জাতীয় প্রশিক্ষণ দিবস পালিত

উন্নয়নশীল দেশের উপযোগী মানবসম্পদ তৈরিতে প্রশিক্ষণ জোরদার করা হোক

গতকাল পালিত হলো জাতীয় প্রশিক্ষণ দিবস। প্রশিক্ষিত মানবসম্পদ গড়ে তোলার প্রত্যয়ে দিনটি উদ্যাপিত হয়ে আসছে দুই দশকের বেশি সময় ধরে। বাংলাদেশ ২০২৬ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে শামিল হতে যাচ্ছে। পাঁচ দশকের অর্থনৈতিক যাত্রায় অপেক্ষাকৃত স্বল্প অদক্ষ শ্রমশক্তিই মূল ভূমিকা পালন করেছে। লক্ষ্য এখন উন্নত রাষ্ট্র। এটি অর্জনের জন্য দরকার দক্ষ মানবসম্পদ। সুপ্রশিক্ষিত, দক্ষ নিবেদিত কর্মী বাহিনী ছাড়া উন্নয়নের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করা সম্ভব নয়। আর চৌকস পেশাদার কর্মী বাহিনী গড়ে তোলার প্রধান মাধ্যম হলো প্রশিক্ষণ। উন্নয়নশীল দেশের উপযোগী দক্ষ মানবসম্পদের জোগান নিশ্চিতে মানসম্পন্ন শিক্ষা স্বাস্থ্যের পাশাপাশি প্রশিক্ষণের ওপরও জোর দিতে হবে।

পেশাগত কাজের মান উন্নয়নে প্রশিক্ষণের কোনো বিকল্প নেই। প্রশিক্ষণ মানুষকে নিয়মনিষ্ঠ, পারদর্শী, কর্মতত্পর দক্ষ করে তোলে। দেশের সামগ্রিক প্রশিক্ষণ খাতে এখনো কিছু প্রতিবন্ধকতা বিরাজমান। সময়ান্তরে জনসংখ্যা বাড়লেও খাতে সমানুপাতিক হারে রাষ্ট্রীয় ব্যয় বাড়েনি। খাতে বরাদ্দ যৎসামান্য। ফলে অনেক ক্ষেত্রে অর্থাভাবে মানসম্মত প্রশিক্ষণ পরিচালনা কঠিন হয়ে পড়ছে। তথ্যপ্রযুক্তির কল্যাণে দুনিয়া আমূল বদলে গেছে। দেশেও এর ছোঁয়া লেগেছে। কিন্তু দেশের প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলো বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে আধুনিক প্রশিক্ষণ মডিউল বিন্যাস করতে পারছে না বলে অভিযোগ রয়েছে। ফলে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে যুগোপযোগী দক্ষতা অর্জন নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না। দক্ষ প্রশিক্ষকেরও ঘাটতি রয়েছে। একে তো চাহিদা অনুপাতে প্রশিক্ষকের সংখ্যা কম, তার ওপর যারা রয়েছে তাদের দক্ষতার ঘাটতি রয়েছে। এটা বড় দুর্বলতা। প্রশিক্ষণের উন্নয়নের জন্য গবেষণা খুব গুরুত্বপূর্ণ হলেও এক্ষেত্রে অগ্রগতি আশাব্যঞ্জক নয়। সব মিলিয়ে নানা প্রতিবন্ধকতায় দেশের প্রশিক্ষণ খাত কাঙ্ক্ষিত অবদান রাখতে পারছে না।

উন্নয়নের প্রতিটি স্তরের জন্য শিক্ষার পাশাপাশি সময়োপযোগী প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। না হলে অর্থনীতির চাহিদা অনুযায়ী দক্ষ মানবসম্পদ নিশ্চিত করা সম্ভব হয় না। পশ্চিমা উন্নত দেশগুলোর অভিজ্ঞতা বলে উন্নয়নের বিভিন্ন পর্যায়ে তারা জনশক্তির দক্ষতা উন্নয়নে মানসম্মত প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করেছে। তার জন্য তারা গবেষণা, মডিউলের প্রতিনিয়ত আধুনিকায়ন, প্রশিক্ষকের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য রাষ্ট্রীয় পর্যাপ্ত বরাদ্দ জোগানো হয়েছে। পরিকল্পিত উদ্যোগে প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলোকে সময়ের চাহিদা উপযোগী করে গড়ে তোলা হয়েছে। কোথাও ঘাটতি থাকলে সেটি চিহ্নিত করে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে নতুন নতুন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। এশিয়ার উন্নয়ন বিস্ময় দক্ষিণ কোরিয়া, সিঙ্গাপুর মালয়েশিয়ার আজকের সাফল্যের পেছনে প্রশিক্ষণ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। তারা শিল্পায়নের উপযোগী মানবসম্পদ গড়ে তুলতে প্রশিক্ষণ খাতের ব্যাপক সংস্কার করেছে। এমনকি প্রতিবেশী ভারতও প্রশিক্ষণে অনেক এগিয়েছে। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে বিভিন্ন খাতে তারা গড়ে তুলেছে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট। তার সুফলও দৃশ্যমান। দেশটি এখন দক্ষ ব্যবস্থাপক মানবসম্পদ জোগানে বিশ্বের শীর্ষ দেশে পরিণত হয়েছে।

সরকার প্রশিক্ষণের গুরুত্ব প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করে প্রশিক্ষণ খাতের উন্নয়ন সংস্কার কার্যক্রম অব্যাহত গতিতে চালিয়ে যাচ্ছে। জনপ্রশাসন নীতিতে প্রশিক্ষণকে অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে। প্রশিক্ষণ খাতে বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে। প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানগুলোর অবকাঠামো উন্নয়নে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসকে সেবাধর্মী, উন্নয়নবান্ধব আধুনিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে দেশে-বিদেশে প্রশিক্ষণের পরিসর বাড়ানোসহ নানাবিধ সংস্কার কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।

সরকার মানবসম্পদের দক্ষতা বাড়াতে প্রায় জেলায় জেলায় কারিগারি প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট স্থাপন করেছে। পাশাপাশি যুব উন্নয়ন কেন্দ্রসহ আরো কিছু প্রশিক্ষণ কেন্দ্র পরিচালনা করে আসছে। এক্ষেত্রে উন্নয়ন সহযোগীরা কিছু অর্থ ঋণসহায়তাও জুগিয়েছিল। কিন্তু এগুলোর বেশির ভাগই এখন অকার্যকর হয়ে পড়েছে। কারণ কালিকুলামের দুর্বলতা সনাতন প্রশিক্ষণ। অধিকাংশ প্রশিক্ষণেরই বাস্তব প্রয়োগ সীমিত হয়ে পড়েছে। বিটাক, নার্স প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট, কারিগারি প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটকে আরো কার্যকর করে তোলা প্রয়োজন। দেশের দক্ষ মানবসম্পদ তৈরিতে বড় ভূমিকা রাখা ইউসেপের কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়ছে। সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের সহায়তাপ্রবাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় লোকবল ছাঁটাইসহ কার্যক্রম ছোট করে আনতে হয়েছে। আগামী দিনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় নতুন নতুন প্রতিষ্ঠান তৈরি করা হলেও সেগুলো দেশের অর্থনৈতিক চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ দক্ষ জনবল তৈরিতে সহায়তা করছে না। পুরো প্রশিক্ষণ খাতে ব্যাপক সংস্কার আনতে হবে, বিষয়টিকে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের চাহিদাকে বিবেচনায় রেখে সাজাতে হবে।

দেশ এখন উন্নয়নের সন্ধিক্ষণে উপনীত। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পরবর্তী বছরে আমরা দ্রুত সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করছি। দেশকে উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশ এবং উন্নয়নশীল দেশ এই দুটি মাইলফলকে পৌঁছানো এবং টেকসই অবস্থান ধরে রাখতে কার্যকর মানবসম্পদ উন্নয়ন কার্যক্রম অত্যন্ত জরুরি। বিআইডিএসের সাম্প্রতিক এক গবেষণায় বলা হয়েছে, ২০২৫ সাল নাগাদ বাংলাদেশের বিভিন্ন খাত যেমন তৈরি পোশাক, আইসিটি, নির্মাণ, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ, পর্যটন, হালকা প্রকৌশল, স্বাস্থ্যসেবা, জাহাজ নির্মাণ আর ওষুধ শিল্পে প্রায় সাত কোটি প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত দক্ষ জনশক্তি ব্যবস্থাপকের প্রয়োজন হবে। এখন দক্ষ জনশক্তির জন্য অন্য দেশের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। প্রতি বছর প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রাও কারণে ব্যয় করতে হচ্ছে। দক্ষ জনশক্তির ঘাটতি মেটাতে প্রশিক্ষণ কার্যক্রম জোরদার করতে হবে। এক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে অবস্থিত ন্যাশনাল স্কিলস ডেভেলপমেন্ট কাউন্সিল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। তবে তার জন্য কাউন্সিলকে ঢেলে সাজানো গতিশীল করা প্রয়োজন। আলোচ্য কাউন্সিলকে কেন্দ্র করে গবেষণা, প্রশিক্ষকের দক্ষতা বৃদ্ধি, যুগোপযোগী মডিউল তৈরি লক্ষ্যাভিমুখী প্রশিক্ষণ জোরদার এখন সময়ের দাবি।

লাগসই মানবসম্পদ সৃষ্টির মাধ্যমে একদিকে অভ্যন্তরীণ চাহিদা পূরণ, অন্যদিকে বিদেশে বিনিয়োগ সম্ভব। এখানে মনে রাখা প্রয়োজন যে দেশের অন্যতম প্রধান অর্থনৈতিক চালক রেমিট্যান্স, যার প্রধান উৎস মধ্যপ্রাচ্য। আজ মধ্যপ্রাচ্যে প্রযুক্তির বাস্তবায়নে সেখানকার উৎপাদন সেবামূলক প্রতিষ্ঠানে ধীরে ধীরে মানবসম্পদ চাহিদার পরিবর্তন ঘটছে। আমরা দেখছি, ভারত, পাকিস্তান কিংবা অন্য প্রতিযোগী দেশগুলো ওইসব দেশের চাহিদা অনুযায়ী মানবসম্পদ গড়ে তুলছে। ফলে আমরা তাদের সঙ্গে খুব একটা পেরে উঠছি না। তাদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে মানবসম্পদ তৈরি করতে না পারলে আমাদের শ্রমবাজার কিংবা রেমিট্যান্সের প্রবাহ ধরে রাখা ভবিষ্যতে কঠিন হবে বৈকি। কাজেই বিদেশগামী কর্মীদের দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণে আরো মনোনিবেশ করা বাঞ্ছনীয়।

বর্তমানে চলছে চতুর্থ শিল্প বিপ্লব। এখানে টিকে থাকতে হলে শ্রম দক্ষতা খুব গুরুত্বপূর্ণ। যথার্থ কারণে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় দক্ষতার ওপর বিশেষ জোর দেয়া হয়েছে। মানসম্মত প্রশিক্ষণ ছাড়া যা অর্জন করা সম্ভব নয়। কাজেই চলমান চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সুফল বেশি মাত্রায় পেতে হলে প্রশিক্ষণ বাড়ানোর বিকল্প নেই। প্রধানমন্ত্রী এর গুরুত্ব উপলব্ধি করে প্রশিক্ষণ খাতে সব ধরনের সহায়তার অঙ্গীকার করেছেন। সরকার ব্যক্তি খাতের সম্মিলিত প্রয়াসে দেশে প্রশিক্ষণ কার্যক্রম আরো গতি পাবে, এটিই প্রত্যাশা।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন