আয়ের চেয়ে বেশি ব্যয়ের পাঁচ ব্যাংক এগোবে কি

হাছান আদনান ও মেহেদী হাসান রাহাত

বিতরণকৃত ঋণের আয় থেকে আমানতকারীদের সুদ পরিশোধ করে ব্যাংক। কিন্তু ঋণ থেকে যদি আয়ের পথই বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে সে ব্যাংকের পক্ষে আর টিকে থাকা সম্ভব হয় না। দেশের সরকারি, বেসরকারি বিদেশী খাতের পাঁচ ব্যাংকের আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি। ফলে সুদ খাতে প্রতি বছরই লোকসান গুনছে ব্যাংকগুলো। যদিও সুদ খাতই যেকোনো ব্যাংকের আয়ের মূল উৎস।

ব্যাংকের ঋণ আমানতের সুদহারের ব্যবধান ব্যাংকিং পরিভাষায় স্প্রেড হিসেবে পরিচিত। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী, ব্যাংকগুলো সর্বোচ্চ শতাংশ স্প্রেডে ঋণ বিতরণ করতে পারে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, দুর্দশাগ্রস্ত পাঁচটি ব্যাংকের স্প্রেড নেতিবাচক ধারায় রয়েছে। নেতিবাচক ধারায় থাকা আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের স্প্রেড ঋণাত্মক দশমিক ২৯ শতাংশ। স্প্রেড ঋণাত্মক থাকা ব্যাংকগুলোর মধ্যে রয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত বেসিক ব্যাংক, বেসরকারি খাতের বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক বিদেশী খাতের ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান। ফারমার্স ব্যাংক থেকে নাম পরিবর্তন করে পদ্মা হওয়া বেসরকারি ব্যাংকের স্প্রেড ঋণাত্মক দশমিক ৫৮ শতাংশ। অর্থাৎ ব্যাংকটির সুদ খাতে আয়ের চেয়ে ব্যয় অনেক বেশি। ঋণ বিতরণে অনিয়ম, দুর্নীতি লুণ্ঠনের শিকার হয়ে পাঁচ ব্যাংকই দীর্ঘদিন ধরে খাদের কিনারে দাঁড়িয়ে আছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিসহায়তায় কোনো রকমে অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে ব্যাংকগুলো।

মূলত বিতরণকৃত ঋণের অর্ধেকের বেশি খেলাপির খাতায় চলে যাওয়ায় পাঁচটি ব্যাংকের স্প্রেড নেতিবাচক। এর মধ্যে ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তানের খেলাপি ঋণের হার ৯৮ শতাংশ। ফলে সুদ খাত থেকে ব্যাংকটির আয় নেই বললেই চলে। লুণ্ঠনের শিকার হওয়া ব্যাংকে গ্রাহক নতুন করে আমানত রাখছেন না। পুরনো আমানত বেশি সুদে ধরে রাখার চেষ্টার কারণেই বিদেশী খাতের ব্যাংকের স্প্রেড নেতিবাচক ধারায়। লুণ্ঠনের শিকার হওয়া আরেক ব্যাংক আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার ৭৯ শতাংশ। পদ্মা ব্যাংকের বর্তমানে খেলাপি ঋণ ৬৩ শতাংশেরও বেশি। আর রাষ্ট্রায়ত্ত বেসিক ব্যাংক বেসরকারি বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার ৫৩ শতাংশ।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সমস্যাগ্রস্ত এসব ব্যাংকে স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে কোনো গ্রাহক আমানত রাখছেন না। ফলে বেশি সুদে সরকারি কিংবা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে আমানত এনে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করতে হচ্ছে। একদিকে বিতরণকৃত ঋণ থেকে সুদ আয়ের পথ প্রায় বন্ধ। অন্যদিকে আমানতের বিপরীতে উচ্চসুদ পরিশোধ করতে গিয়েই ব্যাংকগুলোর লোকসানের পাল্লা প্রতিদিনই ভারী হচ্ছে। কোনো ব্যাংকের পক্ষেই ঋণাত্মক স্প্রেডে বেশি দিন টিকে থাকা সম্ভব নয়।

২০০৯ সাল-পরবর্তী পাঁচ বছরে লুণ্ঠনের শিকার হওয়ার পর এখন পর্যন্ত প্রায় হাজার কোটি টাকা নিট লোকসান দিয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত বেসিক ব্যাংক। অথচ বিপর্যস্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের সবচেয়ে সফল ব্যাংক ছিল এটি। ২০২১ সালেও প্রায় ৩৯০ কোটি টাকা নিট লোকসান দিয়েছে ব্যাংকটি। বর্তমানে বেসিক ব্যাংকের স্প্রেড ঋণাত্মক দশমিক ৬০ শতাংশ। আর ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের হার ৫৩ শতাংশেরও বেশি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যমতে, গত বছরের নভেম্বর শেষে বেসিক ব্যাংকের আমানতের গড় সুদ ছিল দশমিক ৮৩ শতাংশ। এর বিপরীতে ব্যাংকটির ঋণের গড় সুদ দশমিক ২৩ শতাংশ। বেসিক ব্যাংকের স্প্রেডের পরিমাণ ঋণাত্মক দশমিক ৬০ শতাংশ। ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের হার ৫৩ শতাংশ। আর্থিক প্রতিবেদন অনুসারে ২০২০ সাল শেষে বেসিক ব্যাংকের সুদ আয় হয়েছে ৪৫৬ কোটি টাকা। এর বিপরীতে ব্যাংকটির সুদ বাবদ ব্যয় হয়েছে ৮৭৭ কোটি টাকা। ২০২০ সাল শেষে বেসিক ব্যাংকের কর-পরবর্তী লোকসান দাঁড়িয়েছে ৩৭১ কোটি ৮১ লাখ টাকায়।

সুদ খাতে লোকসান দিয়ে কোনো ব্যাংক চলতে পারে না বলে মনে করেন বেসিক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আনিসুর রহমানও। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে বেশি সুদ দিয়ে আমরা আমানত আনতে বাধ্য হচ্ছি। অথচ দরকার ছিল বেসিক ব্যাংককে কম সুদে সরকারি আমানত দেয়া। সরকার বেসিক ব্যাংকের জন্য বিভিন্ন সময়ে মূলধন দিয়েছে। কিন্তু পরিচালন ব্যয় কমানোর জন্য কোনো সুযোগ করে দেয়নি। সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান প্রকল্পের আমানত যদি আমরা কম সুদে পেতাম, তাহলে বেসিক ব্যাংকের কস্ট অব ফান্ড কমানো যেত। এতে ব্যাংকটি স্প্রেড বাড়ার পাশাপাশি ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগ পেত।

ঋণাত্মক স্প্রেডের কারণে ২০২০ সালে ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তানের সুদ আয় হয়েছে মাত্র ৩৭ লাখ ৯২ হাজার টাকা। এর বিপরীতে সুদ খাতে ব্যাংকটিকে ১২৩ কোটি ৭০ লাখ টাকা ব্যয় করতে হয়েছে। ২০২০ সালে ব্যাংকের নিট লোকসান হয়েছে ২০ কোটি টাকা।

বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের আমানতের গড় সুদ দশমিক ৬৬ শতাংশ। এর বিপরীতে ব্যাংকটির ঋণের গড় সুদ দাঁড়িয়েছে দশমিক ৩৩ শতাংশে। বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের স্প্রেডের পরিমাণ ঋণাত্মক দশমিক ৩৩ শতাংশ। ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের হার ৫৩ শতাংশ। ২০২০ সালে ব্যাংকটির ১৪৩ কোটি টাকা সুদ আয়ের বিপরীতে খাতে ব্যয় করতে হয়েছে ২১৬ কোটি টাকা। ২০২০ সালে ব্যাংকটিকে ১৯৪ কোটি টাকা কর-পরবর্তী লোকসান গুনতে হয়েছে।

স্প্রেড ঋণাত্মক হওয়ায় ধারাবাহিকভাবে লোকসান গুনছে আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক। বর্তমানে ব্যাংকটির স্প্রেড হার ঋণাত্মক দশমিক ২৯ শতাংশ। ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার ৭৯ শতাংশের বেশি। ২০২০ সালে আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক ৩৬ কোটি টাকা সুদ আয় করেছে। এর বিপরীতে একই সময়ে সুদ বাবদ ব্যাংকটির ব্যয় হয়েছে ৪৫ কোটি ৯৮ লাখ টাকা। ২০২০ সাল শেষে ব্যাংকের লোকসানের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৮ কোটি ৭২ লাখ টাকা।

পদ্মা ব্যাংকের আমানতের গড় সুদ দশমিক ৩৯ শতাংশ। এর বিপরীতে ব্যাংকটির ঋণের গড় সুদ দশমিক ৮১ শতাংশ। পদ্মা ব্যাংকের স্প্রেডের পরিমাণ ঋণাত্মক দশমিক ৫৮ শতাংশ। ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের হার ৬৩ শতাংশ। উদ্যোক্তাদের অনিয়ম-দুর্নীতির ভারে বিপর্যস্ত ফারমার্স ব্যাংককে বাঁচাতে এগিয়ে আসে অর্থ মন্ত্রণালয় বাংলাদেশ ব্যাংক। তিন বছর আগে ব্যাংকটির নাম পরিবর্তন করে পদ্মা ব্যাংক করার পাশাপাশি রাষ্ট্রায়ত্ত চার ব্যাংক ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশের (আইসিবি) মাধ্যমে ৭১৫ কোটি টাকার মূলধন সহায়তা দেয়া হয়। বিভিন্ন ধরনের ছাড় সহায়তা পেলেও ব্যাংকটির দৃশ্যমান কোনো উন্নতি হয়নি। বরং ঘুরে দাঁড়াতে ব্যর্থ পদ্মা ব্যাংক রাষ্ট্রায়ত্ত কোনো ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হওয়ার প্রস্তাবও দিয়েছিল। ধারাবাহিক লোকসানের কারণে মূলধন হিসেবে জোগান দেয়া অর্থও প্রায় শেষ করে ফেলেছে পদ্মা ব্যাংক। ২০২১ সালের জুন শেষে প্রায় হাজার ১০০ কোটি টাকা মূলধন ঘাটতিতে ছিল ব্যাংকটি।

বর্তমান পরিস্থিতিতে সমস্যাগ্রস্ত ব্যাংকগুলোর বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত সরকারকে নিতে হবে বলে মনে করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, মাঝেমধ্যে আমরা শুনছি বেসিক ব্যাংককে অন্য ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করে দেয়ার বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ে আলোচনা চলছে। যেহেতু ব্যাংকটির মালিক সরকার, তাই ধরনের কোনো সিদ্ধান্ত নিতে হলে সেটি সরকারের পক্ষ থেকেই আসতে হবে। অন্যদিকে বেসরকারি বিদেশী খাতের যে ব্যাংকগুলোর পরিস্থিতি খারাপ, সেগুলোকে একীভূত কিংবা অবসায়ন যেটিই করা হোক, সেটি সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ থেকে উদ্যোগী হতে হবে। পদ্মা ব্যাংকের বিষয়ে সরকার নিজেই উদ্যোগী হয়ে অনেক সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকেও ব্যাংকটিকে যথেষ্ট ছাড় দেয়া হয়েছে। কিন্তু আমরা দেখছি, এখনো ব্যাংকটি ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। বেসরকারি বিদেশী খাতের সমস্যাগ্রস্ত অন্য ব্যাংকগুলোর পর্ষদ উদ্যোগী না হলে সেক্ষেত্রে সরকার কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে পারে। বিদ্যমান ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী, এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের খুব বেশি কিছু করার নেই।

বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্রের ভাষ্য হলো, একাধিক দুর্বল ব্যাংককে একত্র করে দিলে আরেকটি বড় দুর্বল ব্যাংকের জন্ম হবে। পরিচালকদের ব্যর্থতা অনিয়মের কারণেই ব্যাংকগুলোর পরিস্থিতি খারাপ হয়েছে। দুঃখজনক হলেও সত্য, এক্ষেত্রে দায়ী পরিচালকদের তেমন কোনো শাস্তি হয়নি। দেশের ব্যাংক খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক সাধ্য অনুযায়ী চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন