ইচ্ছামতো পাহাড় কাটা চলছে, জানে না রাঙ্গামাটির প্রশাসন

ব্যবস্থা গ্রহণে প্রশাসনের উদাসীনতা ও শৈথিল্য কাম্য নয়

বন্ধ হচ্ছে না পাহাড় কাটা। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত রাঙ্গামাটিতেও পাহাড় টিলা কেটে উজাড় করা হচ্ছে। গতকাল বণিক বার্তায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাঙ্গামাটি জেলার আসামবস্তি-ভেদভেদী সড়কের লুম্বিনী বিহার এলাকার সাধানপুরে সবুজ বলতে আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় পাহাড় ধসে প্রাণহানি-ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে প্রশাসনের কিছু সতর্কতামূলক তত্পরতা দেখা গেলেও পাহাড় ধস ঠেকানোর ব্যাপারে কারো কোনো প্রচেষ্টাই নেই। শুধু প্রাকৃতিক কারণেই পাহাড় ধসে পড়ছে তা কিন্তু নয়। নিয়ন্ত্রণহীন পাহাড় কাটা, পাহাড়ে স্থাপনা নির্মাণসহ আরো কিছু অপরিণামদর্শী মনুষ্য তত্পরতার পরিণামে ধসে পড়ছে পাহাড়। এক্ষেত্রে ব্যবস্থা গ্রহণ আইন প্রয়োগে প্রশাসনের উদাসীনতা কাম্য নয়। প্রশাসনকেও জবাবদিহিতার আওতায় আনা হোক।

আজ চারদিকে পরিবেশ বিধ্বংসী নানা কর্মকাণ্ডের মধ্যে পাহাড় কাটা বিশেষ আলোচনায় আসছে। পাহাড় কাটার মাধ্যমে ভূমির রক্ষাকবচের ভূমিকাকে অকেজো করে দেয়া হয়। একসময় পাহাড় নিজেই দুর্বল হয়ে ধসে পড়ে। নদ-নদী, গাছপালার মতোই পাহাড় পরিবেশ-প্রতিবেশের এক বিশেষ অনুষঙ্গ, যার বিনাশ বিশ্বকে নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে ঠেলে দেয়। বর্ষা মৌসুম এলেই দেশে পাহাড় কাটার ধুম পড়ে যায়। এখন আর সেটি কোনো নির্দিষ্ট মৌসুমে সীমাবদ্ধ নেই। বাংলাদেশের চট্টগ্রাম সিলেট, রাঙ্গামাটির পাহাড় কাটার মহোৎসবের খবর প্রায়ই পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হচ্ছে। তাতে যেমন এলাকার নান্দনিকতা নষ্ট হচ্ছে, তেমনি প্রকৃতির ভারসাম্য পড়েছে হুমকির মুখে। পাহাড় কেটে ভূমি সমতল করে কাটা পাহাড়ের গায়ে গড়ে তোলা হয় হাজার হাজার অবৈধ বাড়িঘর। পাহাড় কাটা বন্ধে উচ্চ আদালত অসংখ্যবার নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। এর পরও অবিরাম আবাসন আর শিল্পায়ন প্রকল্পের কারণে পাহাড় নিশ্চিহ্ন হচ্ছে। অপরিণামদর্শী পাহাড় কাটায় ভূতাত্ত্বিক গঠন ক্রমে দুর্বল থেকে দুর্বলতর হচ্ছে। পাহাড় ধ্বংস হওয়ার ফলে কীভাবে পাহাড় ধস দুর্যোগ আকারে হাজির হয় তা আমরা দেখেছি। দুর্যোগে প্রাণ সম্পদহানি ঘটে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত এক দশকে পাহাড় ধসে দুই শতাধিকের বেশি মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। আমাদের পাহাড়ের অধিকাংশ অংশই মানুষের লোভের বলি হয়েছে। অথচ পৃথিবীর অনেক দেশে উঁচু পাহাড় অক্ষত রেখে ঢালু জায়গায় গড়ে তোলা হয়েছে অনিন্দ্যসুন্দর জনপদ।

নেপাল পাহাড়, পর্বত হিমালয় নিয়ে অতুলনীয় সৌন্দর্যে ভরপুর। দেশটির সরকার জনগণ টিলারাশি, পাহাড়-পর্বত রক্ষায় এক অনন্য নজির স্থাপন করেছে। সরকার প্রতিটি নাগরিক পর্বত পাহাড় রক্ষায় সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে থাকে। নিবিড় পরিকল্পনার মাধ্যমে তারা তাদের দেশকে গড়ে তুলছেন। পরিকল্পিত উপায়ে বৃক্ষরোপণ সৌন্দর্য বৃদ্ধির মাধ্যমে পর্যটকদের জন্য আকর্ষণীয় করে তোলা হচ্ছে। ফলে সারা বছরই সেখানে পর্যটকদের বিচরণ থাকে। খাত থেকে তারা প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জন করে। তারা এমনভাবে বাড়িঘর নির্মাণ করে যে কোথাও ঝড়-বৃষ্টি বা বর্ষায় বাড়িঘর ধসে পড়ার কথা শোনা যায় না। অথচ আমাদের দেশও কয়েক বছর আগে ছোট ছোট অনেক পাহাড় টিলায় সমৃদ্ধ ছিল। পরিতাপের বিষয়, কিছু মানুষের লোভ-লালসার শিকার হয়ে প্রকৃতির এই অসামান্য দান সম্পদ বিনষ্ট করে পরিবেশকে হুমকির মুখে ঠেলে দেয়া হচ্ছে। বিভিন্ন পত্রপত্রিকার খবরে প্রকাশ, আন্তর্জাতিক ভূতত্ত্ববিদরা গভীর আগ্রহ নিয়ে বাংলাদেশে এসে বিভিন্ন পাহাড়ি এলাকা পরিদর্শন করে পাহাড়-টিলা কাটার নমুনা দেখে হতবাক হয়ে যান।

১৯৮৩ সালে সরকার পাহাড়-টিলা কাটার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল। পরবর্তীকালে ১৯৮৭ সালের সংশোধিত আইনের আওতায় অনুমতি সাপেক্ষে পাহাড় ছাঁটার অনুমোদনের ব্যবস্থা রাখা হয়। কিন্তু আইনের ফাঁক দিয়ে টিলা ছাঁটার নামে বড় বড় টিলা কেটে সমতল করা হচ্ছে। এটা দেখার বা বাধা যাদের পক্ষ থেকে দেয়ার কথা, তারা অর্থের লোভে কাটায় সহযোগিতা করে যাচ্ছেন। এমনও জানা যায়, কোথাও টিলা বা পাহাড় কাটার খবর আইন-শৃঙ্খলা প্রয়োগকারী সংস্থাকে জানানো হলে তারা হয়তো তদন্তে যায়, কিন্তু তাদের যাওয়ার আগেই টিলা বা পাহাড় কাটার খবর জড়িতদের জানিয়ে দেয়া হয়। ফলে সরেজমিনে গিয়ে তাদের আর পাওয়াই যায় না। এতে খবরদাতাকে নাজেহাল হতে হয়। মজার ব্যাপার পাহাড় কাটা হয়ে গেলে পরে আইনে মামলা দিয়ে শাস্তি বিধানের ব্যবস্থা করা হয়েছে। কিন্তু পাহাড় কাটা রোধ করার কোনো কার্যকর নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা আইনে নেই। পাহাড় বন কাটার সঙ্গে জড়িত শ্রমিকদের মাঝেমধ্যে গ্রেফতার করা হচ্ছে। কিন্তু মূল হোতারা থেকে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। পাহাড় কাটার বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে বা পরিবেশ আদালতে মামলা করেই যেন পরিবেশ অধিদপ্তরের দায়িত্ব শেষ। একথা ভুলে গেলে চলবে না যে আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করা এবং পাহাড় ধ্বংসকারীদের আইনানুগ শাস্তি নিশ্চিত করার দায়িত্ব পরিবেশ অধিদপ্তরের। সাম্প্রতিক সময়ে যেসব আইন প্রণয়ন করা হচ্ছে, সেগুলোয় একই অপরাধ বারবার হলে শাস্তির মাত্রা কয়েক গুণ পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। পরিবেশ আইনে যদি এমন দুর্বলতা থাকে, তাহলে তা দূর করা এবং আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগ নিশ্চিত করা প্রয়োজন। প্রয়োজনে শাস্তির মাত্রা বাড়িয়ে পরিবেশ ধ্বংসকারী দুর্বৃত্তদের নিবৃত্ত করতে হবে। অন্যথায় বাংলাদেশ দ্রুতই পাহাড়শূন্য হয়ে যাবে, প্রাকৃতিক বনাঞ্চল বলে কিছু থাকবে না।

পাহাড়ের মালিকানা ভূমি মন্ত্রণালয়ের। বন পরিবেশ মন্ত্রণালয় বনজ সম্পদ রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত। পাহাড় এলাকায় বাড়িঘর নির্মাণের নিয়ন্ত্রণ পূর্ত মন্ত্রণালয়ের ওপর ন্যস্ত। এদের মধ্যে সমন্বয়হীনতা সুযোগ করে দিয়েছে নির্বিচারে পাহাড় কাটা, পাহাড়ের গায়ে বেড়ে ওঠা গাছপালা উজাড় করে দালানকোঠা, বস্তি নির্মাণের ক্ষেত্র। পাহাড় কাটা, পাহাড় কেটে অবৈধ বাড়িঘর নির্মাণ পরিবেশ সংরক্ষণ বিধি ১৯৯৫-এর ১৫ ধারার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন এবং এর জন্য রয়েছে শাস্তির বিধান। তবে পাহাড়খেকোদের বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। তাই পাহাড় কাটা, বসতি স্থাপনও থেমে থাকেনি।

সত্য বলতে কি, ক্ষুদ্র ব্যক্তি বা গোষ্ঠীস্বার্থ যেখানে কাজ করে, সেখানে শুধু নীতিবাক্য আর সদাচরণের মৌখিক আহ্বান কোনো কাজে আসে না। এজন্য নীতি নিয়মের পাশাপাশি কঠোর আইনের প্রয়োজন। সে আইনের যথাযথ প্রয়োগ এবং আইন প্রয়োগে সংশ্লিষ্ট সব মহলের সততা, নিষ্ঠা, আন্তরিকতা দেশপ্রেমের দরকার। যারা পাহাড় কাটছে এবং পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাস করছে, এসব ব্যর্থতার দায় শুধু তাদের নয়। এর দায় স্থানীয় প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোরই বেশি। নিয়ন্ত্রণমূলক কর্মকাণ্ড জোরদার করার ক্ষেত্রে কী ধরনের সমস্যা এবং কারা এসবের পেছনে সক্রিয় রয়েছে বিষয়গুলো ভালোভাবে খতিয়ে দেখে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। জননিরাপত্তা, পাহাড়ের সৌন্দর্য প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা করা অপরিহার্য। কাজটি যাতে সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করা যায়, সেজন্য দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে।

আমরা আশা করব চট্টগ্রাম, সিলেট, কক্সবাজার, রাঙ্গামাটি, বগুড়া, কুমিল্লাসহ সারা দেশের পাহাড়-টিলা যেটুকুই অবশিষ্ট আছে, তা সংরক্ষণের জন্য কঠোর আইন প্রণয়ন করা হবে। একই সঙ্গে সে আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রেও কঠোর মনোভাব ব্যবস্থা গৃহীত হবে। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কথা চিন্তা করে এবং লালিত শহরগুলোর ঐতিহ্য বজায় রাখার প্রয়োজনে সর্বস্তরের নাগরিককে সচেতন সোচ্চার হতে হবে। মুহূর্ত থেকে ব্যাপারে সতর্ক দায়িত্বশীল হতে হবে। গ্রহণ করতে হবে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ, যাতে আমরা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়ে পাহাড় কাটা বন্ধ করতে পারি। অনেকে পাহাড় দখল করে বসে থাকে, তাদের উচ্ছেদ করতে হলে যতটুকু জনবল বন বিভাগের থাকা উচিত, সেসব বৃদ্ধিতেও সরকারকে মনোযোগ দিতে হবে। দেশ প্রতিনিয়ত উন্নত হচ্ছে, সে উন্নতির ধারাবাহিকতায় একটা সময় আমরা আমাদের সবকিছু বিনির্মাণের পর ভালো পরিবেশ খুঁজতে থাকব। তাই এখনই যদি এসব বিপর্যয়ের মতো কাজ করা থেকে বিরত থাকি, তাহলে ভবিষ্যতে আমরা অনেক সুন্দর একটা পরিবেশের প্রত্যয় ব্যক্ত করতে পারব।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন