মোবাইল টেলিকম অপারেটরদের আরওই

শেয়ারহোল্ডারদের বিনিয়োগের বিপরীতে বিশ্বে মুনাফায় শীর্ষে গ্রামীণফোন

মেহেদী হাসান রাহাত

কোনো কোম্পানির নিট আয়কে শেয়ারহোল্ডারদের মোট বিনিয়োগ দিয়ে ভাগ করে পাওয়া অনুপাতকে বলা হয় রিটার্ন অন ইকুইটি (আরওই) বা শেয়ারহোল্ডারদের বিনিয়োগের বিপরীতে মুনাফা। কোম্পানির মুনাফা অর্জনের সক্ষমতা বা দক্ষতা অনুধাবনে বিশ্বব্যাপী বিনিয়োগকারীদের বিবেচ্য বিষয়গুলোর অন্যতম হলো আরওই। বাজারে প্রতিযোগিতা বেশি হলে কোম্পানির মুনাফার সঙ্গে সঙ্গে আরওই বাড়ানোটাও বেশ কঠিন হয়ে পড়ে।

গোটা বিশ্বেই টেলিকম শিল্প অত্যন্ত প্রতিযোগিতামূলক একটি খাত। এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কোম্পানিগুলোর আরওইর হারও অন্যান্য খাতের কোম্পানিগুলোর তুলনায় বেশ কম। বিশ্বের শীর্ষ অর্থনীতির দেশ যুক্তরাষ্ট্রে টেলিযোগাযোগ খাতের আরওই দশমিক ৯৩ শতাংশ। খাতে দেশটির সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠান এটিঅ্যান্ডটির আরওই ১৪ দশমিক ৪০ শতাংশ। পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলোয় টেলিকম খাতের গড় আরওই দশমিক ১৬ শতাংশ। যুক্তরাজ্যের সবচেয়ে বড় টেলিকম অপারেটর ভোডাফোনের ক্ষেত্রে হার দশমিক ৫৫ শতাংশ। প্রতিবেশী ভারতে প্রতিযোগিতার মাত্রা অনেক বেশি হওয়ায় সেখানকার কোনো কোনো কোম্পানির জন্য আরওই ধনাত্মক সংখ্যায় নিয়ে আসাটাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছে। ২০১৭-১৮ সালে দেশটির টেলিযোগাযোগ খাতের কোম্পানিগুলোর আরওইর ভারিত গড় ছিল ঋণাত্মক, দশমিক ৫৯ শতাংশে। দেশটির খাতের বৃহৎ প্রতিষ্ঠান এয়ারটেল ভারতীর আরওই ঋণাত্মক ২২ দশমিক ১৭ শতাংশ। রিলায়েন্সের ক্ষেত্রে হার আবার ২০ দশমিক শতাংশ।

দেশের শীর্ষ টেলিকম অপারেটর গ্রামীণফোন শেয়ারহোল্ডারদের বিনিয়োগের বিপরীতে মুনাফার হারের দিক থেকে প্রতিষ্ঠানগুলোর সবকটিকেই ছাড়িয়ে গিয়েছে। গ্রামীণফোনের আর্থিক প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, গত পাঁচ বছরে কোম্পানিটির আরওই ছিল বেশ আকর্ষণীয়। এর মধ্যে ২০১৬ সালে কোম্পানিটির আরওই ছিল ৭২ শতাংশ। ২০১৭ সালে এটি বেড়ে দাঁড়ায় ৮৪ শতাংশে। ২০১৮ সালে গ্রামীণফোনের আরওই ছিল ৯৮ শতাংশ। ২০১৯ সালে এটি কিছুটা কমে ৯২ শতাংশে দাঁড়ায়। সর্বশেষ ২০২০ সালে কোম্পানিটির আরওই ছিল ৮২ শতাংশ। বৈশ্বিক টেলিকম খাতের নানা পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, আরওইর দিক দিয়ে এখন গোটা বিশ্বেই অন্যতম শীর্ষস্থানে রয়েছে গ্রামীণফোন।

শক্তিশালী নেটওয়ার্ক উন্নত সেবা প্রদানের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ১৯৯৭ সালে দেশে যাত্রা শুরু হয় গ্রামীণফোন লিমিটেডের। বড় অংকের বিনিয়োগ আর নেটওয়ার্ক সক্ষমতায় এগিয়ে থাকায় গ্রাহক আকৃষ্ট করতে সক্ষম হয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। বর্তমানে কোটি ৪০ লাখের বেশি গ্রাহক নিয়ে দেশের শীর্ষ টেলিকম অপারেটর গ্রামীণফোন। অবশ্য দিন যত গড়িয়েছে অপারেটরটির সেবার মান ক্রমেই কমেছে। কলড্রপ আর নেটওয়ার্ক সমস্যা নিয়ে গ্রাহকদের অভিযোগের শেষ নেই অপারেটরটির বিরুদ্ধে। সেবা নিয়ে গ্রাহক অসন্তুষ্টি থাকলেও প্রতিষ্ঠানটি দেশের বাজার থেকে প্রতি বছরই বড় অংকের মুনাফা করছে।

গ্রাহক সংখ্যায় শীর্ষে থাকার সুবাদে বাংলাদেশের বাজারে গ্রামীণফোনের ব্যবসা মুনাফা দুটোই ক্রমেই স্ফীত হচ্ছে। এর মধ্যে ২০১৬ সালে কোম্পানিটি ১১ হাজার ৪৮৬ কোটি টাকা আয়ের বিপরীতে হাজার ১৭২ কোটি টাকার কর-পরবর্তী মুনাফা করেছে। ২০১৭ সালে কোম্পানিটির আয় হয়েছে ১২ হাজার ৮৪৩ কোটি টাকা এবং এর বিপরীতে মুনাফা ছিল হাজার ৬১৪ কোটি টাকা। ২০১৮ সালে ১৩ হাজার ২৮৩ কোটি টাকা আয়ের বিপরীতে কোম্পানিটির হাজার ৩৩৬ কোটি টাকা কর-পরবর্তী মুনাফা হয়েছে। ২০১৯ সালে কোম্পানিটির আয় হয়েছে ১৪ হাজার ৩৬৫ কোটি টাকা এবং এর বিপরীতে মুনাফা ছিল হাজার ৪৫১ কোটি টাকা। সর্বশেষ ২০২০ সালে ১৩ হাজার ৯৬০ কোটি টাকা আয়ের বিপরীতে হাজার ৭১৮ কোটি টাকা মুনাফা হয়েছে গ্রামীণফোনের।

গ্রামীণফোনের মূল উদ্যোক্তা টেলিনর ইউরোপের নরডিক অঞ্চল এশিয়ার টেলিযোগাযোগ খাতের শীর্ষ কোম্পানি। ২০২০ সালে দুই অঞ্চলে হাজার ৪০০ কোটি ডলারের ব্যবসা করেছে টেলিনর গ্রুপ। ওই সময় প্রতিষ্ঠানটির আরওই ছিল ৩৬ দশমিক শতাংশ। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবসায়িক ব্যাপ্তির দিক থেকে নরওয়ে থাইল্যান্ডের পরই বাংলাদেশের অবস্থান। ব্যবসার আকারের দিক দিয়ে তৃতীয় স্থানে থাকলেও ২০১৯ সালে টেলিনরের কর-পূর্ববর্তী মুনাফা সবচেয়ে বেশি হয়েছে বাংলাদেশেই। প্রতিষ্ঠানটির বিভিন্ন আর্থিক প্রতিবেদন বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত দুই বছর (২০১৯ ২০২০) টেলিনরের কর, সুদ, অবচয় অবলোপন পূর্ববর্তী মুনাফার (ইবিআইটিডিএ) উৎস হিসেবে বাংলাদেশ ছিল দ্বিতীয় সর্বোচ্চ অবস্থানে। তবে দুই বছরেই গ্রুপটির ইবিআইটিডিএ মার্জিন (মোট রাজস্ব আয়ে ইবিআইটিডিএর হার) এখানেই হয়েছে সবচেয়ে বেশি।

অন্যদিকে লাভজনক হলেও বাংলাদেশেই টেলিনরের লাইসেন্স স্পেকট্রামসহ মূলধনি ব্যয় হয়েছে তুলনামূলক কম। বাবদ টেলিনরকে সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় নরওয়েতে ৬৪৯ কোটি ৫৬ লাখ ক্রোনার। এরপর থাইল্যান্ডে ৪২১ কোটি লাখ পাকিস্তানে ২৪১ কোটি ৬২ লাখ ক্রোনার খাতে ব্যয় করতে হয়। অন্যদিকে বাংলাদেশে মূলধনি খাতে ২০১৯ সালে টেলিনরের ব্যয় হয়েছে ১৯০ কোটি ১৬ লাখ ক্রোনার।

২০২০ সালে গ্রামীণফোন ফোরজি, নেটওয়ার্কের আওতা সম্প্রসারণ, ডাটা ভয়েস কলের সক্ষমতা বাড়াতে হাজার ৩৮০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে। গত বছরের মার্চে আরো ১০ দশমিক মেগাহার্টজ স্পেকট্রাম কিনতে কোম্পানিটি ৪৩ কোটি ৫৫ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেছে। এক্ষেত্রে প্রথমে ২৫ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিতে হয়েছে আর বাকি অর্থ পাঁচটি সমান কিস্তিতে পরিশোধ করতে হবে।

সাম্প্রতিক সময়ে সেলফোন যোগাযোগ সেবায় কলড্রপ দুর্বল নেটওয়ার্কের মতো সমস্যাগুলো অনাকাঙ্ক্ষিত মাত্রায় প্রকট হয়ে উঠেছে। অতিরিক্ত মূল্য মানহীনতার অভিযোগ রয়েছে মোবাইল অপারেটরদের ইন্টারনেট সেবার ক্ষেত্রেও। এসব সমস্যা প্রকট করে তোলার ক্ষেত্রে অপ্রতুল তরঙ্গ বরাদ্দকে দায়ী করছেন টেলিকম খাতসংশ্লিষ্টরা। বিষয়টি স্বীকার করছে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনও (বিটিআরসি) জাতীয় সংসদের সরকারি প্রতিষ্ঠান কমিটির সর্বশেষ সভায় -সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদনও দিয়েছে বিটিআরসি। এতে উঠে এসেছে, প্রতি মিলিয়ন ( মিলিয়ন = ১০ লাখ) গ্রাহকের বিপরীতে অপারেটরদের জন্য বরাদ্দকৃত তরঙ্গের হিসাবে এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলে বাংলাদেশের অবস্থান একেবারে নিচের দিকে।

বিটিআরসি উত্থাপিত প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, বাংলাদেশে জনঘনত্ব অনেক বেশি হলেও এর বিপরীতে সেলফোন অপারেটরদের জন্য বরাদ্দকৃত স্পেকট্রাম অনেক কম। এতে মানসম্মত গতিশীল মোবাইল ইন্টারনেট সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে গ্রাহক। দেশে প্রতি মিলিয়ন গ্রাহকের জন্য অপারেটরদের অনুকূলে বরাদ্দকৃত তরঙ্গের পরিমাণ দশমিক ৮৯ মেগাহার্টজ। যদিও আরো অনেক কম জনঘনত্বের দেশ কম্বোডিয়ায় এর পরিমাণ ১৩ দশমিক ৯৮ মেগাহার্টজ। এছাড়া প্রতি মিলিয়ন গ্রাহকের বিপরীতে ইন্দোনেশিয়ায় দশমিক ৭৭ মেগাহার্টজ, মালয়েশিয়ায় দশমিক ৪৯, নেপালে দশমিক ৯৪ শ্রীলংকায় ১০ দশমিক ৮১ মেগাহার্টজ তরঙ্গ অপারেটরদের অনুকূলে বরাদ্দ দেয়া রয়েছে।

বিটিআরসির সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, দেশে সেলফোন নেটওয়ার্ক সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে গ্রাহক সংখ্যায় সবচেয়ে এগিয়ে গ্রামীণফোন লিমিটেড। কোটি ৪০ লাখ ৪০ হাজার গ্রাহকের বিপরীতে কোম্পানিটির জন্য বরাদ্দকৃত তরঙ্গের পরিমাণ ৪৭ দশমিক মেগাহার্টজ। রবি আজিয়াটা লিমিটেডের কোটি ৩৭ লাখ ২০ হাজার গ্রাহকের বিপরীতে বরাদ্দকৃত তরঙ্গের পরিমাণ ৪৪ মেগাহার্টজ। বাংলালিংক ডিজিটাল কমিউনিকেশনস লিমিটেডের কোটি ৭২ লাখ ১০ হাজার গ্রাহকের বিপরীতে তরঙ্গের পরিমাণ ৪০ মেগাহার্টজ টেলিটক বাংলাদেশ লিমিটেডের ৬৫ লাখ ৬০ হাজার গ্রাহকের বিপরীতে বরাদ্দকৃত তরঙ্গের পরিমাণ ২৫ দশমিক মেগাহার্টজ।

সার্বিক বিষয়ে গ্রামীণফোনের বক্তব্য জানার জন্য যোগাযোগ করা হলেও প্রতিষ্ঠানটির আনুষ্ঠানিক কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

দেশের টেলিযোগাযোগ খাতের সেবার মান নিয়ে গ্রাহক অসন্তুষ্টির অভিযোগ বেশ পুরনো। গ্রাহক সংখ্যা বাড়ার বিপরীতে অপারেটরদের সেবার মান ক্রমেই কমছে। বৈশ্বিক মোবাইল কানেক্টিভিটি নিয়ে ওপেন সিগন্যালের করা সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনেও দেশের মোবাইল নেটওয়ার্ক সেবার দৈন্যদশা উঠে এসেছে। গ্রাহক সংখ্যায় শীর্ষ দুই প্রতিষ্ঠান গ্রামীণফোন রবি সেবার দিক দিয়ে অন্যদের তুলনায় পিছিয়ে রয়েছে। গত দুই বছরে গ্রাহকদের কাছ থেকে মোবাইল অপারেটরদের বিরুদ্ধে বিটিআরসির কাছে সাড়ে ৪২ হাজার অভিযোগ জমা পড়েছে। এর মধ্যে সেবার মানে অসন্তুষ্টি নিয়ে অভিযোগ এসেছে ২৫ হাজার ৯৫টি। সিম বার, এমএনপি, ডাটা স্পিড নিয়ে অভিযোগ এসেছে ১৭ হাজার ৪৯২টি। ২০১৯ সালের জুলাই থেকে গত বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত দুই বছরে অভিযোগ বিটিআরসির কাছে জমা পড়েছে।

বিষয়ে জানতে চাইলে বিটিআরসির ভাইস চেয়ারম্যান সুব্রত রায় মৈত্র বণিক বার্তাকে বলেন, অপারেটরগুলো বাজার ধরার দিকে যেভাবে নজর দিয়েছে গ্রাহকদের উন্নত সেবা দেয়ার দিকে সেভাবে নজর দেয়নি। পাশাপাশি তারা সেভাবে বিনিয়োগও করেনি। বিষয়গুলো নিয়ে আমরা কাজ করছি। গ্রাহক সেবার মানোন্নয়নে নিয়মিত অপারেটরদের সঙ্গে আলোচনা হচ্ছে। সম্প্রতি অপারেটরগুলো নতুন করে স্পেকট্রাম কিনেছে। টাওয়ার শেয়ারিং সংক্রান্ত সমস্যারও সুরাহা হয়েছে। কিছুটা সময় লাগলেও আশা করছি পরিস্থিতির উন্নতি হবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন