যুক্তরাজ্যের রিবা পুরস্কার জিতেছে সাতক্ষীরার ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতাল

তরুণ স্থপতিদের অনুপ্রেরণার উৎস হোক

সম্প্রতি যুক্তরাজ্যভিত্তিক রয়্যাল ইনস্টিটিউট অব ব্রিটিশ আর্কিটেক্টসের (রিবা) ২০২১ সালের বিশ্বসেরা নতুন ভবনের পুরস্কার জিতেছে সাতক্ষীরার ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতাল। বিশ্বজুড়ে উদাহরণ সৃষ্টিকারী সমাজে ইতিবাচক প্রভাব রাখে এমন স্থাপত্যকেই রিবা পুরস্কার দেয়া হয়। আলোচ্য পুরস্কার অর্জনের মাধ্যমে বাংলাদেশেও যে আন্তর্জাতিক মানের স্থাপত্য চর্চা হচ্ছে, তার স্বীকৃতি এটি। এতে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়েছে। পরিবেশ-পরিস্থিতি ঐতিহ্যের মেলবন্ধনে সমকালীন স্থাপত্য নির্মাণের যে উদাহরণ কাশেফ মাহবুব চৌধুরী স্থাপন করেছেন, তা তরুণ স্থপতিদের অব্যাহত অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকুক।

দেশে আধুনিক স্থাপত্য রীতির চর্চা শুরু হয় মূলত পঞ্চাশের দশকে। এর সূচনা স্থপতি মাযহারুল ইসলামের হাত ধরে। বর্তমান চারুকলা অনুষদ ভবন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারের স্থাপত্য নকশা প্রণয়নের মধ্য দিয়ে আধুনিক ধারার প্রবর্তন তিনিই এককভাবে করেছিলেন। তিনি যথার্থভাবেই পশ্চিমা ধারণার আধুনিক স্থাপত্যের সঙ্গে অঞ্চলের জনগণের আকাঙ্ক্ষা, দেশীয় নির্মাণ উপকরণ, আমাদের অতি চেনা উঠান বারান্দা ইত্যাদির সঙ্গে যে সৃষ্টিশীল সমন্বয় করেছিলেন, তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত চারুকলা ভবন। এরপর ষাটের দশকের দিকে বিদেশী স্থপতিদের নির্মিত কিছু উল্লেখযোগ্য কাজ হয়। তারাই প্রকৃতপক্ষে এখানকার স্থাপত্যের উন্নয়ন দিকনির্দেশনামূলক স্থাপত্য উপহার দেন। যদিও তাদের কেউ কেউ স্থানীয় প্রেক্ষিতকে উপেক্ষা করেছিলেন। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা লাভের পর যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের সত্তর দশকে তেমন নতুন কোনো উল্লেখযোগ্য কাজ সম্পাদন করা কঠিন হয়ে পড়ে। তার মধ্যেই ধ্বংসপ্রাপ্ত শহীদ মিনার পুনর্নির্মাণ, জাতীয় স্মৃতিসৌধসহ বেশকিছু কাজের উদ্যোগ নেয়া হয়। তবে আশির দশক থেকেই দেশে উন্নয়নমূলক বেশকিছু উল্লেখযোগ্য কাজ শুরু করা হয়। এসব স্থাপত্য নির্মাণে দেশের নব্য শিক্ষিত স্থপতিরাই এগিয়ে আসে। এরই ধারাবাহিকতায় জোরালো নগরায়ণের সুবাদে সাম্প্রতিক সময়ে স্থানীয় প্রেক্ষিত সময় বিবেচনায় নতুন ধরনের স্থাপত্য চর্চা শুরু হয়, যার কয়েকটি বর্তমানে আন্তর্জাতিক পরিসরে সমাদৃত হচ্ছে।

আমরা দেখেছি কয়েক বছর আগে সুলতানি আমলের স্থাপত্যের আদলে তৈরি বায়তুর রউফ মসজিদ এবং বাংলার বৌদ্ধবিহার মহাস্থানগড়ের ছাপ থাকা ফ্রেন্ডশিপ সেন্টার দুনিয়ায় খ্যাতিজোড়া আগা খান স্থাপত্য পুরস্কার পেয়েছে, যা বাংলাদেশের জন্য অনন্য সম্মানের। এর আগে বাংলাদেশের তিনটি স্থাপত্য পুরস্কার জিতলেও সেগুলোর স্থপতিরা ছিলেন বিদেশী। বেশ কয়েকবার বাংলাদেশী স্থপতিরা চূড়ান্ত মনোনয়ন পেলেও পুরস্কার পাওয়া আর হয়ে ওঠেনি। দীর্ঘদিন পর সে বন্ধ্যত্ব ঘোচালেন উল্লিখিত দুই ভবনের স্থপতি। তাদের কাজে টেকসই সবুজ স্থাপত্যের ব্যবহার করেছেন তারা। সূর্যের আলো-বাতাসকে কাজে লাগিয়েছেন। ঐতিহ্যের আলোকে সমকালীন স্থাপত্য বিনির্মাণ করেছেন। ধারারই নতুন সংযোজন ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতাল। বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় উত্তীর্ণ হয়ে নিজস্ব স্থাপত্যগুণে ভবনটি জিতেছে রিবা পুরস্কার। এটা আমাদের জন্য আনন্দের গর্বের।

ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতাল সময় প্রকৃতি উপযোগী স্থাপত্যের চমত্কার উদাহরণ। সাতক্ষীরা অঞ্চলে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব পড়েছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ায় শস্যক্ষেত তলিয়ে যাচ্ছে, সেগুলো চিংড়ি ঘেরে পরিণত হচ্ছে। শুধু তা- নয়, ভূ-পৃষ্ঠে যে পানি আছে তা আরো লবণাক্ত হচ্ছে। সংগত কারণে ওই অঞ্চলের মানুষ বর্ষার সময় বৃষ্টির পানি ধরে রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেন। স্থপতির ভাষায়, তাই তিনি এমনভাবে ভবনটির নকশা করেছেন, যাতে বৃষ্টির পানি এতে ধরে রাখা সম্ভব হয়। হাসপাতালের আঙিনা, ভবনের ছাদ থেকে পানি যাতে এক খালে যেতে পারে, সেই ব্যবস্থা করা হয়েছে। আর কৃত্রিম খাল গিয়ে ঠেকেছে জলাধারে। এতে হাসপাতালটিতে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের জন্য জ্বালানির সাহায্য নিতে হচ্ছে না। পানির কারণে গ্রীষ্মের সময় ভবন এর আশপাশের এলাকা ঠাণ্ডা থাকছে। মানুষ প্রকৃতির কথা মাথায় রেখে যে দৃষ্টিনন্দন স্থাপনা হতে পারে হাসপাতালটি তারই প্রকৃষ্ট দৃষ্টান্ত। এটা নতুন প্রজন্মকে ভালো কাজ করতে অনুপ্রেরণা জোগাবে বৈকি।

সৃজনশীল কাজের মাধ্যমে নতুনরা স্থাপত্যে নতুন পথের সন্ধান দিচ্ছে। এটা সর্বতো পৃষ্ঠপোষকতা জোগাতে হবে। সময়োপযোগী স্থাপনা নির্মাণে দেশীয় স্থপতিদের কাজে লাগাতে হবে। উদ্ভাবনীমূলক কাজের পরিসর তৈরি করে দিতে হবে। বর্তমানে স্থাপত্য জন ডিসকোর্সে পরিণত হয়েছে। নকশা, অবয়ব, উপকরণ, রীতি প্রভৃতি বিষয়ে চলছে তর্ক-বিতর্ক। এগুলোকে উৎসাহিত করতে হবে। এটা সরকারের যেমন দায়িত্ব, তেমনি ব্যক্তি খাতেরও এক্ষেত্রে করণীয় রয়েছে। সরকারি-বেসরকারি যৌথ প্রয়াসে চলমান স্থাপত্য ধারাকে এগিয়ে নিতে হবে। 

গত এক দশকে বাংলাদেশের স্থপতিদের বেশকিছু উল্লেখযোগ্য আন্তর্জাতিক পুরস্কার প্রাপ্তি ধারণাকে অনেকখানি যৌক্তিকতা দেয় যে আমাদের অনেক স্থপতিই আন্তর্জাতিক মানের স্থাপত্য দেশেই সৃষ্টি করেছেন। তারই সাম্প্রতিক প্রতিরূপ ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতাল। অর্থনৈতিক উন্নয়ন, বিশ্বের সঙ্গে বাংলাদেশের মানুষের যোগাযোগ এবং বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ডের প্রসার, অভ্যন্তরে নির্মাণ উপকরণ উৎপাদন এবং বিদেশী নানা নির্মাণ উপকরণের সহজলভ্যতা স্থাপত্যকে অনেক দূর এগিয়ে দিয়েছে। অর্থনৈতিক উন্নয়ন সরাসরি স্থাপত্যে প্রভাব ফেলেছে। স্বল্পোন্নত দেশ থেকে মধ্যম আয়ের দেশ হতে চলেছে বাংলাদেশ। অগ্রযাত্রা চলমান থাকলে দেশীয় স্থাপত্য যে বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যাবে, তাতে সন্দেহ নেই।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন