কভিডে বেশি আয় কমেছে সিলেট, ঢাকা ও রংপুর বিভাগের কৃষকের

সাইদ শাহীন

কভিডকালে বাংলাদেশের কৃষক কেমন পরিস্থিতি মোকাবেলা করছেন তা নিয়ে গবেষণা করেছে জাতিসংঘের খাদ্য কৃষি সংস্থা (এফএও) শস্য  উৎপাদন বৃদ্ধিতে কৃষকের আত্মবিশ্বাসের মাত্রা, কভিড-১৯-এর কারণে কৃষকের আয়ে নেতিবাচক প্রভাব বিপণন প্রতিবন্ধকতা নিয়ে ধারাবাহিক দ্বিতীয় পর্ব 

মহামারীতে বড় প্রভাব পড়েছে কৃষকের আয়ে। দেশের অর্ধেক কৃষকের আয় থেকে ২০ শতাংশ পর্যন্ত কমে গেছে। সময়ে আয় ২০ শতাংশের বেশি কমেছে ১২ শতাংশ কৃষকের। আয় কমে যাওয়ার তালিকায় শীর্ষে রয়েছেন সিলেট, ঢাকা রংপুর বিভাগের কৃষক। জাতিসংঘের খাদ্য কৃষি সংস্থার (এফএও) সাম্প্রতিক এক গবেষণা প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।

চলতি বছরের জানুয়ারিতে প্রকাশিত বাংলাদেশ: শকস, এগ্রিকালচারাল লাইভলিহুড অ্যান্ড ফুড সিকিউরিটি মনিটরিং রিপোর্ট ২০২২ শীর্ষক এফএওর প্রতিবেদনটি তৈরিতে সারা দেশের প্রায় হাজার ৭১৬ জন কৃষক সংশ্লিষ্ট খানার তথ্য নেয়া হয়েছে। ২০২১ সালের এপ্রিল থেকে মে মাস সময়ে তথ্য সংগ্রহ করা হয়।

গবেষণার তথ্যমতে, কৃষকের আয় ২০-৫০ শতাংশ কমেছে এমন পরিস্থিতি সবচেয়ে বেশি দেখা গেছে সিলেট খুলনা বিভাগে। খুলনা বিভাগে শতাংশ সিলেট বিভাগে শতাংশ কৃষকের আয় ২০-৫০ শতাংশ পর্যন্ত কমেছে। এছাড়া রংপুর বরিশাল বিভাগের শতাংশ এবং চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, রাজশাহী ঢাকা বিভাগের শতাংশ কৃষকের পরিমাণ আয় কমেছে। ৫০ শতাংশের বেশি আয় কমেছে এমন পরিস্থিতি বেশি মোকাবেলা করেছেন সিলেট, ঢাকা রংপুর বিভাগের কৃষক। সিলেট বিভাগের ১০ শতাংশ, ঢাকা বিভাগের রংপুর বিভাগের শতাংশ কৃষকের আয় ৫০ শতাংশের বেশি কমেছে। অন্যদিকে চট্টগ্রাম, খুলনা, ময়মনসিংহ বরিশালের শতাংশ, রাজশাহী বিভাগের শতাংশ কৃষকের আয় পরিমাণ কমেছে। তবে দেশের ১১ শতাংশ কৃষকের আয় সামান্য পরিমাণে বেড়েছে।

আবার সার্বিক কৃষি খাতের কর্মসংস্থানে রয়েছে মানহীনতা। কৃষিতে এখন প্রায় আড়াই কোটি কর্মসংস্থানের ৩৫ দশমিক ৯০ শতাংশই পারিবারিক সাহায্যকারী হিসেবে নিয়োজিত। স্ব-কর্মসংস্থান হয়েছে মাত্র ৩৩ দশমিক ৫২ শতাংশ। আর কৃষি শ্রমিক হিসেবে নিয়োজিত রয়েছেন প্রায় ৩০ শতাংশ। এছাড়া অন্যান্যভাবে নিয়োজিত রয়েছেন প্রায় শূন্য দশমিক ৭০ শতাংশ। তাই কৃষি খাতের মাধ্যমে কৃষকের আয় বাড়াতে হলে কাঠামোগত সংস্কার প্রয়োজন বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

বিষয়ে এসিআই এগ্রিবিজনেসেসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা . ফা আনসারী বণিক বার্তাকে বলেন, শস্য খাতের সমসাময়িক প্রতিবন্ধকতাগুলোকে অনুধাবন করতে হবে এবং সেই অনুসারে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। শস্য বহুমুখীকরণহীন উৎপাদনশীলতায় অনেকটাই পিছিয়ে। প্রযুক্তি  যন্ত্রের ব্যবহার ছাড়া বিকল্প টেকসই কোনো উপায় নেই। এছাড়া প্রতিকূল পরিবেশ উপযোগী প্রযুক্তি উৎপাদন কৌশল, হাইব্রিড শস্যের প্রসার, পানিসাশ্রয়ী সেচ পদ্ধতি, সার ব্যবস্থাপনার দক্ষতা বৃদ্ধি প্রযোজন। এতে কর্মসংস্থান যেমন বাড়বে, তেমনি কৃষকের আয় বৃদ্ধি পাবে। উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ততা বৃদ্ধি রোধে বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় নতুন জাত, ভূমি ব্যবস্থাপনায় সমন্বিত পরিকল্পনা নিতে হবে। জমির উর্বরতাশক্তি ধরে রাখা এবং ফসলের বহুমুখীকরণের ক্ষেত্রে অবশ্যই সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নিতে হবে। কৃষি খাতে রূপান্তর প্রক্রিয়া দ্রুত আনতে না পারলে পরিস্থিতি আরো খারাপ হবে। প্রথাগত কৃষি থেকে আধুনিক কৃষিতে যেতে হবে। দেশের চাহিদা মিটিয়ে রফতানি সক্ষম করে তুলতে হবে শস্য খাতকে। এজন্য বাড়তি বিনিয়োগ আর্থিক প্যাকেজ সঠিকভাবে দিতে হবে। পাশাপাশি মূল্যসংযোজন তারুণ্যনির্ভর কৃষিতে গুরুত্বারোপ করতে হবে। মোটামুটিভাবে একটি কাঠামোগত পরিবর্তন খুব প্রযোজন শস্য খাতে।

প্রতিবেদনে আয় কমার প্রধান কারণ হিসেবে কভিডের সময় চলাচলে বিধিনিষেধ দেয়ার কথা বলেছেন ৫০ শতাংশ কৃষক। কভিডের কারণে ব্যবসা কৃষি কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হওয়ার কারণে আয় কমেছে বলে জানিয়েছেন ২৫ শতাংশ। পরিবারের সদস্যের অসুস্থতা বা মৃত্যুর কারণে শতাংশ, উৎপাদন কমে যাওয়ায় বিক্রি কমেছে ১১ শতাংশ, পণ্য সেবার চলাচল সীমিত (কভিড-১৯) করায় আয় কমেছে বলে জানিয়েছে ১৮ শতাংশ কৃষক।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) রিপোর্ট অন এগ্রিকালচার অ্যান্ড রুরাল স্ট্যাটিস্টিকস প্রতিবেদনের তথ্যানুসারে, দেশের গ্রামীণ পরিবারের বার্ষিক আয় লাখ হাজার ৭২৮ টাকা। এর মধ্যে কৃষি খাত থেকে আয় হয় ৭৭ হাজার ৪৫৮ টাকা আর অকৃষি খাত থেকে লাখ ২৫ হাজার ২৬৬ টাকা। কৃষি খাতের মাধ্যমে সবচেয়ে কম আয় করে সিলেট বিভাগের মানুষ। বিভাগের গ্রামীণ পরিবারের কৃষি খাতের মাধ্যমে আয় হয় ৬৩ হাজার ৪২১ টাকা। এর পরেই রয়েছে ঢাকা বিভাগের ৬৬ হাজার ৩১২ চট্টগ্রাম বিভাগের ৬৭ হাজার ৮৮৫ টাকা। অন্যদিকে কৃষি খাতের মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি আয় করে রংপুরের গ্রামীণ পরিবারগুলো। বিভাগের পরিবারপ্রতি আয় ৯২ হাজার ৫২২ টাকা। এর পরেই খুলনার ৮৮ হাজার ৩৬ টাকা এবং রাজশাহী বিভাগের ৮২ হাজার ৯০৮ টাকা।

বিশ্বব্যাপী চলমান কভিডের প্রভাবে ২০২০ সালের শেষ পর্যন্ত অর্থনীতির প্রায় সব সূচকই ছিল নিম্নমুখী। বেকারত্ব বৃদ্ধি পাওয়া, দারিদ্র্যের হার বৃদ্ধি, রাজস্ব আয় ব্যাংকিং লেনদেন অতিমাত্রায় কমে যায়। আমদানি-রফতানি বাণিজ্যে স্থবিরতার পাশাপাশি ব্যাপক মুদ্রার সরবরাহ ঋণের প্রবৃদ্ধি ছিল নেতিবাচক। দেশব্যাপী করোনাকালে লাখো মানুষ চাকরি হারিয়েছে। দারিদ্র্যের হার দ্বিগুণ হয়েছে। ছোট ক্ষুদ্র অনেক ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেছে। সামগ্রিক প্রভাবে দেশের সিংহভাগ মানুষের কমে যায় আয়। থেকে বাদ যায়নি কৃষক পরিবার। কৃষিপণ্যের উৎপাদন বিপণনগত বাধায় কৃষকের আয় নানা মাত্রায় কমে গেছে। কৃষকের আয় বৃদ্ধির ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন কৃষিমন্ত্রী।

কৃষকের আয় বৃদ্ধি করা কেন প্রয়োজন, সেটির ওপর গুরুত্বারোপ করে কৃষিমন্ত্রী . মো. আবদুর রাজ্জাক বলেছেন, দেশের ৬০-৭০ শতাংশ মানুষ গ্রামে বাস করে। যারা গ্রামে বাস করে তাদের আয় মূলত কৃষির ওপরই নির্ভর করে। ফলে দেশ যত উন্নতই হোক, কৃষির যদি উন্নতি না হয় তাহলে মানুষের জীবিকার উৎস বাড়বে না। তাদের আয় বাড়বে না। সামগ্রিকভাবে উন্নতি করতে হলে কৃষির উন্নয়ন প্রয়োজন। গ্রামের মানুষের আয় না বাড়লে স্থানীয় বাজার উন্নত হবে না। আর স্থানীয় বাজার উন্নত না হলে শিল্প-কারখানার প্রসার লাভ হবে না। ফলে বিদেশী বিনিয়োগও সেভাবে আসবে না। বিদেশী বিনিয়োগকারীরা যেখানে বিনিয়োগ করে বা যে পণ্যটি উৎপাদন করবে, তা স্থানীয় বাজারে বিক্রি করতে পারবে কিনা সেটি আগে বিবেচনা করে। সেজন্য শুধু রফতানিনির্ভর পণ্যের জন্য তারা বিনিয়োগে উৎসাহিত হন না।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন