মালয়েশিয়ায় জনশক্তি রফতানিতে ২৫ এজেন্সির সিন্ডিকেট

তদারকি বাড়িয়ে স্বচ্ছতার সঙ্গে কর্মী প্রেরণ নিশ্চিত করুক মন্ত্রণালয়

দীর্ঘদিন পর খুলতে যাচ্ছে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার। সম্প্রতি ২৫টি রিক্রুটিং এজেন্সির তালিকা চেয়ে বাংলাদেশ সরকারকে চিঠি দিয়েছেন মালয়েশিয়ার মানবসম্পদমন্ত্রী। চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে দেশটিতে কর্মী প্রেরণে আবারো সিন্ডিকেট গড়ে তোলার অভিযোগ করেছে রিক্রুটিং এজেন্সি ঐক্য পরিষদ। তাদের দাবি, এতে আগের দুর্নীতির পুনরাবৃত্তি ঘটবে। বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের অন্যতম খাত জনশক্তি রফতানি, আর মালয়েশিয়া হলো দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শ্রমবাজার। সাম্প্রতিক সময়ে বাজার অস্থিতিশীল থাকায় জনশক্তি রফতানি বৈদেশিক মুদ্রা আয়ে প্রভাব পড়েছে। রিক্রুটিং এজেন্সির নানা অনিয়মের কারণে এমন অবস্থা তৈরি হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। উভয় দেশের সরকার-নির্দিষ্ট রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোও দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েছিল গতবার। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটলে শ্রমবাজারটি আবার অনিশ্চয়তায় পড়তে পারে। কাজেই যেকোনো অনিয়ম এড়াতে তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোকে কড়া নজরদারির মধ্যে আনতে হবে। সর্বোপরি প্রতিযোগিতার পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। আর কাজটিতে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সক্রিয়তা জরুরি।

বৈদেশিক কর্মসংস্থানে ঐতিহ্যিকভাবে বড় অবদান রাখছে মালয়েশিয়া। প্রথমদিকে বৈধ সব রিক্রুটিং এজেন্সি মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠাতে পারত। ২০১৬ সালে এতে পরিবর্তন আসে। ওই বছর মালয়েশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের জিটুজি প্লাস চুক্তি হয়েছিল। চুক্তির শর্ত ছিল, কোন কোন রিক্রুটিং এজেন্সি শ্রমিক রফতানি করবে, তা নির্ধারণ করবে মালয়েশিয়া সরকার। দুই দেশের আলোচনার ভিত্তিতে ১০টি রিক্রুটিং এজেন্সি সেখানে শ্রমিক রফতানির অনুমতি পেয়েছিল। কিন্তু তিন বছরে মাত্র লাখ ৭৫ হাজার শ্রমিক রফতানির পর দুর্নীতির অভিযোগে চুক্তিটি স্থগিত করে মালয়েশিয়া সরকার। ফলে প্রতিশ্রুত ১৫ লাখ কর্মী তো নেয়ইনি, বরং শ্রমবাজারটি অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দেয়া হয় বাংলাদেশের জন্য। অনেক চেষ্টা-তদবিরের পরিপ্রেক্ষিতে দীর্ঘ তিন বছরের বেশি সময় পর ওই শ্রমবাজার আবার খুলেছে। এখন চ্যালেঞ্জ বাজার ধরে রাখা।

মালয়েশিয়ায় কর্মী প্রেরণে সরকার একটি নির্দিষ্ট খরচ বেঁধে দিয়েছিল। কিন্তু সেটি কার্যকর করা যায়নি। অনুমতিপ্রাপ্ত রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো নানা কায়দায় কর্মীদের কাছ থেকে বিপুল অর্থ নিয়েছিল। বিমান ভাড়া, মেডিকেল ফি, ভিসা প্রসেসিংসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে অন্যায্য অর্থ আদায় করেছিল। কারো কাছ থেকে - লাখ, আবার কারো কারো কাছ থেকে - লাখ টাকা পর্যন্ত নিয়েছিল। অভিবাসন প্রক্রিয়ায় দুর্নীতির প্রমাণ মিললে শ্রমবাজারই বন্ধ করে দেয় দেশটির সরকার। বিদ্যমান প্রক্রিয়ায় যে ২৫টি এজেন্সির মাধ্যমে লোক নেয়ার কথা বলা হচ্ছে, সেটি স্বচ্ছতার সঙ্গে বাস্তবায়ন করতে হবে। না হলে আবারো মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে বৈকি। একই সঙ্গে ২৫টি এজেন্সির বাইরে বৈধ আরো এজেন্সি জনশক্তি রফতানি করতে পারে কিনা, তার জন্য আলোচনা করা যেতে পারে। কথা সত্য, অধিকসংখ্যক এজেন্সির মাধ্যমে মালয়েশিয়া জনশক্তি নিতে আগ্রহী নয়। এতে তাদের সময় ব্যয় বাড়ে বলে জানানো হয়েছে। সেক্ষেত্রে নিযুক্ত ২৫টি এজেন্সি নিয়োগ দিতে হবে পরিপূর্ণ যাচাই-বাছাই করে। কোনো পর্যায়ে দুর্নীতি বা অধিক অর্থ নেয়া থেকে শুরু করে কোনো অভিযোগ মিললে সঙ্গে সঙ্গে তাদের লাইন্সেস বাতিল করে নতুন এজেন্সি নিয়োগ দেয়ার বিধান থাকতে হবে। গতবার জনশক্তি রফতানির ক্ষেত্রে মালয়েশিয়ার দিক থেকেও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছিল। দেশটি তদন্ত করে বেশ কয়েকটি জনশক্তি আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছিল। এক্ষেত্রে বাংলাদেশকে আরো সতর্ক হতে হবে। এখানে স্বচ্ছতা নিশ্চিত হলে মালয়েশিয়ার দিকে কোনো অনিয়ম না হয়, সেদিকেও নজর রাখতে হবে। এক্ষেত্রে দেশটির সরকারের সঙ্গে নিবিড়ভাবে কাজ করা প্রয়োজন।

সত্য যে, গুটি কয়েক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে এক ধরনের একচেটিয়া অবস্থা সৃষ্টি হয়। ফলে ইচ্ছামতো অভিবাসন ব্যয় বাড়ানোর সুযোগ থাকে। গতবার যেমনটা হয়েছিল। কাজেই এবার ব্যাপারে বাড়তি সতর্কতা জরুরি। বলা হচ্ছে, রিক্রুটিং এজেন্সি নির্ধারণ করা দেয়া হলেও এবার মালয়েশিয়াগামী কর্মীদের চাহিদা পূরণ করা হবে জনশক্তি কর্মসংস্থান প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) নিজস্ব ডাটাবেজ থেকে। জেলা অফিসগুলোয় গিয়ে ইচ্ছুক কর্মীদের তথ্য এন্ট্রি করতে হবে ওই ডাটাবেজে। ডাটাবেজে এন্ট্রি না করে কোনো কর্মী মালয়েশিয়ায় যেতে পারবেন না। দালালদের মাধ্যমে রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো কোনো কর্মী নিতে পারবে না। আশা করা হচ্ছে, এতে প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠিত হবে। তবে সবকিছুই নির্ভর করছে নিয়মিত তদারকি ব্যবস্থা নেয়ার ওপর। এক্ষেত্রে বিএমইটির স্বচ্ছতা জবাবদিহিতাও নিশ্চিত করতে হবে।

এবার বিদ্যমান প্রক্রিয়ায় মালয়েশিয়া রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো (এমআরআই) প্রথমে লোকাল নামে কোম্পানিগুলো থেকে মার্কেটিং করে চাহিদাপত্র সংগ্রহ করবে। এরপর সেই চাহিদাপত্র মালয়েশিয়া সরকার মনোনীত সফটওয়্যার কোম্পানির অনলাইন সিস্টেমের মাধ্যমে অটো চলে যাবে ঢাকার প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের বিএমইটির সার্ভারে। একইভাবে ওই চাহিদাপত্রটি চলে যাবে মালয়েশিয়ায় নিযুক্ত বাংলাদেশ হাইকমিশনের সার্ভারে। সেই চাহিদাপত্র যাচাই-বাছাই করে বাংলাদেশ হাইকমিশন থেকে সত্যায়িত করবে। এর পরই বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক যেতে পারবে। এখানে দালালদের দৌরাত্ম্যের কোনো সুযোগ থাকবে না বৈকি। এমনটা নিশ্চিত করা গেলে ব্যয় অনিয়ম অনেকটা কমে আসবে বলে ধারণা। সমঝোতা স্মারকে কর্মীদের বাধ্যতামূলক বীমা, কর্মীদের দেশে ফেরার ব্যবস্থা খরচ বহন করবে নিয়োগদাতা, চুক্তি মেয়াদে মালয়েশিয়ার রিক্রুটিং এজেন্সিকে কর্মীদের দায়িত্ব নেয়ার কথা বলা হয়েছে। ফলে যে অজুহাতে দেশের রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো অন্যায্য ফি আদায় করত তার সুযোগ কমে এসেছে। তবে নজরদারি না করলে সুন্দর ব্যবস্থা থাকলেও কাজ হবে না। এরই মধ্যে ডাটা এন্ট্রির কাজ শুরু হয়েছে। তবে এটি চলছে ঢিমেতালে। সুতরাং কাজটি বেগবান করতে হবে। একইভাবে কর্মীরা যেন দালালদের দ্বারা প্ররোচিত না হন, তার জন্য প্রচার-প্রচারণা বাড়াতে হবে। গুটিকয়েক প্রতিষ্ঠানের কারণে দুর্নীতির যে আশঙ্কা করা হচ্ছে, সেটি যেন না হয় ব্যাপারে কঠোর নজরদারি করতে হবে। অভিযোগ পেলেই দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রয়োজনে তালিকা থেকে বাদ দিতে হবে অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানকে।

দেশের কর্মীরা মালয়েশিয়ার অর্থনীতিতে যেমন অবদান রাখছেন, তেমনি রেমিট্যান্স পাঠিয়ে দেশের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করছেন। কাজেই সংশ্লিষ্ট শ্রমবাজার ঘিরে আর যেন কোনো অনিশ্চয়তা সৃষ্টি না হয়, সেটি নিশ্চিত করতে হবে। রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোকে যেমন আন্তরিক আরো দায়িত্বশীল হতে হবে, তেমনি সরকারকেও নজরদারি বাড়িয়ে অভিবাসন খাতে সুশঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। অনেক দিন পর মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার উন্মুক্ত হওয়া কভিডকালে আমাদের বৈদেশিক কর্মসংস্থানের জন্য ইতিবাচক খবর। এটি ধরে রাখতে হবে। সরকারি-বেসরকারি সম্মিলিত প্রয়াসে মালয়েশিয়ায় জনশক্তি রফতানিতে অভিবাসন ব্যয়, দালালদের দৌরাত্ম্য হয়রানি কমবে, এটা প্রত্যাশা।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন