বাংলায় হাজার বছর ধরে বসবাস করছে বড়ুয়ারা

সুজিত সাহা, চট্টগ্রাম ব্যুরো

শিক্ষা, সংস্কৃতি ও অর্থনৈতিক দিক থেকে বড়ুয়ারা বেশ সমৃদ্ধ ছবি: নিজস্ব আলোকচিত্রী

বাংলাদেশে বড়ুয়া বলতে মোটা দাগে বাঙালি বৌদ্ধদেরই বোঝায়। যদিও জনগোষ্ঠীটির নিজস্ব স্বতন্ত্র ইতিহাস রয়েছে। বড়ুয়াদের উত্পত্তি প্রাচীন আর্যাবর্তে (উত্তর ভারত) ইতিহাস বলছে, প্রায় হাজার বছর ধরেই জনগোষ্ঠীটি বাংলাদেশে বসবাস করছে। উপমহাদেশের প্রাচীন ষোড়শ (ষোল) মহাজনপদের অন্যতম মগধের (বিহার) বর্জি বংশীয় এক রাজকুমার বহু অনুচরসহ পালিয়ে এসেছিলেন। নবাগত জনগোষ্ঠী বসবাস করতে থাকে কুমিল্লা, নোয়াখালী চট্টগ্রামের বৌদ্ধ অধ্যুষিত অঞ্চলে। কারো কারো মতে, সেটি ছিল বিহার অঞ্চলে বখতিয়ার খিলজির অভিযানের সময়কার ঘটনা। বর্জি বা বড় আর্যের অপভ্রংশ হয়ে মগধ থেকে আসা জনগোষ্ঠী পরিচিত হতে থাকে বড়ুয়া নামে। বড়ুয়াদের আদি ভাষা পালি। পরে স্থানীয় বৌদ্ধদের সঙ্গে তারা মিশে যায়।

তবে বাংলায় বৌদ্ধ ধর্মের বিস্তারের ইতিহাস আরো অনেক পুরনো। গৌতম বুদ্ধের সময়েই অঞ্চলে বৌদ্ধ ধর্মের বিস্তার শুরু হয়েছিল। বড়ুয়ারা যখন বাংলাদেশে আসে, তারও অনেক আগে থেকেই এখানে অসংখ্য বৌদ্ধ বিহার স্থাপনা বিদ্যমান ছিল। কালের পরিক্রমায় ইতিহাসের নানা বাঁক পেরিয়ে বাংলাদেশে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীর সংখ্যা এখন দাঁড়িয়েছে ২৮ লাখের কাছাকাছি। এর মধ্যে অর্ধেকই বাঙালি বৌদ্ধ। বাঙালি বৌদ্ধদেরই বড় একটি অংশ বড়ুয়া।

বর্তমানে বড়ুয়া জনগোষ্ঠীর বসবাস মূলত চট্টগ্রাম পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে। চট্টগ্রামের প্রাচীন আরাকান সড়ক ধরে কক্সবাজারের টেকনাফ পর্যন্ত তারা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। বিশেষ করে কক্সবাজারের রামু উখিয়া উপজেলায় তাদের বসবাস সবচেয়ে বেশি। চট্টগ্রামে সন্দ্বীপ ছাড়া সব উপজেলায়ই বড়ুয়াদের বসবাস রয়েছে। কুমিল্লা, সিলেট পটুয়াখালী জেলায়ও তাদের দেখা যায়। এছাড়া রংপুরের মিঠাপুকুর, সিরাজগঞ্জ, নওগাঁ, কুষ্টিয়া জয়পুরহাটের পাঁচবিবিতে বেশকিছু বড়ুয়া পদবিধারী বসবাস করছে। বাংলাদেশের বাইরে মিয়ানমার ত্রিপুরার কিছু অংশেও জনগোষ্ঠীটির সদস্যদের বসবাস রয়েছে।

শিক্ষা, সংস্কৃতি অর্থনৈতিক দিক থেকে বেশ সমৃদ্ধ বড়ুয়ারা। জাতিগোষ্ঠীটি এতদিন পর্যন্ত আধুনিক বলিষ্ঠ পেশাজীবী শ্রেণী হিসেবেই পরিচিতি পেয়েছে। উচ্চশিক্ষা গ্রহণের মাধ্যমে সরকারি চাকরিতে ঢোকা বা দক্ষ পেশাজীবী হিসেবে সম্মান অর্জন করে নেয়াই তারা প্রাধান্য দিয়েছে বেশি। তবে বর্তমানে তাদের চিন্তাধারায় বড় ধরনের পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। বড়ুয়া তরুণদের মধ্যে অভিবাসন গ্রহণের প্রবণতা এখন অনেক বেড়েছে। উচ্চশিক্ষা বা উন্নত জীবনের জন্য ইউরোপ, আমেরিকাসহ পশ্চিমা বিশ্বের দেশগুলোয় ব্যাপক মাত্রায় অভিবাসন গ্রহণ করছে তারা।

বৌদ্ধ ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্ট বাংলাদেশ বুড্ডিস্ট ফেডারেশনের তথ্য অনুযায়ী, বাঙালি বড়ুয়ারা সবচেয়ে বেশি অভিবাসন গ্রহণ করছে ইউরোপীয় দেশ ফ্রান্স যুক্তরাষ্ট্রে। ফ্রান্সে বর্তমানে পাঁচ হাজারের বেশি বাঙালি বড়ুয়া বসবাস করছে। এছাড়া দেড় দশকে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে সব মিলিয়ে ৫০ হাজার বড়ুয়া অভিবাসী হয়েছে। বিশেষ করে যুক্তরাজ্য, ইতালি, পর্তুগাল, জার্মানি স্পেনে বাঙালি বড়ুয়াদের অভিবাসন গ্রহণের হার দিনে দিনে বাড়ছে। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে অভিবাসন নিয়েছে আরো ৫০ হাজার।

বিষয়ে বাঙালি বৌদ্ধদের একাধিক সংগঠনের নেতারা জানিয়েছে, দেশের বড়ুয়া তথা বাঙালি বৌদ্ধদের মধ্যে সামাজিক সংহতি বেশ সুদৃঢ়। কারণে কখনো কখনো সাম্প্রদায়িক হামলার শিকার হলেও তাদের মধ্যে দেশান্তরী হওয়ার চিন্তা আসেনি। ২০১২ সালে কক্সবাজারের রামুতে বৌদ্ধ বিহারে অগ্নিকাণ্ডসহ সাম্প্রদায়িক একাধিক হামলার পরও পরিবার-পরিজন নিয়ে চিরতরে দেশান্তরী হওয়ার চিন্তা করেনি বাঙালি বড়ুয়ারা। জনগোষ্ঠীর মানুষ শিক্ষা সাংস্কৃতিকভাবে নিজেদের সমৃদ্ধ করার পাশাপাশি আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী করতে সচেষ্ট। মূলত কারণেই বড়ুয়া তরুণদের মধ্যে ইউরোপ পশ্চিমা বিশ্বে অভিবাসনের প্রবণতা বাড়ছে।

বৌদ্ধ ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্টের ভাইস চেয়ারম্যান সুপ্ত ভূষণ বড়ুয়া বিষয়ে বণিক বার্তাকে বলেন, বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যায় বৌদ্ধদের অংশ খুবই নগণ্য। ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে বাঙালি রয়েছে প্রায় অর্ধেক। সংখ্যায় কম হলেও বড়ুয়া তথা বাঙালি বৌদ্ধরা শিক্ষা, সংস্কৃতি অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ। সামাজিক ঐক্যের কারণেই তাদের মধ্যে পিছিয়ে পড়া ব্যক্তিকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়ার প্রবণতা রয়েছে। কারণে পেশাগতভাবে দেশের সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে বড়ুয়া বা বাঙালি বৌদ্ধরা বেশ ভালোও করছে। তাছাড়া বড়ুয়াদের মধ্যে এখন উন্নত বিশ্বে অভিবাসনের প্রবণতা বেড়েছে।

অতীতে বড়ুয়াদের মধ্যে অর্থনৈতিক উন্নতির বিষয়টি নিয়ে বেশ ঔদাসীন্য ছিল। চট্টগ্রাম অঞ্চলে দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করলেও এখানকার কৃষি, মত্স্য, ব্যবসা-বাণিজ্য কিংবা প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহার করে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়ার সুযোগ অতীতে তারা গ্রহণ করেনি। চট্টগ্রাম বন্দরকেন্দ্রিক বাণিজ্য ব্যবসায়িক সম্প্রসারণের বিষয়েও দীর্ঘদিন বেশ নির্লিপ্ত ছিল তারা। পাশ্চাত্য ভাবধারার শিক্ষা গ্রহণেও ছিল বেশ অনীহা। দীর্ঘদিন শুধু নিজস্ব ধর্মীয় শিক্ষায়ই মনোনিবেশ করেছিল তারা। ব্রিটিশ আমলে শিক্ষাকে কাজে লাগিয়ে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা এগিয়ে গেলেও ব্যতিক্রম ছিল বড়ুয়া জনগোষ্ঠী। তবে উনিশ শতকের গোড়ার দিকে এসে বড়ুয়াদের মধ্যে আধুনিক শিক্ষার বিস্তৃতি ঘটে। দেশের প্রথম কোনো বড়ুয়া গ্র্যাজুয়েট হয় ১৯০৮ সালে। এরপর ধীরে ধীরে বৌদ্ধ বিহারকেন্দ্রিক ধর্মীয় শিক্ষা বহুমুখীকরণের মাধ্যমে শিক্ষাক্ষেত্রে বাঙালি বড়ুয়াদের অবস্থান সুদৃঢ় হয়।

পাকিস্তান আমলে তাদের মধ্যে পেশাজীবী প্রবণতা বাড়তে থাকে। বাংলাদেশ আমলে পরিপূর্ণ আধুনিক বলিষ্ঠ পেশাজীবী শ্রেণীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় তারা। বাঙালি বড়ুয়া সম্প্রদায় এখন উচ্চশিক্ষিত অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী একটি গোষ্ঠী।

বিষয়ে সাবেক মন্ত্রী দিলীপ বড়ুয়া বণিক বার্তাকে বলেন, বাঙালি বৌদ্ধরা দেশের ইতিহাসে সুপ্রাচীনকাল থেকে অনন্য ভূমিকা রেখে আসছে। বিভিন্ন পরম্পরায় বৌদ্ধরা অন্যান্য ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মতোই সংঘাত কিংবা সংকটের মুখে পড়েছে। তবে বড়ুয়া বা বাঙালি বৌদ্ধদের মধ্যে আক্রমণ বা নাজেহালের শিকার হলে ভৌগোলিকভাবে স্থানচ্যুত হওয়া বা পালিয়ে যাওয়ার প্রবণতা কম। তবে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য তরুণদের মধ্যে উন্নত বিশ্বে পাড়ি জমানোর ঘটনা সাম্প্রতিককালে বেড়েছে।

বাংলাদেশ বুড্ডিস্ট রিসার্চ অ্যান্ড পাবলিকেশন সেন্টারের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাচ্য ভাষা (পালি সংস্কৃত) বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক জিনবোধি ভিক্ষু বণিক বার্তাকে বলেন, বাঙালি বৌদ্ধরা আবহমানকাল ধরে শিক্ষা, সংস্কৃতি মূল্যবোধকে সঙ্গে করে এগিয়ে চলছে। মাঝে ভৌগোলিক ঐতিহাসিকভাবে কিছুটা সংকট এলেও বাঙালি অবাঙালি বৌদ্ধরা অঞ্চলে শান্তিপ্রিয় সম্প্রদায় হিসেবেই বসবাস করছে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন