স্ট্যাম্পে কেনাবেচা হয় সরকারি জমিতে নির্মিত কড়াইল বস্তির ঘর

আল ফাতাহ মামুন

বস্তিটি ঘিরে প্রতি মাসে কোটি কোটি টাকার লেনদেন হচ্ছে। নানা অজুহাতে চাঁদাবাজি হচ্ছে। রীতিমতো দলিল করে বেচাকেনা হচ্ছে বস্তির ঘরবাড়ি। বসানো হচ্ছে গ্যাস-বিদ্যুতের অবৈধ সংযোগ। এসব সংযোগের বিল থেকে শুরু করে ঘর ভাড়া ও বেচাকেনার নামে সংগৃহীত অর্থ যাচ্ছে প্রভাবশালীদের পকেটে। কারো কারো নামে কড়াইল বস্তির ঘর বেচাকেনা করে স্বল্প আয়ের শ্রমজীবী থেকে গুলশানের মতো অভিজাত এলাকার ধনাঢ্য বাসিন্দা হয়ে ওঠার গল্পও শুনতে পাওয়া যায় ছবি: নিজস্ব আলোকচিত্রী

দেশের সবচেয়ে বড় বস্তি কড়াইল। রাজধানীর স্বল্প আয়ের তিন লাখ শ্রমজীবী মানুষের বসবাস এখানে। স্বল্প আয়ের মানুষের বসতি এখন প্রভাবশালীদের কাছে হয়ে উঠেছে টাকা বানানোর আকর্ষণীয় স্থান। এর অন্যতম পন্থা হলো বস্তির ঘর কেনাবেচা। সরকারি জমিতে গড়ে উঠলেও ঘরগুলো বেচাকেনা হচ্ছে স্ট্যাম্পে রীতিমতো দলিল করে।

এলাকাটিতে ১৯৫৬ সালে টিঅ্যান্ডটির নামে ১৭০ একর জমি অধিগ্রহণ করেছিল তত্কালীন পাকিস্তান সরকার। এর মধ্যে ১৬০ একর জমি নিয়ে কড়াইল বস্তির বর্তমান পরিধি। স্থানীয়রা জানান, স্বাধীনতার পর দীর্ঘদিন জমি প্রায় খালিই পড়ে ছিল। নব্বইয়ের দশকের শুরুর দিকে অভিজাত এলাকা গুলশান-বনানীর শিল্পপ্রতিষ্ঠানে কর্মরত কয়েকজন স্বল্প আয়ের শ্রমিক টিঅ্যান্ডটির (বর্তমানে বিটিসিএল) জমিতে বসবাস করতে থাকেন কড়াইল এলাকায়। একপর্যায়ে দ্রুতগতিতে সম্প্রসারণ হতে থাকে বস্তিটির। বিভিন্ন শিল্প-কারখানার শ্রমিকদের পাশাপাশি বন্যা নদীভাঙনে বাস্তুচ্যুত হয়ে বা কাজের খোঁজে ঢাকা আসা অসংখ্য মানুষ বসবাস করতে থাকে কড়াইল বস্তিতে। একসময় বস্তি এলাকাটি হয়ে ওঠে চাঁদাবাজি-রাহাজানিসহ নানা অপরাধের স্বর্গরাজ্য। বর্তমানে বস্তিটিতে ঘর রয়েছে ৩০-৩৫ হাজার। এসব ঘরে বসবাস করছে সমসংখ্যক পরিবার। বাসিন্দার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রায় তিন লাখে।

বস্তির প্রতিটি ঘরেই রয়েছে গ্যাস-বিদ্যুতের অবৈধ সংযোগ। একেকটি ঘরের মাসিক ভাড়া - হাজার টাকা। ভাড়ার টাকা যায় রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতাধর স্থানীয় প্রভাবশালীদের পকেটে। প্রতি মাসে শুধু ঘর ভাড়া হিসেবেই এখান থেকে ১০-১৫ কোটি টাকা তুলে নিচ্ছেন তারা। এর বাইরে রয়েছে অবৈধ গ্যাস বিদ্যুতের সংযোগ থেকে আয়। এছাড়া নানা অজুহাতে চাঁদাবাজি অপরাধমূলক অন্যান্য কর্মকাণ্ড থেকেও বিপুল পরিমাণে অর্থ উপার্জন হচ্ছে তাদের। এক্ষেত্রে বড় একটি উৎস হলো বস্তির ঘর কেনাবেচা। কারো কারো নামে কড়াইল বস্তির ঘর বেচাকেনা করে স্বল্প আয়ের শ্রমজীবী থেকে গুলশানের মতো অভিযান এলাকার ধনাঢ্য বাসিন্দা হয়ে ওঠার গল্পও শুনতে পাওয়া যায়।


বস্তির অন্তত ছয়জন ঘর মালিক সরকারি জমিতে ঘর বেচাকেনার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তারা জানান, কড়াইল বস্তি পুরোটাই সরকারি জায়গা। এখানে শুরুতে যারা ঘর বানিয়েছে, তারা মালিক বনে গেছে। ঘর বেচাকেনা হয় স্ট্যাম্পের মাধ্যমে। প্রতিদিনই ঘর দোকানের দাম বাড়ছে। কেনাবেচাও হচ্ছে। এমন ঘর মালিকও আছেন যারা শুরুতে বস্তিতে ঢুকে কয়েকটি ঘর কিনে নিয়েছিলেন, এখন তাদের মালিকানাধীন ঘরের সংখ্যা এক-দেড়শ। বস্তিটির শুরুর দিকে তারা ছিলেন নিম্ন আয়ের শ্রমিক। এখন আর তারা কড়াইল বস্তির বাসিন্দা নন, থাকেন গুলশান-বনানীর অভিজাত ফ্ল্যাটে। এমন মালিক বেশ কয়েকজনই রয়েছেন।

বিপুল অংকের অর্থের হাতছানিই রাজনৈতিক নেতা থেকে শুরু করে প্রভাবশালী অনেকের কাছে জায়গাটিকে আকর্ষণীয় করে তুলেছে বলে জানিয়েছেন বস্তিবাসী। তাদের দাবি, ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত অন্তত ৪০ প্রভাবশালী এখানকার ঘর কেনাবেচাসহ যাবতীয় কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত রয়েছেন।

কড়াইল বস্তি নাম হলেও বস্তির মূল দুটি ইউনিট পরিচিত জামাইবাজার বউবাজার নামে। তবে বস্তিকেন্দ্রিক লেনদেনের নিয়ন্ত্রণকারীরা এটিকে ১০টি মহল্লায় ভাগ করেছেন বলে জানা গিয়েছে। এগুলো হলো কুমিল্লা পট্টি, বেলতলা বস্তি, গোডাউন বস্তি, পশ্চিমপাড়া বস্তি, পূর্বপাড়া বস্তি, উত্তরপাড়া বস্তি, বাইদাপাড়া বস্তি, মোসা বস্তি, বউবাজার এরশাদনগর বস্তি।

কথা হয় স্থানীয় চা দোকানি সাজেদা বেগমের সঙ্গে। ২০০০ সালে বৈবাহিক সূত্রে প্রথম বস্তিতে পা রাখেন তিনি। ২০০৪ সালে গার্মেন্টসের হেলপার হিসেবে কর্মজীবনে প্রবেশ করেন। দীর্ঘ ১৪ বছর গার্মেন্টসে কাজ করার পর এখন তিনি চায়ের দোকানি। তিনি বলেন, স্বামী রঙের কাজ করত। দুর্ঘটনায় পা বিকল হয়ে পড়ে। তখন ধারদেনা করে দোকান ভাড়া নিয়েছিলাম। এখন দোকানের ভাড়া দিচ্ছি মাসে হাজার টাকা করে। ঘর ভাড়া দিই সাড়ে হাজার টাকা করে।

ওই দোকানেই কথা হয় মো. মোশাররফের সঙ্গে। তিনি বলেন, ১৯৯৪ সালে বস্তিতে আসি। পেশায় আমি একজন হকার। তখন হাজার টাকা দিয়ে দুটো ঘর কিনি। ২০০৬ সালে দেড় লাখ টাকা দিয়ে আরো দুটো ঘর কিনি। এখন আমার ঘর মোট চারটি। ঘরগুলোর বর্তমান বাজারমূল্য  লাখ টাকা করে।

সরেজমিন বস্তির বউবাজার এলাকা ঘুরে দেখা যায়, দুই পাশে বাঁশ টিনের ছাপরায় একতলা দোতলা ঘর। আধা পাকা ঘরও আছে। ছয় বাই সাত ফুটের একটি ঘরে খাট পাতা। তার চারপাশ মালামালে ঠাসা। কিছু ঘরে আছে টিভি, ফ্রিজ ফ্যান। ঘরে ঘরে বিপজ্জনকভাবে দেয়া হয়েছে বিদ্যুতের সংযোগ। আছে কাঁচাবাজার রেস্তোরাঁও। ভেতরে প্লাস্টিক লোহার পাইপ দিয়ে নেয়া হয়েছে গ্যাসের সংযোগ। ট্রান্সমিটার থেকে সরাসরি তার টেনে বিদ্যুতের সংযোগ নেয়া হয়েছে। তবে কিছু বৈধ সংযোগও রয়েছে বলে দাবি করেছেন কয়েকজন বস্তিবাসী।

১৯৯০ সাল থেকেই বস্তিটিতে বসবাস করছেন আনসার বাহিনীর সদস্য আকরাম শেখ (ছদ্মনাম) তিনি বলেন, আমি যখন আসি তখন বস্তিতে অল্প কিছু ঘর ছাড়া পুরোটাই মাঠ আর ঝিল ছিল। ১৯৯২ সাল থেকে বস্তিটি জমজমাট হতে শুরু করে। র্যাব আসার আগ পর্যন্ত বস্তিতে সন্ত্রাসী-চাঁদাবাজদের প্রকাশ্য আনাগোনা থাকলেও এখন সে দৃশ্য নেই। এখন চাঁদাবাজি চলে ভিন্ন স্টাইলে।

বস্তির প্রবীণ বাসিন্দা জানান, এখন গ্যাস বিল, বিদ্যুৎ বিল, ময়লার বিল, পানির বিলের নামে চাঁদা নেয়া হয়। অবৈধ গ্যাস বিদ্যুতের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা চাঁদা পান ঘরের মালিকরা। প্রায় বিদ্যুৎ গ্যাসের লোকজন এসে লাইন কেটে দেয়। তখন ব্যাপক ভোগান্তি পোহাতে হয় বস্তিবাসীকে। গত বৃহস্পতিবারও তিতাসের লোকজন বস্তির ব্লকে অভিযান চালিয়ে গ্যাস লাইন বিচ্ছিন্ন করে দেন।

বিষয়টির সত্যতা মেলে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ১৯ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর এবং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ সভাপতি মোহাম্মদ মফিজুর রহমানের বক্তব্যেও। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, বস্তিতে চাঁদাবাজি হয়। তবে সে রকম ব্যাপকভাবে চাঁদাবাজির ঘটনা আমার জানা নেই।

গুলশানের আশপাশ থেকে অনেকগুলো পোশাক কারখানা গাজীপুরে স্থানান্তর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বস্তিবাসীর বড় একটা অংশ কড়াইল বস্তি ছেড়ে অন্যত্র পাড়ি জমান। বর্তমানে কড়াইল বস্তির বেশির ভাগ বাসিন্দা রিকশাচালক ভ্যানচালক। অল্প কিছু গার্মেন্ট শ্রমিকও থাকেন এখানে। বস্তিবাসী রাহেলা আক্তার বলেন, গার্মেন্টের কাজ ছেড়েছি সাত-আট বছর আগে। এখন মানুষের বাসায় কাজ করি। এখানকার বাসিন্দা নারীদের অনেকেই ক্ষুদ্র ব্যবসা করছেন।

সার্বিক বিষয়ে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সেলিম রেজা বণিক বার্তাকে বলেন, এখানে বিপুলসংখ্যক মানুষের বসবাস। আমরা এদের পুনর্বাসনের জন্য আলাদা প্রকল্প হাতে নিচ্ছি। তবে বস্তিতে চাঁদাবাজির বিষয়ে আমি অবগত নই।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন