সম্প্রতি প্রকাশ হয়েছে বার্লিনভিত্তিক ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (টিআই) পরিচালিত ২৭তম দুর্নীতি ধারণা সূচক (সিপিআই)। এ সূচকে নিম্নক্রমের দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান এক ধাপ এগিয়েছে। তবে স্কোরের (১০০-এর মধ্যে ২৬) দিক থেকে টানা চার বছর একই জায়গায় অবস্থান করছে। দেশে উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়ন হয়েছে। অবকাঠামো, যোগাযোগ ব্যবস্থায় এসেছে দৃশ্যমান পরিবর্তন। কিন্তু দুর্নীতি এখনো একটা বড় দুশ্চিন্তার বিষয় হিসেবে রয়ে গেছে। ধারাবাহিকভাবে বাংলাদেশ সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশগুলোর তালিকার নিচের দিকেই থাকছে। এবারো তার ব্যতিক্রম হয়নি। এটা দুর্নীতির উদ্বেগজনক চিত্রই তুলে ধরে। দেশে আয় ও সম্পদের বৈষম্য বেড়ে ওঠার পেছনে দুর্নীতি একটি বড় কারণ। এতে উন্নয়নের সুফল সমাজে সঠিকভাবে বণ্টিত হচ্ছে না। দুর্নীতি প্রতিরোধে সরকারের আরো কঠোর অবস্থান কাম্য।
২০১৮ সালে সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ইশতেহার প্রকাশ উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী দুর্নীতির বিরুদ্ধে শূন্য সহনশীলতা ঘোষণা করেছিলেন। মন্ত্রিসভা গঠনের পর তিনি মন্ত্রীদের দুর্নীতি সম্পর্কে সাবধান করেছিলেন। পরবর্তী সময় জাতির উদ্দেশে এক ভাষণে দুর্নীতিবিরোধী সুনির্দিষ্ট চারটি বিষয়ে গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন, যারা দুর্নীতিতে জড়িত, তাদের আত্মশুদ্ধি চর্চা করতে হবে; আইনের কঠোর প্রয়োগ করতে হবে; তথ্যপ্রযুক্তি সমপ্রসারণ করতে হবে এবং দুর্নীতি প্রতিরোধে জনগণের অংশগ্রহণ ও গণমাধ্যমের সহায়তা নিশ্চিত করতে হবে। পরে ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে শুদ্ধি অভিযানের পরিপ্রেক্ষিতে নিজের দলের নেতা-কর্মীসহ কাউকে ছাড় দেয়া হবে না মর্মে ঘোষণা দেয়া হয়েছিল। দুর্নীতির বিরুদ্ধে শুদ্ধি অভিযানের পরিপ্রেক্ষিতে সূচকে অনেকে বাংলাদেশের ব্যাপক অগ্রগতি আশা করেছিল, কিন্তু তা হয়নি। কারণ দুর্নীতিবিরোধী অভিযান ধরে রাখা যায়নি। সার্বিক বিবেচনায় রাষ্ট্রকাঠামো ক্রমাগতভাবে দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের এজেন্ট ও সুবিধাভোগীদের করায়ত্তের মুখোমুখি, যার প্রকট দৃষ্টান্ত ব্যাংক ও আর্থিক খাত। জালিয়াতি ও ঋণখেলাপির কারণে জর্জরিত এ খাতের বোঝা সাধারণ জনগণকে বইতে হচ্ছে। স্থানীয় পর্যায়ে করোনার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত জনগোষ্ঠীর জন্য ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রমে অসাধু কর্মকর্তাদের পাশাপাশি স্থানীয় জনপ্রতিনিধিসহ রাজনৈতিক নেতা-কর্মীরা লিপ্ত হয়েছেন বিব্রতকর অনিয়ম-দুর্নীতিতে। এমনকি হতদরিদ্রদের জন্য বিশেষ সহায়তা হিসেবে সরকারপ্রদত্ত আর্থিক অনুদান কার্যক্রমও বাদ পড়েনি তাদের দুর্নীতি থেকে।
বাংলাদেশের অব্যাহত অগ্রগতি সারা বিশ্বের বিস্ময়। স্বাধীনতা-পরবর্তী ৫০ বছরে বাংলাদেশের যে অগ্রগতি হয়েছে তার পেছনে রয়েছে সরকারের নানা নীতিসহায়তা, উদ্যোক্তা-ব্যবসায়ীদের শিল্প স্থাপন, কর্মসংস্থান, সরকারি কর্মচারী, ব্যবসায়ী ও জনগণের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ অবদান। কিন্তু উন্নয়নের এ পর্যায়ে মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রচ্ছন্ন দুর্নীতির কারণে খরচ বেড়ে যাচ্ছে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে কাজের মান খারাপ হচ্ছে। আমাদের দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নের বিষয় যেমন বিশ্বব্যাপী আলোচিত হচ্ছে, তেমনি দুর্নীতির বিষয়টিও কারো অজানা নয়। দেশে দুর্নীতির প্রকোপ এতটা বেশি যে বর্তমানে মানুষের চিন্তা-চেতনায়ও এটি সংক্রমিত হচ্ছে, অথচ এ দেশে এরূপ দুর্নীতি মোটেও কাম্য নয়।
ডেনমার্ক, নিউজিল্যান্ড ও ফিনল্যান্ড দুর্নীতি প্রতিরোধে বিশ্বে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। দুর্নীতি ধারণা সূচকে তারা বরাবরই ভালো করে আসছে। এবারো দেশগুলো যৌথভাবে তাদের শীর্ষ অবস্থান ধরে রেখেছে। সর্বত্র তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার ও প্রতিটি স্তরে জবাবদিহিমূলক উন্নয়ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দেশগুলো একটা স্বচ্ছ প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে। একইভাবে রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থা দুর্নীতির বিরুদ্ধে একটা দৃঢ় নৈতিক ভিত্তি বিনির্মাণ করেছে, যা দুর্নীতি প্রতিরোধে সহায়ক ভূমিকা রেখেছে। দক্ষিণ এশিয়ায় দুর্নীতি প্রতিরোধের ক্ষেত্রে ধারাবাহিকভাবে ভালো করছে ভুটান। দেশটির এবার স্কোর ৬৮ আর উচ্চক্রমের দিক থেকে অবস্থান ২৫তম। এ অগ্রগতি একদিনে অর্জিত হয়নি। ভুটান দুর্নীতি প্রতিরোধে গবেষণালব্ধ নীতি গ্রহণ করেছে। দুর্নীতি কেন হয়, এর পরিণাম কী এবং কীভাবে কমানো যায় তা নিয়ে বেশ কয়েকটি বিস্তৃত বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণা পরিচালনা করেছে। তার ভিত্তিতে তথ্যভিত্তিক কৌশল নিয়েছে। জনপ্রতিনিধি, পরিদর্শক, রাজনৈতিক ব্যক্তি, সাংবাদিকসহ বিভিন্ন অংশীজনের মতামতের ভিত্তিতে একটা অন্তর্ভুক্তিমূলক দুর্নীতিবিরোধী প্রচেষ্টা জোরদার করেছে। দেশটি জাতীয় কল্যাণ কৌশলের অংশ হিসেবে গ্রস ন্যাশনাল হ্যাপিনেসে (জিএনএইচ) কয়েকটি দুর্নীতি পরিমাপক অন্তর্ভুক্ত করেছে। সর্বোপরি স্কুল পর্যায়ে গভীরভাবে প্রোথিত করা হয়েছে নৈতিকতার পাঠ। এসবের সুফল পাচ্ছে ভুটান।
দুর্নীতির কারণে প্রতি বছর দেশের জাতীয় আয়ের ২-৩ শতাংশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ফলে উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক সুফল সাধারণ ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষের কাছে পৌঁছে না। মনে করা হয়েছিল, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সুযোগ-সুবিধা বাড়ালে দুর্নীতি কমবে। কিন্তু বাস্তবে কমেনি। বরং কভিডকালে হতদরিদ্রদের জন্য দেয়া আর্থিক সহায়তা বণ্টনেও দুর্নীতির খবর মিলেছে। এমনকি প্রধানমন্ত্রী দুর্নীতির বিরুদ্ধে শূন্য সহনশীলতা নীতি ঘোষণা করলেও বাস্তব চিত্র বদলায়নি। সরকারি ক্রয় প্রক্রিয়া ও প্রকল্প ঘিরে দুর্নীতির অভিযোগের খবর গণমাধ্যমে প্রায়ই প্রকাশিত হচ্ছে। দেশে দুর্নীতি রোধে আইন আছে, রয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। রাজনৈতিক অঙ্গীকারও আছে। কিন্তু সুফল মিলছে না।
দুর্নীতির বিরুদ্ধে কিছু সুপারিশ করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে রাজনৈতিক সদিচ্ছা, অবাধ গণমাধ্যম ও সক্রিয় নাগরিক সমাজ বিকাশে উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করা এবং ব্যাংক কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িতদের আইনের আওতায় আনা। এগুলো আমলে নিয়ে কার্যকর পদক্ষেপ জরুরি। দুর্নীতি মোকাবেলায় দুদক প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। কিন্তু রাজনৈতিক প্রভাব ও কিছু এখতিয়ারগত সীমাবদ্ধতার কারণে প্রতিষ্ঠানটি স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে না। ফলে কিছু রুটিন কাজ ছাড়া দুর্নীতির বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিতে পারছে না তারা। প্রতিষ্ঠানটির স্বাধীনভাবে কাজ করার জন্য আইন ও ব্যবস্থাপনাগত সংস্কারও প্রয়োজন।
রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে শুদ্ধাচার সহায়ক ব্যাপক রূপান্তর ব্যতিরেকে দুর্নীতির কার্যকর প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ অসম্ভব। রাজনীতি ও রাজনৈতিক অবস্থানকে দুর্বৃত্তায়ন ও অবৈধ অর্থের প্রভাবমুক্ত করতে হবে। আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক সামর্থ্যের স্বচ্ছ, জবাবদিহিমূলক ও কার্যকর প্রয়োগের স্বার্থে আইন প্রয়োগসংশ্লিষ্ট সব প্রতিষ্ঠানকে দলীয় রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করতে হবে। সরকারি সব সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়াকে প্রভাবশালী মহলের প্রভাবমুক্ত করে জনস্বার্থের প্রাধান্য নিশ্চিত করতে হবে। প্রধানমন্ত্রী যেমন বলেছেন, আইনের কঠোর প্রয়োগের মাধ্যমে দুর্নীতি যে-ই করুক, অবস্থান বা পরিচয় নির্বিশেষে শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। ব্যাংক খাতে ঋণখেলাপির বিচারের আওতায় আনতে হবে। দুদকের আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক সামর্থ্যের যথাযথ প্রয়োগ করে আইনের চোখে সব নাগরিক সমান, এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে কারো প্রতি ভয় বা করুণা না করে দায়িত্ব পালন, বিশেষ করে উচ্চপর্যায়ের দুর্নীতিবাজদের কার্যকরভাবে জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে দুদক সরকারের আজ্ঞাবহ প্রতিষ্ঠান নয়, এই ধারণা সংশ্লিষ্ট অংশীজনের মধ্যে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে হবে।