খোলা চিঠি

জাতীয় জাদুঘরের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি এবং বেচারা ‘প্রত্নতত্ত্ব’

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ খোলা হয়েছিল বাংলাদেশ সরকারের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর, জাতীয় জাদুঘরসহ ইতিহাস সংস্কৃতি নিয়ে গবেষণা সংরক্ষণের কাজ করবে যেসব প্রতিষ্ঠান, তাদের জন্য দক্ষ জনবল তৈরি করতে। ১৯৯০ সাল থেকে কাজটি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় নিষ্ঠার সঙ্গে করে আসছে। সাম্প্রতিককালে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় সমগুরুত্ব দিয়ে প্রত্নতত্ত্ব বিষয়টি পড়ানো শুরু করেছে এবং কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ব্যাচ এরই মধ্যে স্নাতকোত্তর পর্ব শেষ করে পেশাগত জীবন শুরুর অপেক্ষায় রয়েছে। তবে অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে সম্প্রতি প্রকাশিত বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের একটি নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়েছে। সেখানে সহকারী কিপার পদে আবেদনের যোগ্যতা হিসেবে ইতিহাস ইসলামের ইতিহাসকে একমাত্র যোগ্যতা হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে।

বিজ্ঞপ্তিটি দেখে মনে হচ্ছে দীর্ঘ ২৭ বছর ধরে প্রত্নতত্ত্ব নামের একটি বিভাগে প্রত্নতত্ত্ব জাদুঘর বিদ্যাসংশ্লিষ্ট বিষয়ে পাঠদান করা হচ্ছে, তা অজানা কোনো এক কারণে কর্তৃপক্ষ অবগত নয়। যদিও জাতীয় জাদুঘরের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা গবেষক প্রত্নতত্ত্ব বিভাগে পাঠদান থেকে শুরু করে পরীক্ষক হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে সহযোগিতাপূর্ণ মনোভঙ্গি নিয়ে কাজ করেছেন। সাধারণের কাছে প্রত্নতত্ত্ব বিষয় হিসেবে হয়তো মাটি খোঁড়াখুঁড়ি আর পুরনো জিনিস নিয়ে কাজ করাকে বোঝায়। কিন্তু জাতীয় জাদুঘর আধুনিক জাদুঘর বিদ্যায় শিক্ষিত একটি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে রকম ধারণা নিশ্চয়ই পোষণ করে না। কারণ গবেষণাধর্মী প্রতিষ্ঠান হিসেবে জাতীয় জাদুঘরের অজানা থাকার কথা নয় যে, বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধীনে জাদুঘর বিদ্যার ওপর একটি ব্যবহারিক কোর্সসহ দুটো পূর্ণাঙ্গ কোর্স পড়ানো হয়। পাশাপাশি সংরক্ষণ বিদ্যার ওপর দুটো কোর্সসহ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ব্যবস্থাপনা, মূর্তিতত্ত্ব বিদ্যা, লেখতত্ত্ব বিদ্যা, মুদ্রাতত্ত্ব বিদ্যা, বাংলাদেশ অধ্যয়ন, ধ্রুপদী শিল্পকলা, বিশ্বসভ্যতা সাধারণ ইতিহাস বিষয়ে একাধিক পূর্ণাঙ্গ কোর্সের পাঠদান দিয়ে থাকে দীর্ঘ চার বছরের স্নাতক সম্মান পর্বে। আবার স্নাতকোত্তর পর্বে একজন শিক্ষার্থী বিষয়গুলো সম্পর্কে আরো উচ্চতর জ্ঞান অর্জনের সুযোগ অর্জন করেন।

এরই মধ্যে জাদুঘর বিদ্যার অধীনে স্নাতকোত্তর পর্বে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক শিক্ষার্থী গবেষণা সম্পন্ন করেছেন এবং করছেন। বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জাদুঘর বিদ্যা নিয়ে উচ্চতর ডিগ্রি গ্রহণ করেছেন এসব বিভাগের একাধিক শিক্ষক। আজ খুব দুঃখের সঙ্গে এসব ফিরিস্তি দিতে হচ্ছে। এর একটিই কারণ, জাতীয় জাদুঘরকে বিষয়গুলো সম্পর্কে পুনরায় অবগত করা এবং এরই পরিপ্রেক্ষিতে যেন প্রতিষ্ঠানটি উল্লিখিত বিজ্ঞপ্তি সংশোধনের যথাযথ পদক্ষেপ নেয়। আমরা মনে-প্রাণে বিশ্বাস করি, একটি গবেষণাধর্মী রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর একটি দক্ষ বিজ্ঞাননির্ভর জনবল গড়ে তোলার গুরুত্ব অনুভব করে উল্লিখিত বিজ্ঞপ্তিটি অতি দ্রুততার সঙ্গে সংশোধনের আন্তরিক প্রয়াস চালাবে! প্রসঙ্গে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একটি বক্তব্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ প্রাসঙ্গিক বলে মনে করি। ১৯৭৪ সালে জাদুঘরের হীরকজয়ন্তী প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু প্রধানমন্ত্রী হিসেবে প্রদত্ত বাণীতে জাদুঘরকে জাতির জীবনের দর্পণ হিসেবে উল্লেখ করে বলেছিলেন, বাংলার মানুষকে তাদের নিজস্ব শিল্পকলা প্রত্নতাত্ত্বিক সম্পর্কের সঙ্গে পরিচিত করে তোলা সর্বস্তরের জনসাধারণের মনে এক অকৃত্রিম জাতীয়তাবাদী চেতনা সৃষ্টি করতে আমাদের জাদুঘরগুলোর ভূমিকা রয়েছে। অথচ আজ এত বছর পর আমরা দেখছি বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর বিষয়টিকে যথাযথভাবে অন্তর্ভুক্ত না করেই তাদের কার্যক্রম চলমান রেখেছে।

সম্প্রতি জাতীয় জাদুঘরের সেই আলোচিত নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ফিল্ম এডিটর পদে আবেদন করতে হলে পদার্থবিদ্যায় স্নাতক হতে হবে, অথচ বর্তমানে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিল্ম মিডিয়ার ওপর ডিগ্রি প্রদান করা হয়। এটি স্বতন্ত্র বিষয় হিসেবে দক্ষ জনশক্তি তৈরি করছে। অন্যদিকে সহকারী কিপার (ইতিহাস ধ্রুপদী শিল্পকলা) পদের জন্য ইতিহাস ইসলামের ইতিহাসের স্নাতক স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারীরাই কেবল আবেদন করতে পারবেন। প্রত্নতত্ত্ব বিষয়ে স্নাতক স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করা একজন শিক্ষার্থী যেখানে দক্ষ জাদুঘরকর্মী হওয়ার জন্য সম্পূর্ণরূপে প্রস্তুত, সেখানে জাতীয় জাদুঘরের সহকারী কিপার পদের জন্য প্রত্নতত্ত্ব বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত না করে সংশ্লিষ্ট শিক্ষার্থীদের আবেদন করার ন্যূনতম অধিকার থেকে বঞ্চিত করা ধরনের প্রতিষ্ঠানের কাছে একেবারেই অনাকাঙ্ক্ষিত অনভিপ্রেত। এটি এক ধরনের রাষ্ট্রীয় অর্থ মেধার অপচয়ও বটে। দেশের জনগণের করের টাকায় তৈরি হওয়া দক্ষ কর্মীদের দেশের জন্য কাজের সুযোগ থেকে বঞ্চিত করার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আসলে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর একটি দক্ষ আধুনিক বিজ্ঞাননির্ভর জনশক্তি গড়ে তোলার প্রক্রিয়ায় নিজেকেই বঞ্চিত করে চলেছে। আমরা আশা করছি জাদুঘরে সহকারী কিপার হতে হলে কেবল ইতিহাস বা ইসলামের ইতিহাস থেকে পাস করতে হবে এমন ধরনের চিন্তা কাঠামো থেকে প্রতিষ্ঠানটি খুব দ্রুত বের হয়ে আসবে। যৌক্তিকভাবেই প্রত্নতত্ত্ব বিষয়ের পাঠ্যক্রম বিবেচনা করলে জাদুঘরের সহকারী কিপার বা জাদুঘরের কর্মী হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার জন্য বিষয়ে পাস করা শিক্ষার্থীদের অবশ্যই ন্যূনতম যোগ্যতা রয়েছে। আমরা বিশ্বাস করি, জাতীয় জাদুঘর কর্তৃপক্ষ প্রত্নতত্ত্ব বিষয়ে পাস করা শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যতের কথা বিবেচনায় রেখে ধরনের বৈষম্যমূলক নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি অতি দ্রুত বাতিল করবে।

একই সঙ্গে সহকারী কিপার পদে প্রত্নতত্ত্ব বিষয়ে পাস করা বা জাদুঘর বিদ্যা কোর্স সম্পন্ন করা শিক্ষার্থীদেরও নিয়োগ প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের সুযোগ রেখে একটি সংশোধিত বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করবেন। বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরের মতো দেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ জাদুঘর পরিচালনার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত থাকায় আমরা বিশ্বাস করি, বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী অবশ্যই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে সঠিক দিকনির্দেশনা দেবেন।

সিকদার মো. জুলকারনাইন, সোহরাব উদ্দিন সৌরভ, শারমিন রেজোয়ানা, রিফাত রহমান শাকিল, সাবিকুন নাহার, মাসউদ ইমরান মান্নু: লেখকরা জাহাঙ্গীরনগর, কুমিল্লা রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক প্রত্নতত্ত্বের শিক্ষার্থী

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন