ঢাকার প্রথম মেট্রোরেল

উড়ালপথের কাজ শেষ নিচের সড়কে ভোগান্তি ‘আরো কিছুদিন’

নিজস্ব প্রতিবেদক

রাজধানীর ব্যস্ততম মিরপুর-আগারগাঁও-ফার্মগেট-মতিঝিল সড়কের প্রায় অর্ধেক অংশ দখল হয়ে আছে চলমান মেট্রোরেলের নির্মাণকাজে। স্টেশন এলাকাগুলোর অবস্থা আরো খারাপ। এর ওপর জায়গায় জায়গায় ভেঙে ফেলা হয়েছে ফুটপাত। ফলে যান চলাচল তো বিঘ্নিত হচ্ছেই, হাঁটতে গিয়ে পথচারীরাও পড়ছে দুর্ভোগে। যাত্রী-পথচারীদের ভোগান্তি আরো বাড়িয়েছে নির্মাণকাজের কারণে সৃষ্ট ধুলাবালি। কাজ শুরুর প্রায় পাঁচ বছর পর ঢাকার প্রথম মেট্রোরেলের উড়ালপথ তৈরির কাজ গতকাল শেষ হলেও সড়ক ব্যবহারকারীদের দুর্ভোগ থাকবে আরো কিছুদিন।

প্রকল্পের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, মিরপুর-আগারগাঁও সড়কটি স্বাভাবিক হতে এপ্রিল পর্যন্ত সময় লেগে যেতে পারে। তবে কাজের নতুন অনুষঙ্গ যোগ হওয়ায় স্টেশন এলাকাগুলোয় বিঘ্নিত হবে যান চলাচল। আর আগারগাঁও-মতিঝিল অংশে উড়ালপথের কাজ শেষ হলেও সবকটি স্টেশনের কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত নিচের সড়কে অব্যাহত থাকবে দুর্ভোগ।

মেট্রোরেল প্রকল্পের সিংহভাগ কাজ করা হয় রাতে। তবে এর উত্তরা-আগারগাঁও অংশ চলতি বছরের ডিসেম্বরেই চালুর লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এছাড়া পুরো মেট্রোরেলই আগামী বছরের ডিসেম্বরে চালু করতে চায় সরকার। এসব লক্ষ্য পূরণে বিভিন্ন স্থানে এখন দিনেও নির্মাণকাজ চলছে। মেট্রোরেলের পুরোটিই হচ্ছে উড়ালপথে। এজন্য নিচের সড়কের মাঝ বরাবর গড়ে তোলা হয়েছে পিয়ার। মধ্যবর্তী অর্ধেক অংশ ঘিরে রাখা হয়েছে। স্টেশন এলাকাগুলোয় রাস্তার প্রায় পুরো অংশজুড়েই চলছে নির্মাণকাজ। এগুলোর ভেতর দিয়ে কোনো রকমে যানবাহন চলাচলের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। সব মিলিয়ে যাতায়াতে ঢাকাবাসীর প্রতিদিনকার দুর্ভোগে নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে প্রকল্পটি। যদিও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যথাযথ ট্রাফিক পরিকল্পনার মাধ্যমে নগরবাসীর দুর্ভোগ অনেকটাই কমিয়ে আনা সম্ভব ছিল, যা করতে ব্যর্থ হয়েছে মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ।

ঢাকার প্রথম মেট্রোরেলটি (এমআরটি-) তৈরি হচ্ছে উত্তরা-মিরপুর-আগারগাঁও থেকে ফার্মগেট-শাহবাগ-দোয়েল চত্বর-মতিঝিল রুটে। এর মধ্যে উত্তরা-আগারগাঁও অংশে সড়কের নিচে থাকা বিভিন্ন সংস্থার পরিষেবা লাইন স্থানান্তরের কাজ শুরু হয় ২০১৬ সালের শেষ দিকে। উড়ালপথের পিয়ারের পাইলিং শুরু হয় ২০১৭ সালের আগস্টে। ৩৭৭টি পিলারের ওপর নির্মিত উত্তরা-আগারগাঁওয়ের ১১ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার উড়ালপথের কাজ শেষ হয় গত বছরের মার্চে। উড়ালপথের পাশাপাশি রেললাইন, শব্দ প্রতিরোধী দেয়াল, ক্যান্টিলিভার, ওভারহেড ক্যাটেনারি সিস্টেমের কাজ সম্পন্ন হলেও এখনো নিচের সড়কটি আগের অবস্থায় ফেরেনি। কিছু কিছু স্থানে নির্মাণসামগ্রী সরিয়ে সড়কটি যান চলাচলের জন্য স্বাভাবিক করা হলেও এখনো অনেক জায়গায় নির্মাণসামগ্রী সরানো হয়নি। ফলে যান চলাচল বিঘ্নিত হচ্ছে।

মিরপুর-আগারগাঁও সড়কটি ঠিক হতে আরো অন্তত তিন মাস সময় লাগবে বলে জানিয়েছেন ঢাকায় মেট্রোরেল নির্মাণ পরিচালনার দায়িত্বে থাকা সংস্থা ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট ডেভেলপমেন্ট লিমিটেডের (ডিএমটিসিএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক এমএএন ছিদ্দিক। মেট্রোরেলের উড়ালপথ তৈরির কাজ শেষ হওয়া উপলক্ষে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে গতকাল তিনি বলেন, মিরপুর-আগারগাঁও সড়কে রক্ষিত নির্মাণসামগ্রীর বেশির ভাগ আগামী এপ্রিলের মধ্যে সরিয়ে ফেলা সম্ভব হবে। তখন সড়কটিতে যান চলাচল স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরবে। তবে স্টেশন এলাকাগুলোয় যান চলাচল এর পরও কিছুদিন বিঘ্নিত হতে পারে।

মেট্রোরেল প্রকল্পের তথ্য বলছে, উত্তরা-আগারগাঁও অংশের নয়টি স্টেশনের মধ্যে আটটিরই সিংহভাগ কাজ শেষ। অংশে পরীক্ষামূলকভাবে ট্রেন চলাচলও শুরু হয়েছে। তবে নতুন করে যুক্ত হওয়া কিছু অনুষঙ্গের কারণে এসব স্টেশন এলাকায় আরো কিছুদিন নির্মাণকাজ চলমান থাকবে। বিশেষ করে স্টেশনে ওঠা-নামার জন্য এন্ট্রি এক্সিট পয়েন্টের নির্মাণকাজের জন্য সড়ক ব্যবহারকারীদের দুর্ভোগ পোহাতে হবে আরো কিছুদিন।

নতুন অনুষঙ্গ যুক্ত হওয়ার বিষয়টি ব্যাখ্যা করে ডিএমটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, মেট্রোরেলের স্টেশনগুলোয় প্রবেশ বের হওয়ার পথগুলো জনসাধারণের জন্য স্বাচ্ছন্দ্যময় করা হবে। ঢাকার বিদ্যমান গণপরিবহন ব্যবস্থার সঙ্গে সমন্বয় করে ব্যবহারবান্ধব মেট্রোরেল চালুর বিষয়টি মাথায় রেখেই তা করা হবে। যেখানে মেট্রোরেলের স্টেশন থাকবে, সেখানে প্রচুর মানুষের চলাফেরা হবে। কিন্তু ঢাকা শহরের বর্তমানে সড়ক পরিবহন সড়কের যে অবস্থা, তাতে চাপ সামলানো সম্ভব হবে না। নগরীর সব রাস্তা প্রয়োজনীয় মাত্রায় প্রশস্ত না হওয়ায় জমি অধিগ্রহণ করে ফুটপাতসহ সড়ক প্রশস্ত করা হবে।

মেট্রোরেলের আগারগাঁও-মতিঝিল অংশের নির্মাণকাজ শুরু হয় ২০১৮ সালের আগস্টে। অংশের সব পিয়ার তৈরি উড়ালপথ নির্মাণের কাজ শেষ হয়েছে গতকাল। প্রেস ক্লাবের সামনে থাকা মেট্রোরেলের ৫৮২ ৫৮৩ নম্বর পিয়ারের ওপর বসানো হয় উড়ালপথটির সর্বশেষ খণ্ড। এর মধ্য দিয়ে মেট্রোরেলের ২০ দশমিক কিলোমিটার উড়ালপথ প্রস্তুত হয়ে উঠেছে। উড়ালপথের কাজ শেষ হলেও আগারগাঁও-মতিঝিল সড়কটিতে যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক হতে আরো অন্তত এক বছর সময় লাগার কথা জানিয়েছেন ডিএমটিসিএলের কর্মকর্তারা।

তবে উড়ালপথটির কাজ পুরোপুরি শেষ হয়ে যাওয়ায় এখন থেকেই যথাযথ ট্রাফিক পরিকল্পনা গ্রহণের মাধ্যমে সড়ক ব্যবহারকারীদের দুর্ভোগ অনেকটাই কমিয়ে আনা সম্ভব বলে মনে করছেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক . হাদিউজ্জামান। ডিএমটিসিএলের একজন পরিচালক হিসেবেও কাজ করছেন তিনি। অধ্যাপক হাদিউজ্জামান বণিক বার্তাকে বলেন, ঢাকার প্রথম মেট্রোরেল তৈরির ক্ষেত্রে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় আমরা কিন্তু এখন পর্যন্ত বেস্ট প্র্যাকটিস দেখতে পাইনি। তবে এখনো সুযোগ আছে মানুষের দুর্ভোগ কমিয়ে আনার। এজন্য ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার দিকে প্রকল্প কর্তৃপক্ষকে বাড়তি মনোযোগ দিতে হবে। ঢাকায় মেট্রোরেল তৈরির আগে সিটি বাস সার্ভিসটি ঢেলে সাজানো উচিত ছিল। কিন্তু আমরা তা করতে পারিনি। তবে আমি মনে করি, প্রথম মেট্রোরেল তৈরির যে অভিজ্ঞতা, তা প্রকল্প কর্তৃপক্ষ অন্য মেট্রোগুলো তৈরিতে কাজে লাগাবে। জনদুর্ভোগ লাঘবে সর্বোচ্চ প্রাধান্য দেবে। নির্মাণকাজ করবে বেস্ট প্র্যাকটিস অনুযায়ী।

মেট্রোলাইনটি মতিঝিল থেকে কমলাপুর পর্যন্ত বর্ধিত করার কাজ এখনো মাঠ পর্যায়ে শুরু হয়নি। শিগগিরই অংশে মাঠ পর্যায়ে নির্মাণকাজ শুরু হবে বলে জানিয়েছেন প্রকল্পের কর্মকর্তারা। সেক্ষেত্রে মতিঝিল থেকে কমলাপুর পর্যন্ত অংশটির নির্মাণকাজ আরো দীর্ঘ সময়ের জন্য ওই অংশের সড়ক ব্যবহারকারীদের দুর্ভোগে ফেলবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন