। সময়ে বীমা কোম্পানিটির শেয়ারদর বেড়েছে সাত গুণের বেশি। পরবর্তী সময়ে বিষয়ে তদন্ত শুরু হলে এনআরবি ব্যাংক পাইওনিয়ার ইন্স্যুরেন্সের শেয়ার বিক্রি করতে শুরু করে। এতে বীমা কোম্পানিটির শেয়ারে দরপতন শুরু হয়।

বিধি ভঙ্গ করে বিনিয়োগ করার কারণে গত বছরের সেপ্টেম্বরে এনআরবি ব্যাংককে ব্যাংক কোম্পানি আইনের ২৬() ধারায় জরিমানা করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ধারার উপধারা () অনুযায়ী, একটি ব্যাংক অন্য ব্যাংক বা কোম্পানির কী পরিমাণ শেয়ার ধারণ করতে পারবে তা বলা আছে। তবে পাইওনিয়ার ইন্স্যুরেন্সের শেয়ারে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে এনআরবি ব্যাংক তা লঙ্ঘন করেছে। পাইওনিয়ার ইন্স্যুরেন্সে বিধি ভঙ্গ করে বিনিয়োগ করার কারণে ২৬()() ধারার আওতায় এনআরবি ব্যাংককে ৪৯ লাখ ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যাংক কোম্পানি উপধারা ()-এর বিধান লঙ্ঘন করলে ওই ব্যাংককে অনূর্ধ্ব ২০ লাখ টাকা জরিমানা করা হবে। ওই লঙ্ঘন অব্যাহত থাকলে প্রথমদিনের পর থেকে প্রতিদিনের জন্য অতিরিক্ত অনধিক ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হবে।

শেয়ার কারসাজির সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বিএসইসির নির্দেশনার বিষয়ে জানতে চাইলে এনআরবি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মামুন মাহমুদ শাহ বণিক বার্তাকে বলেন, বিএসইসির কাছ থেকে এখন পর্যন্ত ধরনের কোনো চিঠি পাইনি। বিষয়ে এর আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংক আমাদের জরিমানা করেছে। আমাদের অভ্যন্তরীণ তদন্তেও যাদের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে, তাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।

আইন বহির্ভূত বিনিয়োগের ফলে ব্যাংকের যে আর্থিক ক্ষতি হয়েছে সেটি কীভাবে পূরণ করা হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বর্তমানে পুঁজিবাজার পরিস্থিতি অনুকূল নয়। বাজার পরিস্থিতির উন্নতি হলে এবং শেয়ারের দাম বাড়লে আশা করছি ক্ষতি পূরণ করা সম্ভব হবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন