পাঠক মত

নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার

আর্থসামাজিক উন্নয়নের জন্য অত্যাবশ্যক উপাদানগুলোর অন্যতম হলো জ্বালানি। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ১৬ অনুচ্ছেদের নির্দেশনায় বলা হয়েছে, গ্রাম শহরের জীবনযাত্রার মানের বৈষম্য ক্রমাগতভাবে দূর করার উদ্দেশ্যে গ্রামাঞ্চলে বৈদ্যুতিকীকরণ উন্নয়নের জন্য রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। নির্দেশনা বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ সরকার পর্যায়ক্রমে সারা দেশে বিদ্যুেসবা পৌঁছে দেয়ার জন্য ভবিষ্যৎ কর্মপরিকল্পনা প্রকাশ করে। বিদ্যমান জ্বালানির অবস্থা মূলত গ্যাস, কয়লা, তেল ইত্যাদি জৈব জ্বালানির ন্যায় বাণিজ্যিক জ্বালানির উৎসের প্রাপ্যতার ওপর ভিত্তি করে নির্ধারণ করা হয়।

বিশ্বব্যাপী জ্বালানি খাতের ব্যাপক পরিবর্তন মূলত তিনটি কারণে ঘটছে: () জৈব জ্বালানির প্রাপ্যতা, পরবর্তী দশকগুলোয় ক্রমে নিঃশেষিত হওয়ার সম্ভাবনা এবং সরবরাহ চাহিদার সমন্বয়ের অভাবে মূল্যের ওঠানামা; () জলবায়ু পরিবর্তন রোধকল্পে বৈশ্বিক ধোঁয়া নির্গমন কঠোরভাবে হ্রাস করার প্রয়োজনীয়তা এবং () জ্বালানি নিরাপত্তা। বাংলাদেশে এখনো কার্যকরভাবে নবায়নযোগ্য জ্বালানি সম্পদের বাণিজ্যিক ব্যবহার শুরু হয়নি। ফলে প্রণয়ন করা হয়েছে নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহার সম্পর্কিত জাতীয় নীতিমালা। নবায়নযোগ্য জ্বালানি অর্থে সৌর, বায়ু, বায়োগ্যাস, হাইড্রো, জিওথারমাল, টাইডল ওয়েব ইত্যাদি বোঝায়।

প্রচলিত বায়োগ্যাসের ফরমে নবায়নযোগ্য জ্বালানি বাংলাদেশের প্রাথমিক জ্বালানি উৎসগুলোর অন্যতম, যা ব্যবহূত প্রাথমিক জ্বালানির প্রায় ৩৫-৬০ শতাংশ পূরণ করে। বাংলাদেশের নবায়নযোগ্য জ্বালানি, অর্থাৎ সোলার ফটোভল্টিক, সোলার থারমাল পাওয়ার, বায়ুশক্তি, বায়োগ্যাস ইত্যাদির পরিমাণ অর্থনৈতিক সম্ভাবনা নির্ধারণ করতে হবে। বর্তমানে নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়নের ক্ষমতা খুবই নগণ্য। যদিও নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎপাদন ব্যয় তুলনামূলকভাবে জৈব জ্বালানির খরচ অপেক্ষা অধিক, তা সত্ত্বেও আনুষঙ্গিক সমস্যা, অর্থাৎ পরিবেশের ক্ষতি, স্বাস্থ্য সমস্যা স্বল্প পরিচালনা খরচ বিবেচনা করলে এটি অর্থনৈতিকভাবে সাশ্রয়ী হবে।

সোলার ফটোভলটেইক সিস্টেম সারা দেশে তিন লাখের অধিক পরিবারে ব্যবহার হচ্ছে, যার ক্ষমতা প্রায় ১৫ মেগাওয়াট। উন্নয়ন সহযোগীদের সহায়তায় ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি লিমিটেড, পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি), স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগ (এলজিইডি), বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি) সোলার এনার্জি প্রোগ্রাম বাস্তবায়নের সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন এনজিও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সোলার পিভি সিস্টেম বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। দেশের অভ্যন্তরে সৌরশক্তির ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে।

সোলার থারমাল পাওয়ার/কনসেন্ট্রেটিং সোলার পাওয়ার (সিএসপি) প্রযুক্তির মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য সৌর বিকিরণ আহরণ করে কয়েকটি পর্যায়ের পর চূড়ান্ত পর্যায়ে মেকানিক্যাল এনার্জি উৎপাদনপূর্বক জেনারেটর পরিচালনা করা হয়। দেশে বিদ্যুৎ সরবরাহের ঘাটতি পূরণের জন্য এর প্রচলন করা আবশ্যক। বায়ুশক্তিও বিদ্যুতের ঘাটতি কিছুটা লাঘব করেছে। এটি কেবল জোরালো বাতাস আছে এরূপ উপকূল এলাকা দূরবর্তী দ্বীপগুলোয় কার্যকর থাকে। উপকূল এলাকার বায়ুশক্তির স্থাপনাগুলোর মাধ্যমে বায়ুচালিত পাম্প বিদ্যুৎ সঞ্চালনের চমত্কার সুযোগ রয়েছে। বর্তমানে ফেনী কুতুবদিয়ায় দুই মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনক্ষম বায়ুচালিত টারবাইন রয়েছে।

বাংলাদেশে বায়োম্যাসভিত্তিক বিদ্যুতের অপার সম্ভাবনা রয়েছে। দেশের সহজপ্রাপ্য বায়োম্যাসের উৎসগুলো হলো তুষ, ফসলের অবশিষ্টাংশ, কাঠ, পাটকাঠি, পশুর বর্জ্য, পৌর বর্জ্য, আখের ছোবড়া ইত্যাদি। বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য প্রযুক্তি ব্যাপকভাবে সারা দেশে ছড়িয়ে দেয়া যেতে পারে। পশু পৌর বর্জ্য হতে উত্পন্ন বায়োগ্যাস বাংলাদেশের জন্য একটি প্রতিশ্রুতিশীল নবায়নযোগ্য জ্বালানির উৎস হতে পারে। সারা দেশে বর্তমানে কয়েক হাজার পারিবারিক গ্রামভিত্তিক বায়োগ্যাস প্লান্ট রয়েছে। রান্নাবান্নার কাজে এবং গ্রাম উপশহর এলাকায় বিদ্যুৎ ঘাটতির সময় বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য মৌলিক বায়োগ্যাস প্রযুক্তি একটি সম্ভাবনাময় উৎস।

চট্টগ্রাম চট্টগ্রাম পাহাড়ি এলাকা ব্যতীত বাংলাদেশে মাইক্রো হাইড্রো মিনি হাইড্রোর সম্ভাবনা সীমিত। কয়েকটি স্থানে ১০ মেগাওয়াট থেকে মেগাওয়াট জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের সম্ভাব্যতা চিহ্নিত করা হয়েছে। তবে এখনো উল্লেখযোগ্য স্থাপনা গড়ে তোলা হয়নি। ১৯৬০-এর দশকে স্থাপিত দেশের একমাত্র জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র হলো কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র, যার বর্তমান উৎপাদন ক্ষমতা ২৩০ মেগাওয়াট। অন্যান্য নবায়নযোগ্য জ্বালানির উৎসগুলো হলো বায়োফুয়েল, গ্যাসোহোল, জিওথারমাল, ওয়েভ টাইডাল এনার্জি। এসব উৎসের সম্ভাব্যতা এখনো যাচাই করা হয়নি।

নবায়নযোগ্য জ্বালানি নীতিমালার উদ্দেশ্য হলো: () নবায়নযোগ্য জ্বালানি সম্পদের সম্ভাবনাকে কাজে পরিণত করা এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানি প্রযুক্তি গ্রামাঞ্চল, উপশহর শহর এলাকায় ছড়িয়ে দেয়া; () নবায়নযোগ্য জ্বালানি প্রকল্পে সরকারি বেসরকারি উভয় খাতের বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সহায়তা করা, উৎসাহ জোগান এবং সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টি করা; () দেশীয় অনবায়নযোগ্য জ্বালানি সরবরাহের বিকল্প হিসেবে টেকসই জ্বালানি সরবরাহের উন্নয়ন করা; () বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে নবায়নযোগ্য জ্বালানি কতটুকু অবদান রাখতে পারে তা নির্ধারণ করা; () বিদ্যুৎ তাপশক্তি উভয়ের ক্ষেত্রে নবায়নযোগ্য জ্বালানি কতটুকু অবদান রাখতে পারে তা নির্ধারণ করা; () নবায়নযোগ্য জ্বালানি যথাযথ, কার্যকর পরিবেশবান্ধব হিসেবে ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ করা; () জ্বালানি ব্যবহারের প্রতিটি ক্ষেত্রে নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের প্রশিক্ষণ সুযোগ সৃষ্টি করা; () নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের ক্ষেত্রে উৎসাহ দেয়ার জন্য উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টি আইনি সহায়তা দেয়া; () নবায়নযোগ্য জ্বালানির ক্ষেত্রে স্থানীয় প্রযুক্তি উন্নয়নে উৎসাহ দেয়া; (১০) পরিশুদ্ধ জ্বালানি ব্যবহারে উৎসাহ দেয়া; (১১) মোট বিদ্যুৎ চাহিদার শতকরা ১০ ভাগ নবায়নযোগ্য জ্বালানির উৎস হতে মেটানোর লক্ষ্যমাত্রা স্থির করা।

এছাড়া টেকসই জ্বালানি ব্যবস্থার উন্নয়ন প্রসারের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে সাসটেইনেবল এনার্জি ডেভেলপমেন্ট এজেন্সি নামে একটি প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠিত করা হবে, যার দায়িত্ব বিভিন্ন এজেন্সি বা সংস্থার কার্যাবলির সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে কর্মপরিকল্পনাসহ টেকসই জ্বালানি পরিকল্পনায় সমন্ব্বয় করা, নবায়নযোগ্য জ্বালানি এবং অন্যান্য বিশুদ্ধ জ্বালানি প্রযুক্তি বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি করা এবং জাতীয় জ্বালানি নীতিমালা উন্নয়নের ক্ষেত্রে সার্বিক উন্নয়ন সুসংহতকরণ, নবায়নযোগ্য জ্বালানি এবং অন্যান্য বিশুদ্ধ জ্বালানি প্রযুক্তি বিষয়ে নতুন নতুন প্রযুক্তি এবং নতুন ব্যবসার মডেল প্রদর্শন, ক্ষুদ্র মাঝারি ধরনের নবায়নযোগ্য জ্বালানি শিল্প প্রতিষ্ঠায় এবং সরবরাহকারীদের সহায়তা দেয়া।

জ্বালানি নিরীক্ষার মাধ্যমে নবায়নযোগ্য জ্বালানি প্রকল্পের পদ্ধতিগত উন্নয়ন সুযোগ-সুবিধা প্রদান, বাজারের সুযোগ সৃষ্টি বাংলাদেশে টেকসই জ্বালানি প্রযুক্তির সুবিধা সৃষ্টি এবং এনার্জি সার্ভিস কোম্পানি এবং রুরাল জ্বালানি প্রোভাইডারের ন্যায় ব্যবসাসংক্রান্ত মডেল স্থাপন করা, সব প্রকার নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে সরকারি বেসরকারি বিনিয়োগের জন্য মঞ্জুরি, ভর্তুকি এবং তহবিল ব্যবহারের মাধ্যমে আর্থিক দক্ষতা বা সুযোগ-সুবিধার উন্নয়ন, বিশেষত পল্লী জ্বালানি মহাপরিকল্পনার ক্ষেত্রে নবায়নযোগ্য জ্বালানি সম্পদসংক্রান্ত উপাত্ত সংগ্রহ এবং মূল্য নির্ধারণ করা।

সাধারণ জ্বালানি বিদ্যুৎ ব্যবহারের চাহিদা পূরণের উদ্দেশ্যে প্রণীত নবায়নযোগ্য জ্বালানির আপেক্ষিক অবস্থার উন্নয়নের লক্ষ্যে তহবিল জোগান দেয়া, যেমন যান্ত্রিক সেচের জন্য সৌর, বায়োগ্যাস বায়োডিজেল, বন ব্যবস্থাপনা তহবিল ব্যবহারের মাধ্যমে জ্বালানি কাঠের ব্যবহারের বিকল্প তৈরি করা, টেকসই জ্বালানি প্রযুক্তি, যেমন উন্নত চুলা পারিবারিক বায়োগ্যাস প্লান্টের বাজার উন্নয়নে উৎসাহ প্রদান, নবায়নযোগ্য জ্বালানি প্রযুক্তির গবেষণা উন্নয়নে আর্থিক সহায়তা প্রদান, নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহার হতে উদ্ভূত পরিবেশগত নীতিমালাগুলো বাস্তবায়ন এবং গ্রিডের সঙ্গে সংযুক্ত হবে ধরনের নবায়নযোগ্য জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প প্রক্রিয়াকরণ।

বিশ্বের অধিকাংশ দেশই নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহারে আগ্রহী হলেও কিছু ক্ষেত্রে নবায়নযোগ্য শক্তিকে সমালোচনা সহ্য করতে হয়। যেমন নবায়নযোগ্য শক্তির খরচ অনেক বেশি এবং এটি অনেক বেশি প্রকৃতিনির্ভর তথা পরিবর্তনশীল। এছাড়া কিছু নবায়নযোগ্য শক্তি, যেমন সৌরশক্তি, বায়োম্যাসের জন্য তুলনামূলক অনেক জায়গার প্রয়োজন হয় বলে মনে করেন অনেকে। যদিও বর্তমানে দেখা যাচ্ছে ক্রমাগত গবেষণা রাষ্ট্রীয় সহযোগিতার ফলে নবায়নযোগ্য সৌরবিদ্যুতের দাম কমে এসেছে। নবায়নযোগ্য শক্তির পরিবর্তনশীলতার জন্য মানানসই ব্যাটারি ব্যবস্থার দ্রুত উন্নতি হচ্ছে এবং অনেক দেশই স্মার্ট গ্রিড পদ্ধতি স্থাপন করছে। তবে জীবাশ্ম জ্বালানি যেহেতু সীমিত, তাই ভবিষ্যতের জ্বালানি ব্যবস্থা নির্ভর করবে নবায়নযোগ্য শক্তির ওপরে। এছাড়া জলবাযু পরিবর্তন পরিবেশ দূষণের জন্য জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর মানুষ আস্থা রাখতে পারছে না এবং ক্রমান্বয়ে নবায়নযোগ্য শক্তি জনপ্রিয়তা লাভ করছে।

 

মো. আরাফাত রহমান: সহকারী কর্মকর্তা, ক্যারিয়ার অ্যান্ড প্রফেশনাল ডেভেলপমেন্ট সার্ভিসেস বিভাগ

সাউথ ইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন