পার্ক চুং হি ও এরশাদ

সামরিক শাসনের অধীনে গড়ন ও পচন

দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

১৯৬১ সালে চরম দারিদ্র্য রাজনৈতিক সংকটে থাকা দক্ষিণ কোরিয়ার শাসনভার হাতে তুলে নেন জেনারেল পার্ক চুং হি। কোরীয় যুদ্ধে বিধ্বস্ত দক্ষিণ কোরিয়া তখনো বিশ্বের সবচেয়ে দারিদ্র্যপীড়িত দেশ। ১৯৭৯ সালের অক্টোবরে নিহত হওয়ার আগপর্যন্ত তিনি দেশটি শাসন করেছেন। তার রাজনৈতিক ডিসকোর্স বিতর্কিত। স্বৈরতান্ত্রিক অগণতান্ত্রিক শাসনপদ্ধতির জন্য তিনি সমালোচিত, নিন্দিত। পার্ক তার শাসনামলে যাবতীয় রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডকে কোণঠাসা করে রেখেছিলেন। একই সঙ্গে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাও ছিল অনেক। নিষিদ্ধ ছিল সব ধরনের শ্রমিক ইউনিয়ন।

এসব সমালোচনার উল্টোপিঠেই পার্ক চুং হিকে বিবেচনা করা হয় আধুনিক শিল্পোন্নত দক্ষিণ কোরিয়ার কারিগর হিসেবে। তিনি শাসনভার নেয়ার সময়ে, অর্থাৎ ১৯৬১ সালে দক্ষিণ কোরিয়ায় চরম দারিদ্র্যের হার ছিল ৬৬ দশমিক শতাংশ। ১৯৭৯ সালে তা নেমে আসে ১১ দশমিক শতাংশে। সময়ে দেশটিতে শিশুমৃত্যুর হার কমে ৫৯ শতাংশ। ২০১৯ সালে গ্যালাপ কোরিয়ার চালানো এক জরিপে দেখা যায়, দক্ষিণ কোরিয়ার ষাটোর্ধ্ব নাগরিকদের ৪৯ শতাংশ মনে করেন, পার্ক চুং হি তাদের দেশের শ্রেষ্ঠ প্রেসিডেন্ট।

পার্কের আগের শাসক সিঙ্গম্যান রি ছিলেন ভিন্ন চিন্তার মানুষ। তিনি অর্থনৈতিক উন্নয়নকে দ্বিতীয় স্থান দিয়েছিলেন। তার অগ্রাধিকার ছিল সামরিক ব্যয়ে। অবশ্য যিনি যুদ্ধের মধ্য দিয়ে গিয়েছিলেন, তার এমন ধারণাকে স্বাভাবিক বলে মনে করেন অনেকে। কিন্তু পার্ক নিজে সেনাবাহিনীর জেনারেল হয়েও সামরিক ব্যয় কমালেন, আর মনোযোগ দিলেন অর্থনৈতিক উন্নয়নে। তার কাছে মনে হয়েছিল, দক্ষিণ কোরিয়ার অর্থনীতি শক্তিশালী হলে তা দেশের সামরিক শক্তির জন্য শিল্পভিত্তি তৈরি করবে।

পার্ক যখন দক্ষিণ কোরিয়াকে অর্থনৈতিক উন্নয়নের মতাদর্শ সামনে রেখে শাসন করতে শুরু করেন, তখনো উত্তর কোরিয়ার পূর্ণ মনোযোগ সামরিক খাতে। ২০০৯ সালে এসে দেখা গেল দক্ষিণ কোরিয়ার মানুষের ক্রয়ক্ষমতা উত্তর কোরীয়দের তুলনায় ৩৫ গুণ বেশি। পার্ক নিজে পর্যবেক্ষণ করেছিলেন সবল অর্থনীতি কীভাবে জাপানের সামরিক বাহিনীকে শক্তিশালী শিল্পভিত্তির সহায়তা দিয়েছিল। ১৯৬১ সালের মে মাসে ক্যুর মাধ্যমে পার্ক চুং হি দক্ষিণ কোরিয়ার ক্ষমতায় বসেন। দেশটির অর্থনৈতিক রাজনৈতিক ভঙ্গুর অবস্থার কারণে তার ক্ষমতা দখলকে জনগণ স্বাগত জানিয়েছিল। তার নেতৃত্বে দক্ষিণ কোরিয়া দারিদ্র্য অশিক্ষা থেকে মুক্ত হয়ে অল্প সময়ে যে উন্নতি ঘটিয়েছে তার নজির বিরল।

অর্থনীতিকে গুরুত্ব দিয়ে করা কিছু কাজ পার্ককে দক্ষিণ কোরিয়ার রূপান্তরের নায়কে পরিণত করে। দেশটির কর্মসংস্থান, আয়, শিক্ষা খাতের মান বাড়াতে সচেষ্ট হয়েছিলেন তিনি। পার্ক দক্ষিণ কোরিয়ার ভূমি সংস্কারকে সফল করেছিলেন। তার আগেও অনেকে উদ্যোগ নিয়ে বাস্তবায়ন করতে পারেননি। কিন্তু পার্কের দৃঢ় পরিকল্পিত কর্মযজ্ঞ তা সম্ভব করে। তার চালু করাসিমল উনডংকর্মসূচি হালকা শিল্পের বিকাশ ঘটিয়ে বহুসংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থান নিশ্চিত করেছিল। দুর্নীতি লুটপাটের মাধ্যমে সংক্ষিপ্ত পথে ধনী হওয়ার সুযোগও বন্ধ করেছিলেন তিনি।

শিক্ষাক্ষেত্রে সমতাবাদী আদর্শের কঠোর প্রয়োগ করেছিলেন পার্ক। তার নীতি দক্ষিণ কোরিয়ায় দ্রুত বিপুলসংখ্যক শিক্ষিত মানবসম্পদ তৈরি করে। কর্মশক্তি স্থানীয় বাজারের বিকাশে ভূমিকা রাখে। জনগণের অর্থনৈতিক উন্নতিও আসে খুব দ্রুত। শিক্ষিত অর্থনৈতিকভাবে উন্নত নাগরিকরা পরবর্তী সময়ে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি নির্মাণে ভূমিকা রাখেন।

শিল্প খাতে রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা নজরদারির ব্যবস্থাও ছিল শক্ত। সফল ফার্মগুলো যাতে নতুন নতুন খাতে কাজ করতে পারে, সেজন্য সরাসরি প্রেসিডেন্ট অফিস থেকে দিকনির্দেশনা দেয়া হতো। সরকার অনেক নতুন নতুন শিল্প-কারখানাকে সহায়তা দিয়ে প্রতিষ্ঠিত করতে ভূমিকা রাখে। ধীরে ধীরে অর্থনীতিকে উন্মুক্ত করে বাজারকে বিস্তৃত করা হয়। প্রতিযোগিতার মাধ্যমে বাজার বিস্তৃতির বিষয়টিতে বাড়তি গুরুত্ব দেয়া হতে থাকে। এজন্য একই খাতে সক্রিয় ডজন খানেক চেবলকে একই সঙ্গে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছেন পার্ক। এর মধ্যে সরকার নির্ধারিত লক্ষ্যপূরণে ব্যর্থ চেবলগুলোর আন্তরিকতা প্রমাণ হওয়া সাপেক্ষে সেগুলোর ওপর সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা অব্যাহত রাখা হতো। কিন্তু ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা অদক্ষতার কারণে ব্যর্থ প্রতিষ্ঠানগুলোকে আর কোনো সুযোগ দেয়া হতো না। দক্ষিণ কোরিয়ার স্যামসাং, দাইয়ু, এলজি, লোটে, হুন্দাই এসকে গ্রুপের মতো চেবলগুলোর বৈশ্বিক জায়ান্ট হয়ে ওঠার বীজ বপন হয়েছিল পার্ক চুং হি সরকারের গঠনমূলক শিল্পনীতির মধ্যেই।

প্রতিযোগিতাপূর্ণ অভ্যন্তরীণ বাজার, প্রাতিষ্ঠানিক অযোগ্যতায় ছিটকে পড়ার ঝুঁকি এবং ধীরে ধীরে আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীদের সুযোগ করে দেয়ার মাধ্যমে আশপাশের দেশগুলোর তুলনায় অনেক শক্তিশালী স্থিতিশীল হয়ে ওঠে দক্ষিণ কোরিয়ার অর্থনীতি। ১৯৯৭ সালে মুদ্রা সংকটে পূর্ব দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বড় ধরনের অর্থনৈতিক বিপর্যয় দেখা দেয়। তবে অর্থনীতির শক্তিশালী ভিত দক্ষ মানবসম্পদকে কাজে লাগিয়ে দক্ষিণ কোরিয়া এক দশকের মধ্যেই সংকট কাটিয়ে ওঠে। 

অর্থনীতিকে আধুনিকায়ন করতে পার্কের সামনে ছিল সম্পদের সীমাবদ্ধতা। সমস্যা কাটাতে তিনি তৈরি করেন বিশেষ শিল্প বাণিজ্য জোন। অগ্রাধিকার দিয়েই এগুলোর ইউটিলিটিসহ নানা ধরনের অবকাঠামো সুবিধা নিশ্চিত করেছিলেন পার্ক চুং হি।

দক্ষিণ কোরিয়ার আধুনিকায়নে পার্ক গুরুত্ব দিয়েছিলেন শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান তৈরিতে, বিশেষত প্রতিযোগিতায় সক্ষম চেবল মেধাভিত্তিক সরকারি সংস্থায়। সরকারি প্রতিষ্ঠান শক্তিশালী করার পাশাপাশি সেগুলোকে মাঝেমধ্যে তিনি চাপেও রেখেছেন। আধুনিক ধ্যান-ধারণাসম্পন্ন, মেধাবী প্রতিভাবান কাউকে পেলে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে নিয়োগ দিয়েছেন। আবার কখনো কখনো সরকারি সংস্থাগুলোকে বিভিন্ন থিংক ট্যাংক থেকে পরামর্শ গ্রহণে নির্দেশনা দিয়েছেন। পার্ক নিজে বিদেশে থাকা মেধাবী তরুণ কোরীয় একাডেমিশিয়ানদের দেশে ফিরে দেশের উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে অনুরোধ করেন। তাদের দিয়ে অনেক থিংক ট্যাংক তৈরি করেন তিনি। এসব প্রতিষ্ঠানের সদস্যদের কাজ ছিল অর্থনীতি, শিক্ষা, সংস্কৃতি এমন নানা বিষয়ে গবেষণা করা। তাদের বেতনও ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের চেয়ে বেশি। তাদের পরামর্শকে সরকার খুবই গুরুত্ব দিত। থিংক ট্যাংকের সদস্যদের আরো প্রশিক্ষণ দিয়ে শেষমেশ তাদের সরকারের বিভিন্ন নীতিনির্ধারণী পদে বসানো হতো।

দিনশেষে পার্ক চুং হির প্রতিষ্ঠান নির্মাণ অর্থনৈতিক সাফল্য দক্ষিণ কোরিয়াকে ভেঙে পড়ার হাত থেকে রক্ষা এবং আজকের উন্নত দক্ষিণ কোরিয়ার ভিত্তি তৈরি করেছিল।

দক্ষিণ কোরিয়ার মতো বাংলাদেশও স্বাধীনতা-উত্তর সময় প্রায় দেড় দশক সামরিক কর্তাব্যক্তিদের অধীনে শাসিত হয়। সামরিক শাসকদের মধ্যে বাংলাদেশে সবচেয়ে দীর্ঘ সময় ক্ষমতাসীন ছিলেন ১৯৮২ সালে ক্ষমতা দখলকারী তত্কালীন সেনাপ্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। অনেকটা পার্ক চুং হির মতোই এরশাদও পরবর্তীকালের দেশের আর্থসামাজিক সাংস্কৃতিক গতিপ্রকৃতি এবং কাঠামো নির্ধারণের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ভূমিকা রেখেছেন। তবে সময় পুঁজি মানবসম্পদ গঠনের প্রচেষ্টা-পরিকল্পনা দুটোরই ভিত ছিল অনেক দুর্বল। এরশাদের প্রায় এক দশকের শাসন বাংলাদেশের রূপান্তরে শক্ত কোনো ভূমিকা রাখতে পারেনি। জেনারেল পার্ক চুং হি যেভাবে দক্ষিণ কোরিয়ার সমাজ-রাষ্ট্রকে মেধার মূল্যায়ন প্রতিযোগিতার মাধ্যমে এগিয়ে নিয়েছিলেন, জেনারেল এরশাদ তেমনটি করতে পারেননি।

দক্ষিণ কোরিয়ার পুঁজির উত্থান পর্বটির সূত্রপাত পার্ক চুং হির হাত ধরে। বাংলাদেশের পুঁজিপতি শ্রেণীরও উত্থান শুরু হয় হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের আমলে। তবে উত্থানের চিত্র দক্ষিণ কোরিয়া থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। দেশটিতে পুঁজির উত্থান পর্বে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় উত্থান ঘটে দক্ষ একদল উদ্যোক্তার। আর বাংলাদেশে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় বেড়ে ওঠে পরগাছা প্রকৃতির একদল শিল্প মালিক, সরকারের সহযোগিতা ছাড়া যাদের টিকে থাকা ছিল অসম্ভব। দেশের অর্থনীতিতে ওই সময় সৃষ্ট ক্ষতগুলো পরে ধীরে ধীরে পচনে রূপ নিয়েছে। খেলাপি ঋণ ব্যাংক লুটের মতো দেশের অর্থনীতির বড় সমস্যাগুলো প্রথম এরশাদের আমলেই প্রকট হয়ে উঠতে থাকে। আবার অনুৎপাদনশীল একটি অভিজাত শ্রেণীও গড়ে ওঠে সামরিক শাসনের ছত্রচ্ছায়ায়।

দক্ষিণ কোরিয়ায় পার্ক চুং হির সবচেয়ে বড় সাফল্যগুলোর একটি হিসেবে দেখা হয় তার ভূমি সংস্কার কার্যক্রমকে। বাংলাদেশে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদও ভূমি সংস্কারের প্রয়াস চালিয়েছিলেন। তার উদ্যোগ বেশ প্রশংসাও পেয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা খুব একটা সফল হয়ে উঠতে পারেনি।

ক্ষমতা গ্রহণের কিছুদিনের মধ্যেই ১৯৮২ সালে ভূমি সংস্কারের জন্য একটি কমিটি গঠন করেছিলেন এরশাদ। কমিটি ১৯৮৩ সালের জানুয়ারিতে প্রতিবেদন পেশ করে এবং সরকার প্রতিবেদনের কয়েকটি সুপারিশ অনুমোদন করে। এর ভিত্তিতে জারি করা হয় ভূমি সংস্কার অধ্যাদেশ ১৯৮৪, ভূমি সংস্কার বিধি ১৯৮৪ কৃষিশ্রম (ন্যূনতম) মজুরি অধ্যাদেশ ১৯৮৪। সংস্কারের আওতায় পরিবারপিছু ভূমি মালিকানার সর্বোচ্চ সিলিং ধরা হয়েছিল ৬০ বিঘা করে। এছাড়া এতে জমি বর্গা দেয়ার ক্ষেত্রে চুক্তিনামা বাধ্যতামূলক করার পাশাপাশি ফসলের দুই-তৃতীয়াংশে বর্গাচাষীর অধিকার নিশ্চিত করার ঘোষণা দেয়া হয়।

এছাড়া ভূমিহীনদের মধ্যে সরকারি খাস জমি বণ্টনসংক্রান্ত বিষয়াদিও এর অন্তর্ভুক্ত ছিল। ভূমি সংস্কারসংক্রান্ত পদক্ষেপগুলো বাস্তবায়নে ১৯৮৭ সালে একটি ক্যাম্পেইন হাতে নেয়া হয়। ওই বছরের জুলাই ল্যান্ড রিফর্মস অ্যাকশন প্রোগ্রাম (এলআরএপি) নামে কর্মসূচির ঘোষণা দেয় ভূমি মন্ত্রণালয়। ভূমিহীনদের মধ্যে খাস জমি বণ্টনের বিষয়টিকেই কর্মসূচির প্রধানতম উদ্দেশ্য হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এজন্য ভূমি মন্ত্রণালয়ে গঠন করা হয় ভূমি সংস্কার সেল (এলআরসি) এলআরসির একটি অভূতপূর্ব বিষয় ছিল, এর অধীন উপজেলা পর্যায়ের তৃণমূল কমিটিগুলোয় প্রথমবারের মতো এনজিও ভূমিহীনদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল।

এরশাদের ভূমি সংস্কারের বিষয়বস্তু অন্তত এই একটি ক্ষেত্রে তাকে পার্ক চুং হির মতো সফল করে তুলতে পারত। তবে শেষ পর্যন্ত উদ্যোগ সাফল্যের মুখ দেখেনি, যার জন্য প্রধানত দায়ী করা হয় আমলাদের দুর্বলতা অদক্ষতা এবং রাজনৈতিক এলিটদের অসহযোগিতাকে। তত্কালীন সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন কর্তাব্যক্তিরাও পরবর্তী সময়ে স্বীকার করেছেন, হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সময়ে আমলাতন্ত্র যাবতীয় জবাবদিহির ঊর্ধ্বে চলে গিয়েছিল।

দেশের অর্থনৈতিক ইতিহাসে এরশাদের শাসনামলটিকে দেখা হয় শিল্প খাতের দ্রুত বিরাষ্ট্রীয়করণের কাল হিসেবে। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতার সুবাদে বেসরকারি খাতে খুব দ্রুতগতিতে অনেক নতুন উদ্যোক্তা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের উত্থান ঘটে। শিল্পপতিরা সরকারি কলকারখানার মালিকানা পেয়েছেন নামমাত্র মূল্যে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এসব শিল্পপতি দক্ষিণ কোরীয় চেবলগুলোর চেয়েও অনেক বেশি রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছেন। কিন্তু এসব প্রতিষ্ঠান দেশের অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য কোনো অবদান রাখতে পারেনি। উল্টো নানা সময়ে দেশের শিল্প আর্থিক খাতে বিশৃঙ্খলা তৈরির জন্য প্রতিষ্ঠানগুলোই অভিযুক্ত হয়েছে বারবার।

অনেক ক্ষেত্রেই দেখা গিয়েছে, শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মালিকানা হস্তান্তরকালীন মূল্য পরিশোধের পর কিস্তিতে প্রদেয় মূল্যের এক টাকাও পরিশোধ করেননি শিল্পপতিরা। ১৯৮৭ সালের ৩০ জুন প্রকাশিত এক সরকারি হিসাব অনুযায়ী, ১৯৭৭ থেকে ১৯৮৬ পর্যন্ত বিরাষ্ট্রীয়কৃত ৪৮২টি শিল্প ইউনিটের ৪০ শতাংশেরই কোনো ধরনের কিস্তিমূল্য পরিশোধ করা হয়নি।

এসব প্রতিষ্ঠানকে সুবিধা দিতে গিয়ে ওই সময় বিতরণকৃত ঋণের টাকা আদায়ের বদলে নতুন করে ঋণ বিতরণের ওপর জোর দিয়ে সাজানো হয় ব্যাংক খাতের প্রণোদনা কর্মসূচি। এতে বিনিয়োগ শিল্পায়ন বেড়েছিল ঠিকই। কিন্তু একই সময়ে আবার জাতীয় আয়ে শিল্প খাতের অবদান কমতেও দেখা গিয়েছে। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) বার্ষিক প্রকাশনা বাংলাদেশ উন্নয়ন সমীক্ষার ১৩৯৮ বঙ্গাব্দ (১৯৯১-৯২) সংখ্যায় প্রকাশিত এক নিবন্ধের তথ্য অনুযায়ী, জাতীয় আয়ে শিল্প খাতের অবদান ১৯৭৯-৮০ সালে ছিল ১০ দশমিক শতাংশ। ১৯৮৮-৮৯ অর্থবছরে তা নেমে এসেছিল দশমিক ৪৯ শতাংশে।

আর্থিক খাতেও দেখা দিয়েছিল মারাত্মক বিশৃঙ্খলা। খাতটির অগ্রাধিকার বদলে যাওয়ায় সে সময় ব্যাংকিং ব্যবস্থায় বেশকিছু প্রশাসনিক সংকট তৈরি হয়। ভালো ঋণগ্রহীতা বা লাভজনক প্রকল্প চিহ্নিত করার জন্য আদর্শ কোনো মূল্যায়ন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত ছিল না সে সময়। উপরন্তু ব্যাংকসহ ঋণ বিতরণকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর বিনিয়োগ প্রকল্প বা ঋণগ্রহীতা বাছাইয়ের কোনো স্বাধীনতাও ছিল না। এক্ষেত্রে প্রায়ই রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষের নির্দেশ মেনে চলতে হয়েছে প্রতিষ্ঠানগুলোকে। পরিপ্রেক্ষিতে ঋণখেলাপিদের সংখ্যাও বাড়তে থাকে।

রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোয় সে সময় ঋণখেলাপের হার দিনে দিনে বেড়েছে। এর মধ্যে শুধু অগ্রণী ব্যাংকের দিকে তাকালেই চিত্র পরিষ্কার হয়। ব্যাংকটির ১৯৮৬ সালের ৩০ ডিসেম্বরের তথ্য অনুযায়ী, সে সময় ব্যাংকটির স্বল্প মধ্যমেয়াদে বিতরণকৃত ঋণ পরিশোধের হার ছিল মাত্র শতাংশ।

অন্যদিকে সোনালী ব্যাংকের ১৯৯১ সালের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, সে সময় ব্যাংকটির মোট বিতরণকৃত ঋণের পরিমাণ ছিল ৪ হাজার ৫২১ কোটি টাকা, যার ১ হাজার ১৭৯ কোটি টাকাই চিহ্নিত হয়েছে শ্রেণীকৃত হিসেবে।

আবার অর্থনীতিতে মূল্যস্ফীতির সমস্যাও প্রকট হয়ে উঠেছিল। বাছবিচারহীন ঋণ বিতরণের কারণে অর্থনীতিতে মুদ্রাপ্রবাহ বেড়ে গিয়ে মূল্যস্ফীতি প্রকট রূপ ধারণ করে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৮২-৮৩ অর্থবছরে দেশে মূল্যস্ফীতির হার ছিল দশমিক ৯০ শতাংশ। পরের অর্থবছরেই তা বেড়ে দাঁড়ায় ১৬ দশমিক ৬২ শতাংশে। এরপর ১৯৮৬-৮৭ অর্থবছর পর্যন্তও মূল্যস্ফীতির হার ছিল ১০ শতাংশের ওপরে।

এরশাদের আমলে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা কোনো চেবল তৈরি করতে না পারলেও জন্ম দেয় নতুন এক সম্পদশালী জনগোষ্ঠীর। তারা ছিল অনুৎপাদনশীল, পরগাছা প্রকৃতির এবং রাষ্ট্রীয় আনুকূল্যপ্রাপ্ত। দক্ষিণ কোরিয়ায় পুঁজির বিকাশের সূচনা পর্বটিতে জোর দেয়া হয়েছিল দক্ষ মানবসম্পদ তৈরির ওপর। কিন্তু বাংলাদেশে পুঁজির বিকাশের সূচনা পর্বে জ্ঞান মেধাভিত্তিক মানবসম্পদ তৈরির বিষয়টি থেকে গিয়েছিল পুরোপুরি অবহেলিত। সামরিক খাতে বরাদ্দ বাড়লেও কমতে থাকে শিক্ষা খাতে। প্রাথমিক স্তরে সমতাভিত্তিক শিক্ষার পরিবর্তে বহুমুখী বৈষম্যমূল্য শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে উঠতে থাকে। সময়েই মাদ্রাসার সংখ্যা ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়। শিক্ষার স্বাভাবিক লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় লেজুড়বৃত্তির রাজনীতি জেঁকে বসে। জ্ঞানের বিকাশস্থল জাতি গঠনের নেতৃস্থানীয় ভূমিকা থেকে সরে আসে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ভূমিকায় আর কখনই ফিরে যেতে পারেনি।

দেওয়ান হানিফ মাহমুদ: সম্পাদক, বণিক বার্তা

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন