আলোকপাত

বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলার ও কিছু প্রাসঙ্গিক বিষয়

ড. আর এম দেবনাথ

মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি’—এমন একটা কথা সমাজে চালু আছে। এর আসল অর্থ কী জানি না। তবে দৃশ্যত মনে হয়, বলা হচ্ছে কেউ মেঘই চায়নি, কিন্তু আশীর্বাদস্বরূপ বৃষ্টি এসে গেছে। প্রকৃতিতে এমন ঘটে বলেই প্রবচনের জন্ম। কিন্তু বাস্তব জীবনেও তা ঘটে। এর উদাহরণ? উদাহরণ, সরকারি কর্মচারী-কর্মকর্তাদের বেতন-ভাতা বৃদ্ধি। আজ থেকে চার-পাঁচ বছর আগের ঘটনা। কর্মচারী-কর্মকর্তারা চেয়েছিলেন বেতন-ভাতা বৃদ্ধি। ভেবেছিলেন হয়তো ২০-৩০ শতাংশ বাড়বে, যা বরাবর হয়। না, দেখা গেল বেতন-ভাতা একবারে দ্বিগুণ বৃদ্ধি। সবাই হতবাক, এটাও সম্ভব। হ্যাঁ, সম্ভব তো হয়েছে। ২০২২ সালের জানুয়ারিতেও এমন একটা ঘটনা ঘটল। ঘটল বেসরকারি খাতের ব্যাংকের বেলায়। বণিক বার্তার খবরে দেখলাম, ব্যাংক কর্মীদের সর্বনিম্ন বেতন নির্ধারণ করল বাংলাদেশ ব্যাংক। ভিন্ন একটি কাগজের খবরের শিরোনাম হচ্ছে ব্যাংকারদের পাশে কেন্দ্রীয় ব্যাংক খবরের ভেতরের খবর পড়ে মনে হলো তো মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি। কেমন? অসহায়, ভয়ে কম্পমান, অসংগঠিত ব্যাংকাররা তাদের বেতন-ভাতা বৃদ্ধির জন্য কোনো দাবি করেছেন বলে কোনো কাগজে দেখিনি। করবেন কীভাবে? যেখানে পুলিশ, বিসিএস (প্রশাসন), আয়কর কর্মকর্তা, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ারসহ সরকারের সব শ্রেণীর কর্মকর্তা-কর্মচারীর অ্যাসোসিয়েশন আছে, ট্রেড ইউনিয়ন আছে, সেখানে এমন কোনো সংগঠন ব্যাংকারদের নেই। অতএব দাবির প্রশ্ন ওঠে না। প্রেক্ষাপটে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বর্তমান সিদ্ধান্তকে মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি তো বলতেই হয়। বলা নেই, কওয়া নেই বেশ কতগুলো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিয়েছে। তাও নতুন বছরে। হতাশাগ্রস্ত, লক্ষ্যহীন ব্যাংকারদের উজ্জীবিত করার জন্য। অবশ্যই তা বেসরকারি খাতের ব্যাংকের জন্য। সরকারি ব্যাংকের প্রশ্ন এখানে নেই। কারণ সেটি সরকারি কমকর্তা কর্মচারীদের বেতন-ভাতা বৃদ্ধির সঙ্গে সম্পর্কিত। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা, সুযোগ-সুবিধা বাড়লে তাদেরটাও বাড়ে। অনেকটা স্বয়ংক্রিয়।

প্রায় চার দশকের পুরনো বেসরকারি খাতের ব্যাংকের ক্ষেত্রে যুগান্তকারী সিদ্ধান্তের জন্য আমি বর্তমান গভর্নর ফজলে কবিরকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। ধারণা করা যায়, অর্থমন্ত্রী, বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রীর আদেশ-উপদেশ ছাড়া সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়নি। আমি তাদেরও ধন্যবাদ জানাই। ধন্যবাদ জানাই অনেক কারণে। প্রথমে চাকরির নিশ্চয়তার ক্ষেত্রে একটা ভালো নির্দেশনা এসেছে। বণিক বার্তার খবরে বলা হয়েছে, চাকরি স্থায়ীকরণ বা বার্ষিক বেতন বৃদ্ধির জন্য আমানত সংগ্রহের লক্ষ্য অর্জনের শর্তারোপ করা যাবে না। শুধু নির্ধারিত লক্ষ্য অর্জন করতে না পারা বা অদক্ষতার অজুহাতে ব্যাংক কর্মকর্তাদের প্রাপ্য পদোন্নতি থেকে বঞ্চিত করা যাবে না। একই অজুহাতে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চাকরিচ্যুতও করা যাবে না। সুনির্দিষ্ট প্রমাণিত কোনো অভিযোগ না থাকলে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চাকরিচ্যুত করা বা পদত্যাগে বাধ্য করা যাবে না। এছাড়া দেখা যাচ্ছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক সর্বনিম্ন বেতনও ঠিক করে দিয়েছে। আউটসোর্সিংয়ে নিয়োজিতদের বেতন-ভাতায়ও সামঞ্জস্য আনতে হবে। একই গ্রেডে বিভিন্নজনকে বিভিন্ন বেতন দেয়া যাবে না।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারে বলা হয়েছে, ব্যাংক পরিচালনা ব্যবস্থাপনায় ব্যাংক কর্মকর্তা কর্মচারীদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা নিরবচ্ছিন্নভাবে ব্যাংকিং সেবা প্রদানের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখার ক্ষেত্রে অবদান রেখে যাচ্ছেন। বাংলাদেশ ব্যাংক প্রেক্ষাপটে ব্যাংকের কর্মকর্তা কর্মচারীরা যাতে অধিকতর উজ্জীবিত হয়ে অগ্রগণ্য ভূমিকা পালন করতে পারেন এবং ব্যাংকের যথাযথ ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত হয় সেজন্যই বর্তমান সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এসব সিদ্ধান্তের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংককে আবারো ধন্যবাদ।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ধরনের সিদ্ধান্তে একটা বিষয় নিশ্চিত হলো আর তা হচ্ছে চাকরির নিশ্চয়তা। কথায় কথায় চাকরি যাওয়া, চাকরিতে ইস্তফা দিতে বাধ্য করার রীতি বহুদিন ধরেই ব্যাংকে ব্যাংকে অসন্তোষ তৈরি করছিল। এটা বোঝাই যায়, অসন্তোষ দূর করার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এতে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে ব্যাংকের কর্মকর্তা কর্মচারীদের চাকরির নিশ্চয়তার একটা সমতা বিধান হলো। এছাড়া বেতন-ভাতা ইত্যাদি প্রদানে যথেচ্ছাচার কাম্য নয়। সরকারি খাতে বেতন-ভাতা, সুযোগ-সুবিধা প্রদানের ক্ষেত্রে পাই পাই নিয়ম-বিধি মানতে হয়। এখন থেকে ব্যাংকেও তাই হবে। যতগুলো সিদ্ধান্তের কথা পড়লাম, তার সবই কর্মকর্তা-কর্মচারী ফ্রেন্ডলি, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের উদারহস্তে সুযোগ-সুবিধা দিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক অনেক দিন ধরে সমালোচনার শিকার হচ্ছিল। ঘন ঘন ঋণ পুনঃতফসিল, ঋণ পরিশোধ কাঠামোর পুনর্গঠন, ব্যাংকে পরিচালকদের স্থায়িত্বের মেয়াদ বৃদ্ধি, বোর্ডে বেসরকারি খাতের পরিচালকের সংখ্যা বৃদ্ধি, ঋণের সুদহার হ্রাসের পাশাপাশি আমানতের সুদ হ্রাস ইত্যাদি কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সমালোচিত হচ্ছিল। সমালোচিত হচ্ছিল ঢিলেঢালা মনিটরিংয়ের জন্য। এমনকি কিছুসংখ্যক কর্মকর্তা, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার নানা অনিয়মে যোগসাজশের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক সমালোচিত হচ্ছিল। অবশ্য এর সবকিছুর জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক দায়ী নয়। অনেক কিছু কেন্দ্রীয় ব্যাংক করতে চায় না। তবু করতে হয়। নতুন ব্যাংকের লাইসেন্স দিতে চায় না, তবু দিতে হয়, ঋণের ওপর সুদ কমাতে চায় না, তবু কমাতে হয়। অনিয়ম করা পরিচালকদের সরাতে চায়, তবু পারে না। এত সীমাবদ্ধতার মধ্যেই তারা কাজ করে। কিন্তু মজা হচ্ছে বদনাম তাদেরই হয়। যেমন বদনাম হয় সরকারি ব্যাংকের। সরকারি ব্যাংক চলার কথা কোম্পানি আইন-১৯৯৪ মোতাবেক। নিজেদেরই বোর্ড গঠনের কথা। এমডি, ডিএমডি, জিএম নিয়োগ করার কথা তাদেরই। নিয়মনীতি মানার কথা বাংলাদেশ ব্যাংকের। কিন্তু তা তারা করতে পারে না। অথচ বদনাম তাদেরই। সচিবালয় থাকে নির্দোষ। কিছুদিন ধরে বেসরকারি খাতের ব্যাংক শুধু কর্মচারী-কর্মকর্তাদের ক্ষেত্রে অনিয়ম করছিল তা- নয়, তারা আমানতকারীদের ওপর চড়াও হয়। ব্যাংক মালিকরা মুনাফা বৃদ্ধির লক্ষ্যে আমানতের ওপর সুদ নামাতে নামাতে -- শতাংশে নিয়ে আসে। কোনো কোনো ব্যাংক ১৩ মাসে বছর হিসাব করতে শুরু করে। আমানতকারী, সঞ্চয়কারী, অবসরপ্রাপ্ত লোকজন প্রমাদ গুনতে শুরু করে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক যথাসময়ে ব্যাপারে আমানতকারীবান্ধব সিদ্ধান্ত নেয়। বলে দেয়, মূল্যস্ফীতির নিচে আমানতের ওপর সুদ দেয়া যাবে না। কিছুটা রক্ষা পায় আমানতকারীরা। সিদ্ধান্তের পর কর্মচারী-কর্মকর্তার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য বর্তমান সিদ্ধান্তগুলো খুবই ইতিবাচক সময়োপযোগী। এখানে আরেকটা কথা বলি। শুধু ব্যাংক নয়, প্রতিষ্ঠিত বড় বড় কোম্পানিতেও বেতন হ্রাস, ভাতা হ্রাস, কর্মচারী-কর্মকর্তার চাকরিচ্যুতি ঘটছে এবং এটা প্রতিনিয়ত ঘটছে। তাদেরও দেখার কেউ নেই বলে মনে হয়। এই যে কোম্পানিগুলো মুনাফা বৃদ্ধিকল্পে হাজার হাজার কর্মচারী-কর্মকর্তাকে মধ্যবয়সে বাদ দিচ্ছে তার প্রতিকার কী? কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলবে, এটা আমাদের বিষয় নয়, সরকারের বিষয়। তবে পথ আছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সরকারের অনুমতি নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারে যে যেসব বড় বড় কোম্পানি ব্যাংকঋণে ব্যবসা করে, তারা বিনা কারণে কর্মী ছাঁটাই করতে পারবে না, বেতন-ভাতা কমাতে পারবে না। এতে ওভারস্টেপিং হবে না বলে মনে করি। কাজটি করলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মর্যাদা অনেক বাড়বে। মনে রাখতে হবে, শুধু নিয়ন্ত্রণকাজই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নয়। অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা, উৎপাদন সেবা ব্যবস্থা ইত্যাদি যাতে ঠিক থাকে তার দায়িত্বও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের। এজন্যই কোঅর্ডিনেশন কাউন্সিল নামীয় একটি বডি কেন্দ্রীয় ব্যাংকে রয়েছে, যার প্রধান অর্থমন্ত্রী। কাউন্সিলের কাজ হচ্ছে মুদ্রানীতি, রাজস্বনীতি বাণিজ্যনীতির সমন্বয় করা। এর উদ্দেশ্য উন্নয়ন স্থিতিশীলতা। কাজটি কেন্দ্রীয় ব্যাংক নানাভাবে করতে পারে। তার ক্ষমতা অপরিসীম। আশা করি, কেন্দ্রীয় ব্যাংক এদিকটা বিবেচনা করে দেখবে।

আজ থেকে প্রায় ৩৭-৩৮ বছর আগে বেসরকারি ব্যাংকের যাত্রা, সেই ১৯৮৪ সালের দিকে। তখনকার সময়ই একজন প্রশিক্ষণার্থী অফিসারের বেতন হতো ৩০-৪০ হাজার টাকা। বেতনের গ্রেড ছিল ১০-১৫টির মধ্যে। সর্বনিম্ন বেতন সর্বোচ্চ বেতনের মধ্যে পার্থক্য ছিল মাত্র ১০ গুণ। টাকা সর্বনিম্ন বেতন হলে সর্বোচ্চ হতো ১০ টাকা। অর্থনৈতিক সমতা রক্ষা, অসাম্য দূর করার দায়িত্বও বেসরকারি ব্যাংক নিত। কভিড-১৯-এর মধ্যে সমতা বিধান এবং অসাম্য দূরীকরণে বিশ্বের বড় বড় ধনীরা এগিয়ে আসছেন। তারা সম্পদ করের প্রস্তাব করছেন। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম একই আহ্বান জানিয়ে যাচ্ছে। যে চীন দুনিয়ার এক নম্বর অর্থনীতি হয়ে যাচ্ছে, সেখানে এখন সংগ্রাম চলছে সমতার, বৈষম্যহীনতার। সম্পদ ভাগাভাগি করার তাগিদ দিচ্ছে চীনা কমিউনিস্ট পার্টি। বড় বড় কোম্পানিকে বাধ্য করছে ব্যবসা ছোট করতে। তাদের আইনের অধীনে আনছেন প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। কথা আজ বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত, অসাম্য, বৈষম্য দিয়ে অর্থনৈতিক উন্নয়নের কাজ বেশি দূর এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যাবে না। নিকট প্রতিবেশী ভারতে তার উদাহরণ আজিম প্রেমজি। আইটি জায়ান্ট, ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ধনী। তিনি করোনাকালে হাজার হাজার কোটি টাকা দান করে করোনা আক্রান্ত লোকেদের সেবার কাজে লাগিয়েছেন। উদাহরণ টাটা হাউজ। উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তারা বলে দেয়, করোনায় কারো চাকরিচ্যুতি ঘটবে না। বরং বেতন বাড়বে। কারণ করোনা মোকাবেলায় বেশি খরচ হচ্ছে। করোনায় কোনো কর্মচারী-কর্মকর্তা মারা গেলে তার উত্তরাধিকাররা সব সুযোগ-সুবিধা পাবে। পূর্ণ চাকরি করলে যে সুযোগ-সুবিধা প্রাপ্য হতো মৃত কর্মচারী-কর্মকর্তার পরিবার সেই পরিমাণ টাকাই পাবে। অধিকন্তু পরিবারের একজনের চাকরি দেয়া হবে। পরিবারের চিকিৎসা বিনামূল্যে হবে টাটা হাসপাতালে। ভাবা যায়!

আশা করেছিলাম, এমন একটা বেসরকারি খাত আমরা বাংলাদেশে পাব। শত হোক সরকারের সহজ শর্তে ঋণ সুবিধা, কর সুবিধা, কর অবকাশ, অবকাঠামো থেকে সব সুবিধা পেয়ে আজকের বেসরকারি খাত এত বড় হয়েছে। এতে সরকারের অবদান অনেক। উদ্যোক্তাদের অবদানের কথাও স্বীকার্য। এর পরও কথা থাকে, মানুষ ধন-সম্পদ গড়লে তা ভাগ-বাটোয়ারা করে। যাদের সহযোগিতায় ধন-সম্পদ হয় তাদের স্বার্থ ব্যবসায়ীরা দেখেন। অন্তত ছোটবেলায় আমরা তা- দেখেছি। গ্রামের মহাজনরা তাদের কর্মচারীদের যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা দেখত। তারা কর্মচারীর, গোমস্তার ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার খরচ, ভাত-কাপড়ের ব্যবস্থা, অসুখ-বিসুখে অবলীলাক্রমে সাহায্য করত। আমাদের দেশে যখন বেসরকারি খাতের সূচনা হয়, তখন আমাদের অনেকেরই প্রত্যাশা ছিল, একটা দেশপ্রেমিক উদ্যোক্তা বা ব্যবসায়ী শ্রেণীর উন্মেষ ঘটবে। এরা দেশের স্বার্থ দেখবে, কর্মচারী-কর্মকর্তাদের স্বার্থ দেখবে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, ক্রমে আমাদের আশাবাদ মিথ্যায় পর্যবসিত হচ্ছে। ব্যবসায়ী, উদ্যোক্তা, শিল্পপতিদের একটা অংশ দেশ ত্যাগ করছে। তারা দেশে শিল্প-কারখানা করতে অনাগ্রহী, যা দেখে বণিক বার্তার সম্পাদক দেওয়ান হানিফ মাহমুদ একটা মর্মস্পর্শী নিবন্ধ লিখেছেন কিছুদিন আগে। তিনি অর্থনৈতিক স্বদেশপ্রেমের কথা বলেছেন, যা ভীষণ দরকার। এর জন্য উদ্যোক্তা যেমন দরকার, তেমনি দরকার নিবেদিতপ্রাণ কর্মকর্তা-কর্মচারী। দৃশত এক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে অন্ধ অনুকরণ। আমেরিকার ম্যানেজমেন্ট নীতি অনুসরণ। টার্গেট, খণ্ডকালীন চাকরি, সাপ্তাহিক বেতন, ছয় মাস-নয় মাসের চুক্তি, একই কাজে একেক বেতন, পদোন্নতির অনুপস্থিতি, সর্বোপরি চাকরির অনিয়শ্চতা। যখন তখন চাকরিচ্যুতি। এর ফলে আমেরিকার সমাজ এখন অনিয়শ্চতার সমাজ। পরিবার বলতে কিছু নেই। কেউ বিয়েশাদিতে রাজি নয়। উদ্বেগ, উত্কণ্ঠা, অবসাদ, ডাক্তার, ওষুধ, হাসপাতাল। আমার কাছে মনে হয়, এসব অনুসরণে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এগিয়ে আসছে মূল মালিকদের দ্বিতীয় প্রজন্ম, যারা আমেরিকায় শিক্ষিত বা প্রশিক্ষিত। অথচ এখন দেখা যাচ্ছে, আমেরিকানদের অনেকেই চাকরি করতে চায় না। তারা পরিবারের সঙ্গে সময় কাটাতে চায়। অনেক বড় বড় কোম্পানি এখন চাকরিপ্রার্থী খুঁজে পাচ্ছে না। যুবক-যুবতীরা উদ্যোক্তা হওয়ার চেষ্টা করছে। বলা বাহুল্য, আমাদের দেশেও টার্গেটের কুফল দেখা যাচ্ছে। ঋণখেলাপ সমস্যা টার্গেটের একটা ফল। চাকরির অনিশ্চয়তা, চাকরিচ্যুতি, পদোন্নতি থেকে বঞ্চনা ইত্যাদি কারণে কর্মকর্তারা এক ব্যাংক থেকে অন্য ব্যাংকে দৌড়াচ্ছেন। কোম্পানি কোয়ালিটি বলতে যা বোঝায়, তা হারিয়ে যাচ্ছে। রোগ-শোক বাড়ছে। আমাদের কর্মরত যুবক-যুবতীদের হূদরোগ, প্রেসার, ডায়াবেটিস, অবসাদ, দুশ্চিন্তা, উদ্বেগ-উত্কণ্ঠা ইত্যাদি রোগ পেয়ে বসেছে। এখনই ব্যাপারে মালিক বা উদ্যোক্তারা যদি সচেতন না হন, তাহলে সামনে আমাদের বিপদ হতে পারে। লাভ-মুনাফা ভাগ-বাটোয়ারা করে খাওয়ার মনোবৃত্তি গড়ে তুলতে হবে। অন্ধ অনুকরণ ত্যাগ করে আমাদের প্রাচীন ব্যবস্থাপনা নীতির প্রতি অনুগত হওয়া দরকার।

 

. আর এম দেবনাথ: অর্থনৈতিক বিশ্লেষক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন