বিশ্বায়ন

বৈশ্বিক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার শুরুটা যেভাবে হতে পারে

কৌশিক বসু

কিছুদিন আগে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের গণতন্ত্র সম্মেলনটি ছিল সত্যিকার অর্থেই একটি বৈশ্বিক ঘটনা। তবে সবকিছু যেন অনেকটা সবার অলক্ষ্যেই ঘটে গেল। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে মধ্য ইউরোপ পর্যন্ত গণতন্ত্রের ক্ষয়ে যাওয়া পরিস্থিতির গুরুত্ব উপলব্ধিপূর্বক আমেরিকান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বিশ্বজুড়েগণতন্ত্র সর্বজনীন মানবাধিকারের টেকসই উদ্বেগজনক চ্যালেঞ্জগুলোসম্পর্কে সতর্ক করতে উদ্যোগটি নেন। সম্মেলনের ডাক দিয়ে তিনি সঠিক কাজটাই করেছেন। তবে বিশ্বজুড়ে কর্তৃত্ববাদের উত্থান, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব, প্রাণঘাতী ভাইরাসের বিবর্তন মানবজাতির অস্তিত্বকে হুমকিতে ফেলার যে ঝুঁকি তৈরি করছে, আলোচনায় সেসব অনেকটা এড়িয়ে যাওয়া হয়।

আমাদের মধ্যে অধিকাংশ লোকই উপলব্ধি করে না যে আমাদের সভ্যতা কতগুলো রীতি নিয়মের ওপর প্রতিষ্ঠিত। এর মধ্যে কিছু রীতি নিয়ম সময়ের সঙ্গে সঙ্গে জৈবিকভাবে বিকশিত হয়েছে, বাকি বিষয়গুলো সুচিন্তিত সমন্বিত পদক্ষেপের ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে। নিয়ম নীতিগুলো যে স্তম্ভের ওপর দাঁড়িয়ে, তার মধ্যে একটিও যদি বিন্দুমাত্র সরে যায়, সারা সভ্যতার পতন নিশ্চিত হবে। তাই গণতন্ত্রের প্রতি বর্তমান হুমকি মোকাবেলার প্রচেষ্টা সত্য দিয়ে শুরু করা উচিত যে প্রতিটি অর্থনীতি সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পর্কিত। ড্যারন অ্যাসেমোগ্লু, সায়মন জনসন জেমস রবিনসন যেমন যুক্তি দেখিয়েছেন, দীর্ঘমেয়াদি প্রবৃদ্ধি অন্য যেকোনো কিছুর চেয়ে প্রতিষ্ঠানের ওপরই বেশি নির্ভর করতে পারে। তবে প্রতিষ্ঠানগুলো সবসময় বহির্মুখী আচরণ করে না। যেমন সাংস্কৃতিক বিবর্তনের ক্রমবর্ধমান ক্ষেত্রগুলো আমাদের সামনে তুলে ধরে, মানুষ হচ্ছে অভিযোজিত শিক্ষানবিশ, যে সমাজের বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় নিয়মগুলো ধারণ করতেপ্রায়ই অনিচ্ছাকৃতভাবেসামাজিক শিক্ষার ওপর নির্ভর করে।

একইভাবে অবিনাশ দীক্ষিত সাইমন লেভিন যুক্তি দেন যে আমাদের এমন কিছু পরিকল্পিত শোভন সামাজিক পদক্ষেপ নিতে হবে, যা পরিবর্তনশীল বিশ্বের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে সাহায্য করে। আমরা শিক্ষা সুনির্দিষ্ট ধরনের সম্মিলিত আচরণকে উন্নীত করার জন্য নাগরিক হিসেবে বিবেচনা সিদ্ধান্ত নেয়ার মাধ্যমে কাজটি করতে পারি। ধরনের একটি ঘটনা ঘটেছিল ১৭৮৭ সালে, যখন আমেরিকান রাজ্যগুলোর প্রতিনিধিরা কনফেডারেশনের বিদ্যমান নিবন্ধগুলো সংশোধন করার জন্য ফিলাডেলফিয়ায় একত্র হয়ে মার্কিন সংবিধানের খসড়া তৈরির কাজ শেষ করেছিলেন। পরবর্তী সময়ে তা নতুন দেশের দীর্ঘমেয়াদি প্রবৃদ্ধি সমৃদ্ধির ভিত্তি হয়ে ওঠে। আজ আমরাও ধরনের চ্যালেঞ্জিং পরিস্থিতিতে। কারণ পণ্য, পরিষেবা পুঁজির আন্তঃসীমান্ত প্রবাহ বিশ্বকে অর্থনৈতিকভাবে সমান্তরাল করে। ডিজিটাল প্রযুক্তির দ্রুত অগ্রগতি, বিশেষ করে গত দুই বছরে কভিড-১৯ মহামারীর কারণে এটি অনেক বেশি গতিশীল এবং বড় ধরনের প্রভাব সৃষ্টি করছে। উৎপাদনের বর্ধিত আউটসোর্সিং উগ্র জাতীয়তাবাদের ক্ষেত্রে অবদান রেখেছে। ফলে উত্থান ঘটছে এমন গণতন্ত্রবিরোধী নেতার, যারা জনগণের হতাশাকে পুঁজি করে চলেন। পরিবর্তনগুলো অনেকটা দ্রুততার সঙ্গেই এসেছে, তাই গণতন্ত্র রক্ষার জন্য ইচ্ছাকৃত সম্মিলিত পদক্ষেপ প্রয়োজন। স্বাভাবিক রীতিতে বিকশিত নীতি প্রতিষ্ঠানের জন্য অপেক্ষা করার মতো বিলাসিতার সময় এখন আর আমাদের হাতে নেই।

সৌভাগ্যবশত আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে পদ্ধতিগতভাবে আজ আমরা অনেক বেশি প্রস্তুত। একটি শতাব্দী আগেও আমরা এতটা প্রস্তুত ছিলাম না, প্রযুক্তি বিজ্ঞানে পিছিয়ে ছিলাম। গেম থিওরিযা একটি বিমূর্ত, গাণিতিক শৃঙ্খলা হিসেবে শুরু হয়েছিলএখন সামাজিক বিজ্ঞানের একটি প্রধান বিষয়। অর্থনীতি থেকে রাজনীতি, নৈতিক চুক্তি এমনকি আন্তর্জাতিক সম্মেলন সাংবিধানিক আলোচনায় রয়েছে তা। 

ধরনের কৌশলগত বিশ্লেষণের শক্তি বুঝতে এটি বিবেচনা করা জরুরি যে স্বৈরাচারী নেতা, যেমন তিউনিসিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট জাইন এল আবিদিন বেল আলি, যিনি গণবিদ্রোহের হাতে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন। যদিও বেলারুশের প্রেসিডেন্ট আলেকজান্ডার লুকাশেঙ্কোর মতো কর্তৃত্ববাদী নেতাদের অনেকেই এখনো ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত। একটি দেশের জনগণের মধ্যে অধিকাংশই যখন বিদ্রোহের জন্য তৈরি থাকে, যেমনটা আমরা ২০২০ সালের গ্রীষ্মে বেলারুশে দেখেছিঅভ্যুত্থান দমন করার ক্ষমতা শাসকের সীমিত, তবুও এমন অবস্থায় একজন নেতা কীভাবে জয়ী হতে পারেন বা বিদ্রোহ দমন করতে পারেন।

সমস্যার সমাধান করার জন্য আমি একটি রূপক বা প্রতীকী গেম তৈরি করেছি, যাকে আমি নাম দিয়েছিইনকারসারেশন গেমবা কারাবন্দির খেলা। যেমন কোনো একটি দেশের ১০ লাখ নাগরিক সে দেশের অত্যাচারী নেতাকে উত্খাত করার জন্য বিদ্রোহ করতে ইচ্ছুক। এদিকে স্বৈরাচারী ওই নেতা দেশটির মাত্র ১০০ জন বিদ্রোহী নাগরিককে আটক করে জেলে বন্দি করার ক্ষমতা রাখেন। আটক হওয়ার ক্ষীণ সম্ভাবনা থেকে প্রায় প্রতিটি লোকই রাস্তায় নামতে প্রস্তুত। অবস্থায় নেতার অবস্থা সংগত কারণেই হতাশাজনক।

ধরুন, তবুও ওই নেতা ঘোষণা দিলেন যে বিদ্রোহে অংশগ্রহণকারী ১০০ বয়স্ক ব্যক্তিকে তিনি কারারুদ্ধ করবেন। প্রথম পর্যায়ে মনে হবে তার ঘোষণা বিদ্রোহ দমনে তেমন প্রভাবক হবে না, কারণ বেশির ভাগ তরুণই প্রতিবাদে অংশ নেবেন। কিন্তু বয়সের বিষয়টি যদি গুরুত্ব পায় তাহলে ফলাফলে তারতম্য ঘটবে। নেতার ঘোষণার পর প্রথমত ১০০ জন বয়স্ক লোক সমাবেশে অংশগ্রহণ করবেন না, কারণ শত সুযোগ-সুবিধা থাকলেও কেউই জেলে যেতে রাজি নন। এটা জানার পর বাকি ১০০ জন প্রবীণও আর বিদ্রোহে অংশ নিতে রাজি হবেন না, তাদের দেখাদেখি আরো ১০০ জন বয়স্ক ব্যক্তিও একই পথ অনুসরণ করবেন। এভাবে দেখা যাবে যে কেউই আর বিদ্রোহে অংশ নিচ্ছেন না। রাস্তা মোটামুটি জনশূন্য।

কর্তৃত্ববাদী শাসকদের উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হোক কিংবা অনিচ্ছাকৃত পদ্ধতির ব্যবহার আমাদের ব্যাখ্যা করতে সাহায্য করে যে আগের বিদ্রোহগুলো যখন সাফল্যের দ্বারপ্রান্তে ছিল, তখন তা কেন ভেস্তে গেল। ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট থেকে শুরু করে বেলারুশ কিংবা মিয়ানমারের সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো ব্যাখ্যা করতে আমাদের যে ধরনের তথ্যের প্রয়োজন হবে, তা আমাদের কাছে এখন নেই।ইনকারসারেশন গেমএকটি সম্পূর্ণরূপে যৌক্তিক অনুমান। এটি মূলত গুরুত্ব সহকারে আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে স্বৈরশাসকদের পতনের জন্য, তাদের প্রয়োগকৃত কৌশল ব্যর্থ করার জন্য আমাদের প্রয়োজন অন্য একটি কৌশল। শুধু শোভন উদ্দেশ্যই যথেষ্ট নয়; গণতন্ত্রকে সমুন্নত রাখার জন্য সঠিক বিশ্লেষণের ভিত্তিতে তৈরি কৌশল প্রয়োজন।

তাই কাজে আমরাও অংশ নিতে পারি। বাইডেনের গণতন্ত্র সামিটকে অনুপ্রাণিত করে এমন শোভন সম্মানজনক লক্ষ্য সামনে এগিয়ে নিতে আমরা কৌশলগুলো বিশ্লেষণের মাধ্যমে অগ্রসর হতে পারি। কিছু ক্ষেত্রে বিশ্ব আজও অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষের দিককার আমেরিকার অবস্থায় রয়েছে। আমাদের প্রয়োজন একটি ন্যূনতম বৈশ্বিক সংবিধান, যা আমাদের একগুচ্ছ নিশ্চয়তা দেবে, যেমন মৌলিক মানবাধিকার সংবাদপত্রের স্বাধীনতা এবং কোনো দেশের সরকার যখন মৌলিক নিয়মগুলো লঙ্ঘন করবে তখন অন্য দেশগুলোর হস্তক্ষেপ করার অনুমতি থাকবে। এক্ষেত্রে একটি স্ব-প্রবর্তিত বিশ্বাসী আবহ তৈরি করতে হবে।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হচ্ছে, এমন সর্বজনীন সংবিধানের খসড়া কোনো নির্দিষ্ট দেশের হাতে ছেড়ে দেয়া যাবে না। দেশটি যতই গণতান্ত্রিক শক্তিশালী হোক না কেন। কারণ আমাদের মনে রাখতে হবে এক্ষেত্রে আত্মস্বার্থ সবসময়ই অনুপ্রবেশ করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যদি কাজের দায়িত্ব নেয়, তবে প্রাথমিক উদ্দেশ্য যা- হোক না কেন, তারা বিশ্বকে সাহায্য করার নামে তার নিজস্ব অর্থনৈতিক স্বার্থগুলোই রক্ষা করতে আগ্রহী হবে, যেমনটা এরই মধ্যে করেছে। 

গণতন্ত্রকে পুনরুজ্জীবিত করার লক্ষ্যে নেতৃত্বদানের জন্য বাইডেনের প্রশংসা করা উচিত। তবে সে লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় কৌশল প্রণয়নের জন্য তার একটি স্বায়ত্তশাসিত দল গঠন করতে হবে। এরপর একটি স্বায়ত্তশাসিত বহুপক্ষীয় কর্তৃপক্ষ গঠন করতে হবে, যারা এটি অর্জনে সহায়তা করবে। কাজগুলো করা সহজ হবেএমনটা মনে করাটাই হবে বোকামি। তবে বিষয়টি কিন্তু আমাদের অস্তিত্ব রক্ষার সঙ্গে জড়িত, তাই আমাদের চেষ্টা করারও যথেষ্ট কারণ বিদ্যমান। 

[স্বত্ব:
প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
]

 

কৌশিক বসু: কর্নেল ইউনিভার্সিটির অর্থনীতির অধ্যাপক, বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ভারত সরকারের সাবেক প্রধান অর্থনৈতিক উপদেষ্টা

ভাষান্তর: রুহিনা ফেরদৌস

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন