চীন-ভারতের কাছে আবারো ঋণ চেয়েছে শ্রীলংকা

বণিক বার্তা ডেস্ক

একদিকে ভয়াবহ মূল্যস্ফীতি, অন্যদিকে রিজার্ভের সংকট ক্রমবর্ধমান বহিঃঋণের চাপ। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মহামারীর অভিঘাত। সব মিলিয়ে কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে শ্রীলংকা। সংকট কাটাতে গিয়ে বহিঃঋণের প্রতি আরো নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে দেশটি। বিশেষ করে গোটা ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ভূরাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত চীন ভারতের ওপর কলম্বোর নির্ভরশীলতা এখন অনেক বেশি। চলতি মাসেই দেশ দুটির কাছে আবারো ঋণসহায়তা চেয়েছে লংকাদ্বীপের সরকার।

শ্রীলংকার ক্রমবর্ধমান বহিঃঋণ দেশটিকে আরো কঠিন সংকটের মুখে ঠেলে দিতে পারে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। তাদের ভাষ্যমতে, চলমান সংকট মোকাবেলায় স্বল্পস্থায়ী সমাধান খুঁজতে গিয়ে কলম্বো নিজেকে দীর্ঘমেয়াদি এক ঋণজালে জড়িয়ে ফেলছে। বিষয়টি সামনের দিনগুলোয় দেশটির অর্থনৈতিক সংকটকে আরো ঘনীভূত করতে পারে।

চলতি মাসেই শ্রীলংকা সফরে আসেন চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই। সে সময় তার কাছে শ্রীলংকার পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে ঋণসহায়তা চেয়ে অনুরোধ করা হয়। স্থানীয় সংবাদমাধ্যমগুলো জানাচ্ছে, ঋণসহায়তার অনুরোধ বলা হলেও এটি ছিল আসলে ঋণ পুনর্গঠনের অনুরোধ। এছাড়া চীন থেকে পণ্য আমদানি বাবদ প্রদেয় অর্থ পরিশোধে বিশেষ ছাড় দেয়ারও অনুরোধ করা হয়। গত বছর শ্রীলংকায় মোট ৩৫০ কোটি ডলারের পণ্য রফতানি করেছে চীন।

পশ্চিমা পর্যবেক্ষক মহলে এখন চীনের তথাকথিত ঋণফাঁদের গভীরে শ্রীলংকার ক্রমেই জড়িয়ে পড়া নিয়ে আলোচনা হচ্ছে সবচেয়ে বেশি। তাদের ভাষ্যমতে, কলম্বোকে ঋণফাঁদে ফেলে শ্রীলংকায় নিজের উপস্থিতি ক্রমেই বাড়িয়ে তুলেছে চীন। এর মধ্য দিয়ে বঙ্গোপসাগর তথা ভারত মহাসাগরে নিজের কৌশলগত অবস্থানকে দৃঢ় করে তুলছে দেশটি।

শ্রীলংকায় চীনের ঋণসহায়তা নিয়ে হইচই বেশি হলেও বর্তমানে সম্ভাব্য সব স্থান থেকেই ঋণসহায়তা আদায়ের চেষ্টা করছে কলম্বো। আঞ্চলিক ভূরাজনীতিতে চীনের বৈরী প্রতিদ্বন্দ্বী ভারতের কাছ থেকেও প্রচুর পরিমাণে ঋণসহায়তা নিচ্ছে শ্রীলংকা।

চলতি সপ্তাহেই নয়াদিল্লির কাছ থেকে শিগগিরই ১৫০ কোটি ডলারের সহায়তা পাওয়ার সম্ভাবনার কথা জানিয়েছে শ্রীলংকা সরকার। দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী জিএল পেইরিস গত রোববার তথ্য জানান। তার ভাষ্যমতে, ভারতের অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমণ পররাষ্ট্রমন্ত্রী . এস জয়শংকরের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে কলম্বোর জন্য ঋণসহায়তা প্যাকেজ প্রাপ্তির বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন শ্রীলংকার অর্থমন্ত্রী বাসিল রাজাপাকসে।

সম্প্রতি আইএমএফের কাছ থেকে বেলআউট প্যাকেজ গ্রহণ করার এক প্রস্তাব শ্রীলংকার সরকার প্রত্যাখ্যান করে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংস্থাটির কাছ থেকে সহায়তা গ্রহণ করা নিয়ে দেশটির মন্ত্রিসভায়ও এক ধরনের বিভক্তি দেখা দিয়েছে। বিষয়ে জিএল পেইরি বলেন, ঋণসহায়তার বিষয়ে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) যোগাযোগের সম্ভাবনা এখনো ফুরিয়ে যায়নি। আইএমএফের সদস্য হিসেবে শ্রীলংকার জন্য সংস্থাটির দুয়ার এখনো খোলা রয়েছে।

তিনি দাবি করেন, রিজার্ভের তীব্র সংকট সত্ত্বেও শ্রীলংকা এখনো একেবারে তলিয়ে যায়নি।

চলতি মাসেই রিজার্ভ তহবিলের সংকট মোকাবেলায় শ্রীলংকার সঙ্গে ৪০ কোটি ডলারের কারেন্সি সোয়াপের ঘোষণা দেয় ভারত। একই সঙ্গে এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের মাধ্যমে শ্রীলংকার সাড়ে ৫১ কোটি ডলার ঋণ পরিশোধেরও ঘোষণা দিয়েছে দেশটি। স্থানীয় পর্যবেক্ষকরা বলছেন, ভারত থেকে সহায়তা গ্রহণের মাধ্যমে শ্রীলংকার রিজার্ভে আপাতত রক্তক্ষরণ থামানো গেলেও দেশটির অর্থনীতিতে বিপদের ছায়া এখনো কাটেনি।

এছাড়া নয়াদিল্লি অন্যান্য ব্যালান্স অব পেমেন্ট সহায়তার পাশাপাশি শতকোটি ডলারের একটি সহায়তা প্যাকেজেরও ঘোষণা দিয়েছে। ঋণসহায়তার অর্থ শ্রীলংকায় খাদ্য সংকট মোকাবেলার পাশাপাশি দেশটিতে জরুরি গুরুত্বপূর্ণ পণ্য ওষুধ আমদানিতে ব্যবহার করা হবে।

তবে এসব সহায়তা শ্রীলংকার অর্থনীতির বিপদকে কাটিয়ে তুলতে কতটা সক্ষম হবে, সে বিষয়ে খোদ লংকান সংবাদমাধ্যমগুলোও সন্দিহান। চলতি বছর সব মিলিয়ে শ্রীলংকার মোট ৪৫০ কোটি ডলারের ঋণ পরিশোধ করতে হবে।

শ্রীলংকার বিরোধীদলীয় রাজনীতিবিদ অর্থনীতিবিদ হর্ষ ডি সিলভা সম্প্রতি দেশটির পার্লামেন্টে বর্তমান পরিস্থিতির জন্য রাজাপাকসে সরকারকে দায়ী করেন। তিনি বলেন, ২০১৯ সালে গোতাবায়া রাজাপাকসে ক্ষমতা গ্রহণের সময়ে শ্রীলংকার বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ ছিল প্রায় ৭০০ কোটি ডলার। আগামী বছরের (২০২৩ সাল) শুরুতে এর পরিমাণ নেমে আসতে পারে ঋণাত্মক ৪৩ কোটি ৭০ লাখ ডলারে।

আন্তর্জাতিক ঋণমান নির্ধারণকারী সংস্থা মুডি ফিচ রেটিংস সম্প্রতি শ্রীলংকার ঋণমান বি থেকে সি ক্যাটাগরিতে নামিয়ে এনেছে। মহামারীর মধ্যে দুই বছরে দেশটিতে অন্তত পাঁচ লাখ মানুষ নতুন করে দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে এসেছে বলে বিশ্বব্যাংকের এক পরিসংখ্যানে উঠে এসেছে। অন্যদিকে গত বছরের নভেম্বরে দেশটিতে মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে দাঁড়ায় ১১ দশমিক শতাংশে, যা দেশটির ইতিহাসে সর্বকালের সর্বোচ্চ। মুদ্রার বিনিময় হার ক্রমেই স্ফীত হয়ে ওঠায় দেশটির লাখ লাখ পরিবারের জন্য এখন মৌলিক প্রয়োজন মেটানোর মতো পণ্য ক্রয় করাই দুষ্কর হয়ে পড়েছে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন