বাংলাদেশ ব্যাংক-বিএসইসির মতপার্থক্য প্রকাশ্যে না এলে ভালো হতো

. মসিউর রহমান ২০০৯ সাল থেকে তিন মেয়াদে মন্ত্রীর পদমর্যাদায় প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক বিষয়ক উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছেন। ইআরডির সচিব, পরিসংখ্যান ব্যুরোর মহাপরিচালক বিভাগের সচিব, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যানসহ রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ১৯৭২-৭৫ সাল পর্যন্ত জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একান্ত সচিব ছিলেন। দেশের অর্থনীতির সাম্প্রতিক গতিপ্রকৃতি নিয়ে বণিক বার্তার সঙ্গে কথা বলেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন এম এম মুসা 

বাংলাদেশ ব্যাংক বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের সঙ্গে কিছু বিষয়ে মতপার্থক্য দেখা দেয়। শেষে অর্থ মন্ত্রণালয়কে হস্তক্ষেপ করতে হয়েছে। এমন মতপার্থক্য অগ্রগতির পথে অন্তরায় নয় কি?

সংবাদপত্রে দেখা যায়, পুঁজিবাজার বন্ড মার্কেট নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) পৃথক দৃষ্টিভঙ্গি আছে। দুই সংস্থার মতপার্থক্য ফলাও করে প্রকাশ না হলে ভালো হতো। তাদের মতপার্থক্যের ফলে বাজারে একটা অস্থিরতা দেখা যায়, যার কোনো মৌলিক ভিত্তি নেই। বাংলাদেশ ব্যাংক মুদ্রানীতি পরিচালনা করে। মুদ্রানীতি সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত না হলে সার্বিকভাবে অর্থনীতির সমাজের ক্ষতি হয়, শিল্প-বাণিজ্যও রেহাই পায় না। বিএসইসির নির্দিষ্ট বলয় হলো শেয়ার মার্কেট বা ক্যাপিটাল মার্কেট। শেয়ার মার্কেট ক্যাপিটাল মার্কেট যাতে সুষ্ঠুভাবে কাজ করতে পারে সেজন্য প্রয়োজন সুষ্ঠু মুদ্রাবাজার, যা নিয়ন্ত্রিত পরিচালিত হয় মুদ্রানীতি দ্বারা।

দুটি কর্তৃপক্ষের মধ্যে ডিভিডেন্ড দেয়া বা না দেয়া নিয়ে দ্বন্দ্ব দেখা গেছে। ব্যাংক মূলত ব্যবসা করে আমানতকারীর অর্থ নিয়ে। বাণিজ্যিক ব্যাংক যাতে আমানতকারীর স্বার্থ রক্ষা করে তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব কেন্দ্রীয় ব্যাংকের। আমানতকারীর স্বার্থ রক্ষার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ বা দুর্বল কোম্পানির শেয়ারে সাবধানে বিনিয়োগ করা দরকার। আমানতের ওপর প্রভাব বিবেচনা প্রয়োজন। আমানতকারীর ওপর নেতিবাচক প্রভাব আর্থিক ব্যবস্থার ওপর মানুষের বিশ্বাস কমায়, আর্থিক মধ্যস্থতা (ইন্টারমিডিয়েশন) দুর্বল করে। সঞ্চয় ইন্টারমিডিয়েশনে আসবে না, অন্যান্য ভৌত বা প্রকৃত সম্পদে (ট্যানজিবল অ্যাসেট) যাবে, বুদ্বুদ সৃষ্টি হবে। যদি কোনো ব্যাংক বা বাণিজ্যিক শিল্পপ্রতিষ্ঠান বছরের পর বছর লোকসান দেয় এবং তাদের পর্যাপ্ত বা নির্ধারিত পুঁজি না থাকে তাহলে তাদের আসলে লাভ থাকে না।  

লোকসান অবলোপনের জন্য মূলধন বাড়াতে হয়, ঝুঁকি নিরসনের জন্য পুঁজি বাড়াতে হয়। লোকসান অবলোপন পর্যাপ্ত মূলধন তৈরি না করে ডিভিডেন্ড দেয়া নীতিসংগত বা যুক্তিসংগত নয়। ডিভিডেন্ড শেয়ারের দাম বাড়াতে পারে কিন্তু প্রতিষ্ঠানের আর্থিক ভিত্তি দুর্বল থাকে। ফাইন্যান্সিয়াল মার্কেট বা ইন্টারমেডিয়েশন দক্ষ না হলে, টাকা পৌঁছানোর প্রক্রিয়াটিও দুর্বল হয়ে যায়। রেসপন্সবিলিটির দিক থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের যে দৃষ্টিভঙ্গি, তার সঙ্গে বেশি মানুষ এবং সার্বিক অর্থনীতি সমাজের স্বার্থ জড়িত।

শেয়ারবাজারে স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে বিএসইসি বিনিয়োগ স্থিতিশীল তহবিল তৈরি করছে। এটি নিয়েও এক ধরনের মতপার্থক্য দেখা গেছে। বিষয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ কী?

বিনিয়োগ তহবিলের বিষয়টি সুস্পষ্ট নয়। অস্পষ্টতা মেনে নিয়ে বলা যায়, অন্যের অর্থ ব্যবহার করার জন্য একটা আইনের ভিত্তি দরকার। ফান্ডের জন্য কোনো আইনের ভিত্তি তৈরি হয়েছে কিনা পত্রিকায় দেখিনি। যে শেয়ারের ডিভিডেন্ড দাবি করা হয়নি, তার জন্য একটা নির্দিষ্ট সময় অপেক্ষা করতে হয়। আমাদের আইনে আছে, কোনো ব্যক্তির হদিস পাওয়া না গেলে কয়েক বছর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। মালিকবিহীন সম্পদের দায়দায়িত্ব বা মালিকানা সরকারের ওপর বর্তায়; সরকারের পক্ষে কেন্দ্রীয় ব্যাংক দায়িত্ব পালন করে। অপেক্ষার সময় পার হওয়ার পর কারো দাবি প্রতিষ্ঠা করতে হলে আইনের মাধ্যমেই তা করতে হয়। দাবি প্রতিষ্ঠিত হলে মালিককে ডিভিডেন্ড দেয়ার ব্যবস্থা থাকতে হবে।

বিনিয়োগ স্থিতিশীল তহবিল তৈরি করা হচ্ছে শেয়ারবাজার স্থিতিশীল রাখার জন্য। ফান্ডামেন্টালস অপরিবর্তিত থাকে কিন্তু শেয়ারের দাম ওঠানামা করে রকম অবস্থায় স্থিতিশীলতার জন্য হস্তক্ষেপ দরকার হতে পারে। শেয়ারের দাম অতিমাত্রায় বাড়তে থাকলে স্থিতিশীল ফান্ড থেকে সেসব শেয়ার ত্বরিত বিক্রি করে দিতে হবে, যাতে মূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে টান পড়ে। যেসব শেয়ারের দাম নিম্নমুখী সেগুলো কিনতে হবে, যাতে মূল্যহ্রাস প্রশমন বা স্তিমিত হয়। এটা বেশ স্পর্শকাতর কর্মপ্রণালি। একটা বড় প্রশ্ন হলো, সুনির্দিষ্ট পরিমাণ সম্পদ নিয়ে কোনো ফান্ড উদ্দেশ্য সফল করতে পারে কিনা। শেয়ারবাজারে একটা ঝুঁকি সবসময়ই থাকে এবং তহবিল পরিচালনা অবশ্যই খুব দায়িত্বের সঙ্গে করতে হবে। প্রক্রিয়ায় লাভের সুযোগ সীমিত, ঝুঁকি পরিহার করা দুরাশা। স্থিতিশীলতার জন্য সময়মতো পর্যাপ্ত মুদ্রা সরবরাহ দরকার। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ছাড়া অন্য কোনো কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব পালনের সক্ষমতা নেই। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ক্ষমতা প্রয়োগ দায়িত্বশীল মুদ্রানীতি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত।

শেয়ারবাজারে স্থিতিশীলতার জন্য দরকার ভালো শেয়ারের সরবরাহ। পর্যাপ্ত ভালো শেয়ার বাজারে আসছে না, ফলে চাহিদার সঙ্গে সরবরাহের মিল থাকছে না। সীমিতসংখ্যক ভালো শেয়ারের চাহিদা বেশি থাকে, দামও বেশি হয়। শেয়ারবাজারে বর্তমানে যে অগভীরতা বিরাজমান, সেদিকে দৃষ্টি দেয়া দরকার। দ্রুত মুনাফাপ্রত্যাশীদের প্রভাব কমাতে হবে; দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ উৎসাহিত করতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশে বাণিজ্যিক ব্যাংক শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের জন্য বিশেষ তহবিল গঠন করেছে, বিনিয়োগের সীমা নির্ধারিত হয়েছে। প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগের মাধ্যমে পুঁজিবাজারে অস্থিরতা প্রশমন হবে আশা করা যায়।

অভিযোগ আছে দেশের প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বল হচ্ছে। উন্নয়নশীল দেশে পদার্পণের ক্ষেত্রে শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান তো খুবই জরুরি?

আমি বলব না যে নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো ক্রমে দুর্বল হচ্ছে। নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ যেগুলো আছে যেমন বাংলাদেশ ব্যাংক, প্রতিযোগিতা কমিশন, বিইআরসি, বিটিআরসিএসব প্রতিষ্ঠানে অভিজ্ঞ যোগ্যতাসম্পন্ন লোক আছে। তাদের হয়তো যথাযথভাবে দায়িত্ব পালনে অনেক সময় অসুবিধা হয়। একটি অসুবিধা হলো, আমরা একটা অর্থনৈতিক অবস্থা বা ইকোসিস্টেমে কাজ করতে অভ্যস্ত। কিন্তু বাংলাদেশের উন্নয়নের স্বীকৃতির ফলে আমাদের নতুন ধরনের বাধা অতিক্রম করতে হবে, নতুন পথে যেতে হবে। আর নিয়ন্ত্রক সংস্থার কাজ হলো বিদ্যমান অর্থনৈতিক কাঠামোর মধ্যে যে আচরণ বা সংস্কৃতি সৃষ্টি হয়েছে এবং স্বাভাবিক মনে হয়েছে, সেখান থেকে নতুন পথে যাওয়া, উত্তরণের সঙ্গে সবাইকে মানিয়ে চলতে অভ্যস্ত করা। ব্যক্তি খাতের উদ্যোক্তাদের মনে হবে হঠাৎ করে কেন অসুবিধা তৈরি হচ্ছে, নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের মনে হবে ব্যক্তি খাতে উদ্যোগীরা সঠিক পথে কেন কাজ করছেন না। এজন্য দরকার দুই পক্ষের ভেতরে কথাবার্তা বলা, একজনের অসুবিধা বা দায়িত্ব কী হতে পারে সেটি সম্পর্কে আরো বেশি আলাপ করা, নিজেদের কথা আরো স্পষ্ট করে বলা। এক্ষেত্রে সরকার নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের যেমন সহনীয় পথ বেছে নেয়া দরকার, তেমনি ব্যক্তি খাতকেও দায়িত্বশীল হতে হবে।

ব্যাংকগুলো খেলাপি ঋণে ন্যুব্জ। সরকার আশা করছে আরো শিল্পায়ন হবে, ব্যাংকগুলো আরো অর্থায়ন করতে পারবে। বিদ্যমান অবস্থায় এটা কি সম্ভব?

নন-পারফর্মিং লোন (এনপিএল) বললেই মনে হয় যে যিনি ঋণ নিয়েছেন তিনি যেন অপরাধ করেছেন। আমাদের দেখা উচিত সার্বিকভাবে তারা দেশের অর্থনীতিতে কোনো অবদান রাখছেন কিনা। আমাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি - শতাংশে পৌঁছেছে। শিল্পোদ্যোক্তাদের অবদান ছাড়া প্রবৃদ্ধি সম্ভব হতো না। অর্থনীতিতে তাদের ইতিবাচক অবদান আছে। উদ্যোক্তা আমদানি করা যাবে না। উদ্যোক্তা সৃষ্টির জন্য সময় পরিবেশ দরকার।

এনপিএলের মাত্রা ঝুঁকি সম্ভাবনার অনুপাতে বিভিন্ন স্তরে ব্যাংক পুঁজি জমা রাখে। ঋণগ্রহীতা ঋণ ফেরত না দিলে ঝুঁকি বাড়তে থাকে, ঝুঁকি নিরসনমূলক পুঁজি বাড়ানোর ফলে ব্যাংকের ঋণ দেয়ার ক্ষমতা খর্ব হয়, সুদের হার বাড়াতে হয়। যারা নতুন বিনিয়োগ করতে চাইছেন তাদের অসুবিধা হয়। আমরা যখন এনপিএল বলি তখন স্বাভাবিকভাবে আমাদের চোখ পড়ে যিনি ঋণ নিয়েছেন তার ওপরে। যিনি ঋণ নিয়ে ব্যবসা করছেন, শিল্প করছেন, তার দুর্বলতা থাকতে পারে, সেজন্য ঋণ দেয়ার সময় দেখতে হবে সঠিক ব্যবসা, বিনিয়োগ প্রকল্প ব্যক্তিকে ঋণ দেয়া হচ্ছে কিনা। ইন্টারমেডিয়েশনের দক্ষতা নৈতিক মান বাড়াতে হবে।

আমাদের শিল্প বা ব্যবসা ব্যাংকের ঋণের ওপর নির্ভর করে। ম্যাচুরিটি মিসম্যাচ উল্লেখ করা হয়। স্বল্পমেয়াদি আমানত দীর্ঘমেয়াদি ঋণ দুটোর সমন্বয় না থাকলে ব্যাংকের অসুবিধা হয়। অসুবিধা দূর করার জন্য আরো একটু গভীর প্রসারিত বিবেচনা দরকারবিনিয়োগের জন্য নতুন কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন বা সুযোগ আছে কিনা, যে সংস্থা বিনিয়োগের জন্য দীর্ঘমেয়াদি ঋণ দিতে পারে। শেয়ারবাজার যাতে সক্রিয় প্রসারিত হয়, সেদিকে নজর দিতে হবে। বন্ড মার্কেট সক্রিয় করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। সাবধানতা দরকার, শুরুতে হোঁচট খেলে বন্ড মার্কেটের প্রসার বাধাগ্রস্ত হবে।

কোনো শিল্প বা বাণিজ্যিক খাতে ব্যাপক সমস্যা দেখা দিলে বাণিজ্যিক ব্যাংকের পক্ষে সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য কতগুলো তথ্য দরকার, যার অভাব রয়েছে। একটা সেক্টর কী পরিমাণ প্রসারিত হয়েছে, আগামীতে কী ধরনের ঝুঁকি থাকতে পারে সেজন্য কেন্দ্রীয়ভাবে মনিটরিং, তথ্য সংগ্রহ সরবরাহ, বিশ্লেষণ, প্রক্ষেপণ ইত্যাদি দরকার। বিশ্লেষণের বৈচিত্র্য থাকা দরকার। তথ্য বিশ্লেষণ দেখে বিনিয়োগকারী সিদ্ধান্ত নেবেন। বেসরকারি সংস্থা দায়িত্ব নিতে পারে। সরকারি প্রতিষ্ঠান নিলে লোকসানের দায় সরকারের ওপর পড়বে, মোরাল হ্যাজার্ড তৈরি হবে।

ঋণ দেয়ার সময় মনে করা হয়, এর বিপরীতে পর্যাপ্ত সিকিউরিটি বা মর্টগেজ দিলে ঋণ নিশ্চিত থাকে; মর্টগেজ না দিতে পারলে ঋণ পাওয়া যায় না। ছোট মাঝারি উদ্যোক্তাদের যথেষ্ট পরিমাণ মর্টগেজ বা কোলেটারেল দেয়ার ক্ষমতা নেই, তারা পর্যাপ্ত ঋণ পায় না। ছোট ঋণের ব্যবস্থাপনা ব্যয় তুলনামূলকভাবে বেশি। সেজন্য তাদের ঋণ দিতে ব্যাংকের অনীহা। কিন্তু এসব খাতে বিনিয়োগ বাড়ানো দরকার, কর্মসংস্থান সৃষ্টি সার্বিক সামাজিক কল্যাণে তারা বড় অবদান রাখে।

অনেকে ব্যাংকিং সংস্কার কমিশনের কথা বলছেন। আপনার মত কী?

কোনো একটি ব্যাংকের পক্ষে এককভাবে বড় সমস্যা মোকাবেলা করা সম্ভব নয়। তথ্যগুলো কেন্দ্রীয়ভাবে সংগ্রহ এবং তাত্ত্বিক ভিত্তিতে বিশ্লেষণ করতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের আইনে ক্ষমতা আছে, বিশ্লেষণের দক্ষতা আছে, কমিটি বা কমিশনকে সহায়তা করতে পারে; সংস্কারের দায়িত্ব সক্ষমতার অতিরিক্ত বোঝা হবে। সরকার কমিটি বা কমিশন গঠন করতে পারে। কমিশনের আইনের ভিত্তি থাকে; কমিটি প্রশাসনিক ব্যবস্থা মাত্র। কমিটি বা কমিশনের সদস্যরা ব্যক্তিগত ব্যবসায়িক স্বার্থমুক্ত হবেন, সমাজের আস্থাভাজন হবেন। শিল্পে বিনিয়োগের জন্য অর্থপ্রবাহ দরকার, তা না হলে অর্থনীতির অগ্রগতি বা বিকাশ ব্যাহত হবে। কমিশন দক্ষ দায়বদ্ধ ঋণ সরবরাহের জন্য সংস্কার সুপারিশ করবে।

সুদের হার শতাংশে নামিয়ে আনা হলো। তার পরও তো বিনিয়োগ বাড়ছে না।

যথেষ্ট পরিমাণে বিনিয়োগ না হওয়ার কারণ মনে হয় বিনিয়োগ থেকে যে পণ্য উৎপাদন হবে, তার যথেষ্ট চাহিদা নেই বা তৈরি হচ্ছে না। যারা দেশে উৎপাদিত পণ্য কিনবে, তাদের আয় হয়তো সমহারে বাড়ছে না। আয় বণ্টনের বিষয়টি জটিল, সার্বিক অর্থনৈতিক কাঠামোর ওপর নির্ভর করে। সরকার প্রবৃদ্ধি, কর্মসংস্থান এবং সরাসরি সহায়তা কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির জন্য দক্ষ রাজস্ব নীতি প্রশাসন এবং ব্যয়ের মান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

কেউ শতাংশে ঋণ পুনঃতফসিল করছে আবার কাউকে ১০ শতাংশ অর্থ দিয়ে করতে হচ্ছে। এতে বৈষম্য সৃষ্টি হচ্ছে না?  

এনপিএল থাকা অথবা এনপিএল পুনঃতফসিলের মাধ্যমে নিস্তার পাওয়া দুয়ের মধ্যে পার্থক্য হলো একজন সুইটহার্ট ডিল পেয়েছে, আরেকজন পায়নি। পুনঃতফসিলের সুবিধা প্রকৃত ঋণ দায়ভার লাঘব করে না, ঋণ পরিশোধের সময় বাড়ায়; মূল্যস্ফীতির দরুন ঋণাত্মক পরিশোধের সুবিধা হয়। তাদের প্রভাব ব্যাংক শেয়ারবাজারের জন্য ইতিবাচক নয়। ঋণ পরিশোধে নমনীয়তা পাওয়ার জন্য স্বচ্ছ নিয়মতান্ত্রিক ব্যবস্থা দরকার, নতুবা প্রভাব বা সামাজিক নেটওয়ার্ক প্রযুক্ত হয়। যাদের প্রভাব বা নেটওয়ার্ক নেই, তারা সুযোগ নিতে পারে না, ফলে বৈষম্যের সৃষ্টি হয়। দুর্বল শিল্প-ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান সুবিধা নিলে সার্বিক বিবেচনায় অর্থনীতির উন্নতি এবং সমাজের কল্যাণ হয় না। অন্যদিকে, প্রকৃত দক্ষতাসম্পন্ন প্রতিষ্ঠান সুযোগ না পেলে উৎপাদন বা ব্যবসায় দক্ষতা হারায়; যা অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকর। অসম সুযোগ বিতরণ মাঝারি ছোট বিনিয়োগকারীদের বিশেষভাবে আঘাত করে। সবার জন্য কল্যাণকর অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য ছোট মাঝারি উদ্যোক্তাদের সহায়তা জরুরি। দক্ষ ন্যায্য অর্থনীতি পরিচালনার জন্য এটা বড় পরীক্ষা। করোনাকালে দীর্ঘ সময় খেলাফি ঋণ শনাক্ত স্থগিত ছিল, অপরিশোধিত ঋণের পরিমাণ বড় হয়েছে। পুনঃতফসিল করার সময় সেদিক বিবেচনায় রাখা দরকার হতে পারে, যা হবে সীমিত সময়ের জন্য এককালীন সুবিধা, সাধারণ নিয়ম নয়।

২০২৬ সালে আমরা এলডিসি থেকে বের হয়ে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে শামিল হতে যাচ্ছি। বিদ্যমান অবস্থায় আমাদের চ্যালেঞ্জগুলো কী?

মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়াটা নিঃসন্দেহে গর্বের। আমাদের সাফল্যের প্রকাশ স্বীকৃতি। ভবিষ্যতের জন্য আমাদের কয়েকটি বিষয় বিবেচনায় নেয়া দরকার। মনে রাখতে হবে একটা বিশেষ অর্থনৈতিক পরিবেশে নীতি অনুসরণ করে আমাদের সাফল্য এসেছে। সেই পরিবেশ নীতিতে শিল্পোদ্যোক্তাদের বিভিন্নভাবে সাহায্য সুবিধা দেয়ার ব্যবস্থা ছিল। মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হলে নীতির পরিবর্তন আসবে এবং সহায়তা দেয়া সীমিত হবে বা অনেক ক্ষেত্রে সুযোগ থাকবে না। প্রথমত, আমদানি শুল্ক উচ্চপর্যায়ে রেখে দেশীয় শিল্পকে সুরক্ষা দেয়া সীমাবদ্ধ হবে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার বিধিনিষেধ রয়েছে। দ্বিতীয়ত, রফতানি বাজারের জন্য সরকারের সহায়তা সীমিত হবে। রফতানিতে এখনো বৈচিত্র্য আসেনি, একটি পণ্যের ওপর আমরা মূলত নির্ভর করছি। মধ্যম আয়ের দেশে উত্তরণ ঘটলে রফতানি প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বৈচিত্র্য বাড়াতে হবে। তৃতীয়ত, টাকার বিনিময় হার সঠিক রাখতে হবে। যদি কৃত্রিমভাবে টাকার মূল্য বেশি রাখা হয় তাহলে দেখা যাবে আমদানি পণ্য অনেক কম দামে কিনতে পারছি, দেশের শিল্প অসুবিধায় পড়বে। ধারাবাহিকভাবে মুদ্রার বিনিময় হার সমন্বয় করলে হঠাৎ করে বড় চাপ আসবে না। পরিবর্তনশীল বিনিময় হারের সঙ্গে সংগতি রেখে উৎপাদন বাণিজ্য পরিচালনা ব্যক্তি খাতের একটা বড় দায়িত্ব। মধ্যম আয়ের দেশের জন্য প্রযোজ্য নিয়মনীতি মেনে আমাদের আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে এগিয়ে যেতে হবে।

বলা হচ্ছে, উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হলে বিদ্যমান অনেক সুবিধা থাকবে না। এতে সরকারে কী ধরনের প্রভাব পড়বে?

এখানে কয়েকটি দিক আছে। এক. সকারের বাজেট বা ব্যয়ের দিক; দুই. সরকারের রাজস্ব আহরণ; তিন. নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব। নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা প্রয়োগের মূলনীতিসরকারের কোনো হস্তক্ষেপ থাকবে না, তারা নিজেদের বিচারবুদ্ধি অনুসারে কাজ করবে। কিন্তু সরকারের নীতি দেশের স্বার্থকে তাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে। সেটি বিবেচনায় রেখে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, অর্থনীতিকে সঠিক ধারায় এগিয়ে নিতে হবে। আমরা খালি চোখে দেখি, কেউ শিল্প করে লাভবান বিত্তশালী হচ্ছেন, কেউ বাণিজ্য করে হচ্ছেন। এই দৃশ্যমান অর্থনীতির ভেতরে কিছু দুর্বলতা থাকতে পারে। নিয়ন্ত্রণ সংস্থার বড় দায়িত্ব হবে অর্থনীতির মূল সূত্র অনুসারে অংশগ্রহণকারী, বিশেষত ব্যক্তি খাতে অংশগ্রহণকারীরা যেন অর্থনৈতিক উন্নয়ন সার্বিক সামাজিক কল্যাণ নিশ্চিত করেন তা দেখা এবং নিশ্চিত করা। 

এক সময়ের অনেক নামকরা প্রতিষ্ঠান আজ বন্ধের পথে। এর পেছনে কারণ কী?

বণিক বার্তা ওপেক্স গার্মেন্টস বন্ধের খবর প্রকাশ করেছিল। পোশাক কারখানা সর্বপ্রথম ১০০ মিলিয়ন ডলার মূল্যের পণ্য রফতানি করে। প্রতিষ্ঠানটির বড় অংকের উৎপাদন সক্ষম ভৌত সম্পদ (টানজিবল অ্যাসেট) রয়ে গেছে। কোম্পানির আর্থিক বিপর্যয় কাটিয়ে ওই সম্পদ উৎপাদনের জন্য ব্যবহার সম্ভব। তার জন্য আর্থিক কারিগরি পুনর্গঠন বা রি-স্ট্রাকচারিং দরকার। আমাদের দেউলিয়া আইন সময়োপযোগী বা কার্যকর নয়। উপযুক্ত দেউলিয়া আইন থাকলে ভৌত সম্পদ পুনর্বিন্যাস করে উৎপাদনে ব্যবহার সম্ভব হতো। অর্থঋণ আদালতে মোকদ্দমা করে মর্টগেজ বা কোলেটারাল অধিগ্রহণ করে ঋণদাতা বিক্রি করতে চান। বড় বন্ধকি সম্পত্তি কেউ কিনতে চান না। ছোট ছোট সম্পদ কেনা-বেচার ক্ষেত্রে বর্তমান আইন হয়তো কিছুটা কার্যকর, কিন্তু বড় বিনিয়োগ বা অবকাঠামোর ক্ষেত্রে কার্যকর নয়। বিদেশে অনেক দৃষ্টান্ত আছে যে রি-স্ট্রাকচারিং ব্যবস্থাপনা পরিবর্তন করে দেউলিয়া উদ্যোক্তা ঘুরে দাঁড়িয়েছেন বা উৎপাদন ক্ষমতা ব্যবহার করা হয়েছে। সময়োপযোগী কার্যকর দেউলিয়া আইনের প্রয়োজনীয়তা বিবেচনার সময় এসেছে। বন্ধকি সম্পদ জব্দ করার মহাজনি পদ্ধতি অলস বা অব্যবহূত সম্পদ বাড়ায়, উৎপাদন ক্ষমতা বাড়ায় না।

দক্ষিণ কোরিয়ায় দেখা যায় কোনো গ্রুপ ভালো না করলে অন্য গ্রুপকে দিয়ে চেষ্টা করা হয় ব্যবসা-বাণিজ্য, অবস্থার উন্নতি হয় কিনা। আমরা কি রকম কিছু করতে পারি না?

কোরিয়া চাইবল বা বড় কোম্পানিকে সহায়তা দেয়, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য চেবলের ওপর নির্ভর করে। পরবর্তীকালে নীতির দুর্বলতা দেখা দেয়। বৈষম্য নিরসন গ্রামীণ উন্নয়নের জন্য বিশেষ নীতি বাস্তবায়ন করে। দুর্নীতির জন্য বড় কোম্পানির পরিচালক সরকারপ্রধান শাস্তি ভোগ করেন। ত্রুটি সংশোধন ব্যবসা-বাণিজ্যে কঠোর নীতি প্রতিষ্ঠা করে কোরিয়ার অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ায়। আমাদের এখানে আগের পরিবেশে যেসব শিল্প উদ্যোগ বড় হয়েছে, তাদের প্রকৃত অবস্থা কী সম্পর্কে পর্যাপ্ত নির্ভরযোগ্য তথ্য নেই। গ্রুপ অব কোম্পানি আইন দ্বারা সংগঠিত অথবা প্রিন্সিপাল-সাবসিডিয়ারি সম্পর্কের ওপর প্রতিষ্ঠিত কিনা তা স্পষ্ট নয়। বড় কোম্পানি গ্রুপ অব কোম্পানির প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে সমীক্ষা করা যেতে পারে। কোম্পানির নাম-পরিচয় প্রকাশ না করার শর্ত থাকবে। বাংলাদেশ ব্যাংক, অর্থনীতিবিদ ব্যবসা প্রশাসন বিশেষজ্ঞরা দায়িত্ব নিতে পারেন।  একটি কালপর্বে কোম্পানির কত পরিমাণ ব্যাংকঋণ ছিল, তাদের নগদ প্রবাহ কেমন, পুনঃতফসিল করার ফলে তাদের সুবিধার পরিমাণ কত, নগদ আয় থেকে দায়-দেনা শোধ করতে বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে কিনাএগুলো সমীক্ষার বিষয়বস্তু। রেটিং তাদের সক্ষমতা, দুর্বলতা ঝুঁকি চিহ্নিত করতে পারবে। আমাদের অডিটের নির্ভরযোগ্যতা বাড়ানোর জন্য এফআরসি বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছে। সুষ্ঠু অডিট রেটিং দায়-দেনাগ্রস্ত কোম্পানি এবং শিল্প-বাণিজ্যের প্রকৃত অবস্থা বুঝতে সাহায্য করবে, ঋণ পুনঃতফসিল দুর্বলতা অগোচরে রাখবে না।

প্রথম প্রজন্মের উদ্যোক্তারা প্রায় চলে গেছেন। অনেকেই দ্বিতীয় প্রজন্মের কাছে হস্তান্তর করছেন। প্রক্রিয়ায় কিছু কোম্পানিতে জটিলতা সৃষ্টি হচ্ছে। এটাকে আপনি কীভাবে দেখেন?

এটা সত্য যে অনেকেই পূর্বপুরুষের ব্যবসা উদ্যোগে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। এটাকে নেতিবাচক দৃষ্টিতে না দেখে ইতিবাচকভাবে বিবেচনা করা দরকার। আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার হয়েছে প্রধানত অদক্ষ বা স্বল্প দক্ষ শ্রমিক নিম্ন মজুরির ওপর নির্ভর করে। মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার জন্য দরকার দক্ষতাভিত্তিক উৎপাদনশীলতা। নতুন প্রজন্ম যে পূর্বপুরুষের পথে আটকে না থেকে নতুন পথে এগিয়ে যেতে আগ্রহী, এটা ইতিবাচক। তরুণ প্রজন্ম নতুন লক্ষ্যের দিকে যাচ্ছে, শিল্পোদ্যোগ ত্যাগ করছে না, এটা আশার সঞ্চার করে।

ইনভেস্টমেন্ট সামিটে আমি তিনটি গুরুত্বপূর্ণ সক্ষমতা উল্লেখ করেছিলাম। প্রথমত, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি মধ্যবিত্তের প্রসারের ফলে অভ্যন্তরীণ বাজার প্রসারিত হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, আমাদের জনমিতিক সুযোগ (ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড)কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী২০৫০ সাল নাগাদ থাকবে। তৃতীয়ত, তরুণ প্রজন্ম নতুন উদ্যোক্তা শ্রেণী তৈরি করছে, যাদের উদ্ভাবনী ক্ষমতা ঝুঁকি নেয়ার সামর্থ্য আছে। অর্থনীতি রফতানি প্রক্রিয়া অঞ্চল তৈরি হচ্ছে। বড় অবকাঠামো, শুল্ক-কর রেয়াত, মুনাফা পুঁজি প্রত্যাবাসনের সুযোগ ইত্যাদি বিদেশী বিনিয়োগের জন্য বাড়তি আকর্ষণ। ইদানীং বিভিন্ন ইলেকট্রনিকস সামগ্রী, মোটরগাড়ি ইত্যাদি উৎপাদনের দিকে ঝোঁক দেখা যায়। এসব ভালো লক্ষণ। সস্তা শ্রমের ওপর নির্ভর না করে উন্নত টেকনোলজি প্রয়োগ শুরু হয়েছে।

একটা গ্রুপ তো দেশে আসতে চাইছে না, বিষয়টিকে কীভাবে দেখেন?

এটা স্বাভাবিক। বিশ্বের সঙ্গে আগের তুলনায় আমরা অনেক বেশি সম্পৃক্ত হচ্ছি। যারা লেখাপড়া শিখছে, যোগ্যতা অর্জন করছে, তারা মনে করে বিশ্বের যেকোনো জায়গায় কাজ করার যোগ্যতা তাদের আছে। যোগ্যতার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের যোগ্যতা প্রয়োগ এবং আকাঙ্ক্ষা পূরণের সীমানাও বাড়তে থাকে। এটা আমাদের আত্মবিশ্বাসের পরিচয়। প্রবাসী বাঙালি অনেকেই দেশ নিয়ে প্রবন্ধ-বই লিখছেন। দেশে আসতে কেন তাদের অনীহা? নতুন প্রজন্ম ব্যবসা-বাণিজ্য অন্যান্য ক্ষেত্রে নিয়মতান্ত্রিক সম-আচরণ বা লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড চায়। তাদের দোষত্রুটির চেয়ে অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থার দিকে নজর দেয়া বেশি দরকার। আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্য শিল্প মালিক নিয়ন্ত্রিত। একটি ছেলে বা মেয়ে, যে বিজনেস ম্যানেজমেন্ট পড়েছে, প্রডাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং বা অন্য কোনো যোগ্যতা অর্জন করেছে কিন্তু মূলধন নেই, সে চায় তার বুদ্ধি যোগ্যতা ব্যবহারের সুযোগ। যোগ্যতা ব্যবহারের সুযোগ পাচ্ছে না, এটাই হতাশার কারণ। হতাশা দূর করতে হবে। মালিক নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থাপনার পরিবর্তে যোগ্যতা জ্ঞানভিত্তিক ব্যবস্থাপনার প্রসার দরকার।

কভিডের অভিঘাতে নতুন করে অনেকে দরিদ্র হয়েছেন বলে বিভিন্ন গবেষণায় উঠে এসেছে। তাদের সহায়তায় সরকার কী পদক্ষেপ নিয়েছে?

কভিডের সময়ে আমাদের থিংক ট্যাংক যেসব গবেষণা করেছে তা প্রশংসনীয়। তাদের গবেষণায় দেখা যায়, কভিডের ফলে দারিদ্র্য বেড়েছে। এটা কি কাঠামোগতভাবে দারিদ্র্য না সাময়িক দারিদ্র্য প্রশ্নের উত্তর খোঁজা দরকার। সরকার প্রণোদনা ঋণের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিক খাতের পারিশ্রমিক দেয়ার ব্যবস্থা করেছে। যারা অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ করতেন, লকডাউন শিথিল বা শেষ হওয়ার পর তারা অনেকেই কাজে ফিরেছেন। এটি ছিল সাময়িক দারিদ্র্য, কাঠামোগত নয় রকম ধারণা যুক্তিহীন নয়। সাময়িক দারিদ্র্যের জন্য সাময়িক সহায়তা দরকার। তারা যাতে কাজে ফিরতে পারেন সেজন্যও উদ্যোগ দরকার। কভিডের অভিঘাতে যারা দারিদ্র্যের প্রান্তিক সীমার ওপরে ছিলেন, তাদের অবস্থা খারাপ হয়েছে। যারা গ্রামে স্থায়ীভাবে বাস করেন, তাদের চিহ্নিত করে সহায়তা দেয়া সহজতর। তাদের একটা পরিচিতি আছে। তাদের আয় লেখাজোখা নেই; কিন্তু জীবনযাত্রা পারিপার্শ্বিক অবস্থা দেখে এবং পড়শির কাছ থেকে জানা যায় তারা গরিব কিনা। যারা শহরে থাকেন তাদের সহায়তা প্রদান ব্যবস্থাপনায় জটিলতা আছে। দরিদ্র লোকের একটা মুখ আছে, নাম আছে, পরিচিতি আছে। সহায়তা দেয়ার জন্য তাদের পরিচয় নিশ্চিত হওয়া দরকার। অর্থনীতির চালিকাশক্তিগুলো সচল হচ্ছে। রফতানি বাড়ছে, শিল্পোৎপাদন গতি পাচ্ছে। আশা করা যায়, সাময়িক দারিদ্র্য কমছে।

ভারতের মতো সবার জন্য আধার কার্ড চালু করা যায় কিনা, যেখানেই থাক না কেন সেটি দিয়ে রাষ্ট্রীয় সহায়তা পাওয়া যাবে?

এজন্য তথ্যভাণ্ডার ব্যবহারোপযোগী কার্ড করা সম্ভব। যে সময় লাগবে, তার মধ্যে হয়তো দরিদ্রের পরিচিতি আবাসস্থান বদলে যাবে। সাময়িক দারিদ্র্য তথ্যভাণ্ডার পরিসংখ্যান দিতে পারবে, দরিদ্র ব্যক্তির পরিচয় সুনিশ্চিত হবে না। দরিদ্র ব্যক্তির মুখ আর নাম না জানলে, অর্থাৎ পরিচিতি নিশ্চিত না হলে সঠিক সহায়তা দেয়া জটিল হয়। তথ্যভাণ্ডারের নির্ভরযোগ্যতা এবং বিতরণের দক্ষতা দুইয়ের ভারসাম্য রাখা দরকার। সামগ্রিক সমন্বিত সহায়তা কর্মসূচির জন্য -জাতীয় পরিচয়পত্র সহায়ক। 

সর্বজনীন পেনশনের কথা বলা হচ্ছে? মধ্যম আয়ের একটি দেশের জন্য এটি জরুরি নয় কি?

দেশের মানুষের আয়ু বাড়ছে। কাজের বয়স ১৫ থেকে ৫৯ বছর। একজন লোক ১০-১১ বছর ধরে বার্ধক্য ভগ্ন স্বাস্থ্য নিয়ে বাঁচবে। কর্মক্ষমতা নেই, আয় নেই রকম লোকের সংখ্যা বাড়তে থাকবে। যদি আয় বীমার ব্যবস্থা করা হয় তাহলে যে লোকটির এখন আয় আছে, সে বীমা করার সুযোগ পাবে, বার্ধক্যে বীমা থেকে প্রাপ্ত টাকা দিয়ে জীবনযাপন করতে পারবে। সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যভিত্তিক সহায়তা আমাদের অর্থনৈতিক অবস্থার সঙ্গে অধিক সংগতিপূর্ণ এবং কার্যকর। মানসম্পন্ন কর্মসংস্থান, উৎপাদনশীলতা উৎপাদন বৃদ্ধি, সঞ্চয়ের জন্য প্রণোদনা, পর্যাপ্ত রাজস্ব আহরণ, দক্ষ ব্যয় বিনিয়োগ কল্যাণ কর্মসূচির জন্য আবশ্যক।

 

শ্রুতলিখন: হুমায়ুন কবির

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন