ইউক্রেন সংকট

স্পটের এলএনজি নিয়ে অনিশ্চয়তা আরো বাড়ছে

আবু তাহের

রাশিয়ার একটি বন্দর থেকে এলপিজি নিয়ে ইউরোপের উদ্দেশে যাত্রার অপেক্ষায় কার্গো ছবি: এপি

গ্যাসের সরবরাহ ঘাটতি পূরণের জন্য এলএনজি আমদানির ওপর নির্ভরশীল বাংলাদেশ। আমদানীকৃত এলএনজির ২৫ শতাংশই আসে স্পট মার্কেট থেকে। উচ্চমূল্যের কারণে বর্তমানে স্পট মার্কেট থেকে গ্যাস সংগ্রহ করা এমনিতেই মুশকিল হয়ে উঠেছে। সামনের দিনগুলোয় বিড়ম্বনা আরো অনেকখানি বাড়িয়ে তুলতে যাচ্ছে ইউক্রেন সংকট। সংকটের প্রেক্ষাপটে রুশ এলএনজি থেকে বঞ্চিত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে ইউরোপের দেশগুলোয়। ভূরাজনৈতিক কারণেই দেশগুলোর সামনে এখন বিকল্প সমাধান নিয়ে হাজির হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। বিশ্ববাজারে স্পট স্বল্পমেয়াদি চুক্তির আওতায় সরবরাহকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের চালানগুলো ইউরোপের দিকে ঘুরিয়ে দিতে চাইছে দেশটি। বিষয়টি নিয়ে এরই মধ্যে গ্যাস রফতানিকারী দেশগুলোর সঙ্গে আলোচনা শুরু করে দিয়েছে ওয়াশিংটন। দেশটির প্রয়াস সফল হলে সামনের দিনগুলোয় বাংলাদেশের জন্য দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির বাইরে গ্যাস আমদানি করা একেবারে অসম্ভব হয়ে উঠবে বলে মনে করছেন জ্বালানি খাতের পর্যবেক্ষকরা।

বৈশ্বিক ভূরাজনীতিতে মুহূর্তে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় হয়ে উঠেছে ইউক্রেনে রুশ আক্রমণের সম্ভাবনা। আগামী মাসেই রাশিয়া ইউক্রেনে হামলা চালাতে পারে বলে মনে করছে যুক্তরাষ্ট্র। অবস্থায় দেশটি চাইছে, ইউরোপে ওয়াশিংটনের মিত্র দেশগুলো রাশিয়ার ওপর কূটনৈতিক চাপ বাড়িয়ে তুলুক। যদিও বিষয়টি নিয়ে দেশগুলোর মধ্যে একটু ইতস্তত ভাব রয়েছে। ইউরোপের জ্বালানি চাহিদার বড় অংশই মেটানো হয় রাশিয়া থেকে পাইপলাইনে সরবরাহকৃত গ্যাসের মাধ্যমে। মস্কোর প্রতি বৈরী আচরণ দেখাতে গেলে দেশগুলোর গ্যাসের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ থেকে বঞ্চিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। শীত মৌসুমের মাঝামাঝি এসে সর্বোচ্চ চাহিদার মুহূর্তে এমন বিড়ম্বনায় পড়তে চাইছে না দেশগুলো। অবস্থায় ইউরোপকে আশ্বস্ত করতে গিয়ে মহাদেশটির জন্য এলএনজি প্রাকৃতিক গ্যাসের অন্য উৎস খুঁজে বের করায় সচেষ্ট হয়ে উঠেছে যুক্তরাষ্ট্র। আলোচনা চালাচ্ছে রফতানিকারী দেশগুলোর সঙ্গে।

হোয়াইট হাউজের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা সম্প্রতি বিষয়টি স্বীকার করে বার্তা সংস্থা গার্ডিয়ানকে বলেন, ইউরোপ যাতে শীত বসন্তকাল ঠিকভাবে পার করতে পারে সেজন্য (গ্যাসের) বিকল্প উৎস নিশ্চিত করার বিষয়ে প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে। আমরা ঠিকঠাক প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে পারব বলেই প্রত্যাশা করছি। এর মধ্য দিয়ে সম্ভাব্য ঘাটতির সিংহভাগই পূরণ করা সম্ভব হবে বলে আমরা প্রত্যাশা করছি।

মার্কিন পদক্ষেপ ইউরোপকে ঘাটতি থেকে সুরক্ষা দিলেও বিপদে ফেলতে যাচ্ছে বাংলাদেশসহ এশিয়ার উদীয়মান অর্থনীতিগুলোকে।

এশিয়ার অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশও জ্বালানি চাহিদা মেটাতে স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি আমদানি করে। তবে বিশ্ববাজারে পণ্যটির উচ্চমূল্য থাকায় বর্তমানে এলএনজি কেনা বন্ধ রয়েছে। পণ্যটির মূল্য নিম্নমুখী না হওয়ায় আপাতত এলএনজি কেনার পরিকল্পনাও খুব বেশি নেই পেট্রোবাংলার।

পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান নাজমুল আহসান বণিক বার্তাকে বলেন, স্পট মার্কেটে এখন এলএনজির উচ্চমূল্য চলছে। এত উচ্চমূল্যে এলএনজি কেনার মতো পর্যাপ্ত অর্থও পেট্রোবাংলার কাছে নেই। আমরা বাজার নিম্নমুখী হওয়ার অপেক্ষায় রয়েছি। আপাতত দেশীয় উৎস দীর্ঘমেয়াদি যে এলএনজি আমদানি চুক্তি রয়েছে সেখানে গুরুত্ব দিচ্ছি। শীত মৌসুমে আমাদের জ্বালানি চাহিদা অন্য সময়ের চেয়ে কম থাকে। ফলে বাজার পর্যবেক্ষণ করা ছাড়া কোনো উপায় নেই।

এলএনজির মূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে গত বছরের সেপ্টেম্বরে স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি না কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল জ্বালানি বিভাগ। কিন্তু গ্যাসের ঘাটতি বিবেচনায় সে সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে হয়। স্পট মার্কেটে মূল্যবৃদ্ধির মধ্যে গত বছরের জুলাই থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে তিন কার্গো এলএনজি কেনা হয়।

এর মধ্যে গত বছরের ২২ সেপ্টেম্বর সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত কমিটিতে ৩৩ লাখ ৬০ হাজার এমএমবিটিইউ ধারণক্ষমতার একটি কার্গো কেনার অনুমতি দেয়া হয়। যার প্রতি এমএমবিটিইউ দাম পড়েছিল ২৯ দশমিক ৮৯ ডলার। স্পট মার্কেটে এলএনজির এমন উচ্চমূল্য সত্ত্বেও অক্টোবর আরো দুই কার্গো এলএনজি কেনার অনুমতি দেয় ক্রয়সংক্রান্ত কমিটি। ওই দুই কার্গো এলএনজির প্রতি এমএমবিটিইউ দাম পড়ে ৩৬ দশমিক ৯৫ ডলার।

বিশ্ববাজারে এলএনজির মূল্যবৃদ্ধি অব্যাহত, পণ্যটি ক্রয়ে পেট্রোবাংলার অর্থসংকটে পরবর্তী সময়ে আর কোনো কার্গো কেনেনি জ্বালানি বিভাগ। অথচ গত বছরেই স্পট মার্কেট থেকে ১৮ কার্গো এলএনজি আমদানির পরিকল্পনা করা হয়েছিল। কিন্তু মূল্যবৃদ্ধিতে সেই পরিকল্পনা বাতিল করতে হয়।

জ্বালানি বিভাগের বিভিন্ন তথ্য পর্যালোচনা করে জানা গেছে, দেশে বর্তমানে যে জ্বালানি সরবরাহ হচ্ছে তার ৭৮ শতাংশ আসছে দেশীয় উৎস থেকে। এর বাইরে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আওতায় এলএনজি সরবরাহ হচ্ছে ১৭ শতাংশ এবং শতাংশ এলএনজি আসছে স্পট মার্কেট থেকে। জ্বালানি বিভাগের পরিকল্পনা ছিল, এলএনজির বাজার অস্থিরতা কমে গেলে স্পট মার্কেট থেকে চলতি বছরের শুরুর দিকে কার্গো আমদানি করা হবে। তবে এসব পরিকল্পনার যোগফল পাল্টে দিয়েছে করোনা মহামারী এবং চলমান ইউক্রেন সংকট।

জ্বালানি-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কভিড মহামারীতে অর্থনৈতিক কর্মচাঞ্চল্য কমে যাওয়ায় গত বছরের শুরুর দিকে জ্বালানির দাম কমে গিয়েছিল। কিন্তু এবার পরিস্থিতি ভিন্ন। ইউরোপে শীত মৌসুমে গ্যাসের চাহিদা বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি এই সংকটে নতুন যুক্ত হয়েছে ইউক্রেনে চলমান সংকট।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ বদরুল ইমাম বণিক বার্তাকে বলেন, বিশ্ববাজারে জ্বালানি মূল্যে ঊর্ধ্বগতির বর্তমানে প্রধান কারণ হলো ইউক্রেন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়ার মধ্যকার দ্বন্দ্ব। এই দ্বন্দ্বে মিত্র দেশগুলোর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র গ্যাসকে প্রধান অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে। ফলে তারা বিশ্বব্যাপী প্রভাব ফেলবে এটাই স্বাভাবিক। এছাড়া অতীতে শক্তিধর দেশগুলো একে অন্যের সঙ্গে যত যুদ্ধে জড়িয়েছে, সেখানে জ্বালানিকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। ইউক্রেন পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত এটার কোনো সুরাহা নেই। আমাদের মতো দেশের ক্ষেত্রে আমদানিনির্ভর পণ্যটি নিয়ে জ্বালানি পরিকল্পনা করা ভুল হয়েছে। ফলে এখন এসব সংকট তৈরি হচ্ছে। সংকট থেকে উত্তরণে নিজস্ব সম্পদ নিয়ে অনুসন্ধানের কোনো বিকল্প নেই।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন