কভিডের প্রথম বছরে ক্যান্সার রোগী শনাক্ত হয়েছে সবচেয়ে বেশি

মুহাম্মাদ শফিউল্লাহ

দেশের স্বাস্থ্য খাতকে স্মরণকালের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছিল কভিড মহামারীর আবির্ভাব। বিশেষ করে করোনার প্রাদুর্ভাবের বছরে  মহামারীসংশ্লিষ্ট নানা সংকটের পাশাপাশি ব্যাহত হয়েছে ক্যান্সার অসংক্রামক অন্যান্য রোগের চিকিৎসা। যদিও সে সময় করোনা নিয়ে আতঙ্কের মধ্যে অনেকটা অলক্ষ্যেই বেড়েছে ক্যান্সারের প্রাদুর্ভাব। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) তথ্য অনুযায়ী, গত পাঁচ বছরের মধ্যে ২০২০ সালেই দেশে মরণঘাতী ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়েছে সবচেয়ে বেশি। ওই বছরে শনাক্তকৃত ক্যান্সার রোগীর সংখ্যা ছিল দেড় লাখেরও বেশি।

দেশে দিন দিন ক্যান্সারের প্রকোপ বাড়ছে। দূষণ জীবনাচারের প্রভাবে আবির্ভাব ঘটছে ক্যান্সারের নতুন নতুন ধরনের। সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের ভাষ্যমতে, প্রতি বছর দেশে যে পরিমাণ রোগী ক্যান্সারের চিকিৎসা পাচ্ছে, আক্রান্ত হচ্ছে তার প্রায় তিন গুণ।

গ্লোবাল ক্যান্সার ইনসিডেন্স, মর্টালিটি অ্যান্ড প্রিভিলেন্স (গ্লোবোক্যান) পরিসংখ্যানের আলোকে ডব্লিউএইচওর অধীন ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সি ফর রিসার্চ অন ক্যান্সার (আইএআরসি) জানিয়েছে, গত পাঁচ বছরে শনাক্তকৃত রোগীর মধ্যে এখনো ক্যান্সারে আক্রান্ত রয়েছে লাখ ৭১ হাজারের কাছাকাছি। এর মধ্যে ২০২০ সালে শনাক্ত হয়েছিল লাখ ৫৬ হাজার ৭৭৫ জন। একই সময়ে মৃত্যু হয়েছে প্রায় লাখ হাজার ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীর।

তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে সক্রিয় ক্যান্সার রোগীর সংখ্যা প্রকৃতপক্ষে আরো কয়েক গুণও বেশি হতে পারে। কারণ সারা দেশে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে সমন্বিত কোনো পরিসংখ্যান না থাকায় প্রকৃত সংখ্যা বের করা যে কারো জন্য মুশকিল।

দেহকোষের অনিয়ন্ত্রিত কোষ বিভাজন-সংক্রান্ত রোগগুলোকেই চিকিৎসা বিজ্ঞানে আখ্যা দেয়া হয় ক্যান্সার হিসেবে। বিশ্বে রোগে মৃত্যুর হার অন্যান্য রোগের তুলনায় অনেক বেশি। শুরুতে শনাক্ত করা গেলে অনেক ক্ষেত্রেই চিকিৎসার মাধ্যমে ক্যান্সার নিরাময় করা যায়। এখন পর্যন্ত ক্যান্সারের চিকিৎসার জন্য পুরোপুরি কার্যকর কোনো ওষুধ আবিষ্কার হয়নি। তবে এর বিভিন্ন চিকিৎসা পদ্ধতি চালু রয়েছে। বিশ্বব্যাপী এখন পর্যন্ত প্রায় দুইশ ধরনের ক্যান্সার শনাক্ত হয়েছে। এর প্রতিটিই আলাদা এবং চিকিৎসা পদ্ধতিও স্বতন্ত্র। ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি ৭৫-ঊর্ধ্ব নাগরিকদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি।

তথ্য অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে ৩৫ ধরনের ক্যান্সারের প্রাদুর্ভাব রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছে খাদ্যনালির ক্যান্সারে। মোট আক্রান্তের ১৪ শতাংশই আক্রান্ত হয়েছে খাদ্যনালির ক্যান্সারে। শতাংশ রোগী নিয়ে দ্বিতীয় পর্যায়ে রয়েছে ঠোঁট মুখগহ্বরের ক্যান্সার। স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েছে শতাংশ রোগী। সমান হারে আক্রান্ত হয়েছে ফুসফুসের ক্যান্সারে। জরায়ু ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েছে শতাংশ।

সংস্থাটি বলছে, পুরুষদের মধ্যে খাদ্যনালির ক্যান্সারে আক্রান্তের হার বেশি। মোট পুরুষ রোগীর ১৬ শতাংশ ক্যান্সারে আক্রান্ত। এছাড়া পুরুষ আক্রান্তদের ১১ শতাংশ ফুসফুস, ১১ শতাংশ ঠোঁট মুখগহ্বর, শতাংশ খাদ্যনালির ওপরের অংশে (হাইপোফারিনক্স) শতাংশ পেটের ক্যান্সারে আক্রান্ত। তবে নারীদের মধ্যে ১৯ শতাংশই স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত। জরায়ু ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েছে ১২ শতাংশ। এছাড়া নারী রোগীদের মধ্যে খাদ্যনালির ক্যান্সারে ১১ শতাংশ, গলব্লাডারের ক্যান্সারে এবং ঠোঁট মুখগহ্বরের ক্যান্সারে শতাংশ আক্রান্ত হয়েছে।

দেশে ক্যান্সার নিয়ে সরকারি বা বেসরকারি পর্যায়ে জাতীয় কোনো পরিসংখ্যান নেই। ক্যান্সার চিকিৎসায় একমাত্র সরকারি বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট হাসপাতাল (এনআইসিআরএইচ) ক্যান্সারের চিকিৎসা প্রার্থী রোগীদের উল্লেখযোগ্য সংখ্যকই এখানে চিকিৎসা নিতে আসে। প্রতিষ্ঠানটির সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৫ থেকে ২০১৭ সালে হাসপাতালটিতে ৭৬ হাজার রোগী চিকিৎসা নিতে এসেছে। এর মধ্যে ৩৫ হাজার ৩৬৯ জনের মধ্যে ক্যান্সার শনাক্ত হয়েছে। এর বাইরে দেশে ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা দুই-আড়াই লাখ বলে ধারণা করছেন প্রতিষ্ঠান-সংশ্লিষ্টরা।

তারা বলছেন, কয়েক বছর ধরে দেশে ক্যান্সার আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। সারা দেশে এর মধ্যে চিকিৎসা নিতে পারছে মাত্র ৫০ হাজারের মতো। ক্যান্সার চিকিৎসার বড় একটা অংশ রেডিও কেমোথেরাপি। অন্তত ৭০ শতাংশ ক্যান্সার রোগীর ধরনের চিকিৎসার প্রয়োজন হয়। যদিও দুটিসহ ক্যান্সার চিকিৎসার পূর্ণাঙ্গ সুবিধা সব স্থানে পাওয়া যায় না।

জীবনযাপনে অসচেতনতা, অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস পরিবেশ দূষণকে দায়ী করছেন ক্যান্সার বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, পরিবেশের ভারসাম্যের অভাবের কারণেও ক্যান্সার হচ্ছে। অতিমাত্রায় প্লাস্টিক সামগ্রীর ব্যবহার, বাতাসে কার্বন কণার বৃদ্ধি এসব কারণে ক্যান্সার বেড়েছে। যেসব ওষুধ সেবন করা হয় তার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কারণেও ক্যান্সার হতে পারে। একই সঙ্গে আগে ক্যান্সার নির্ণয়ের জন্য প্রযুক্তি এবং সুযোগ কম ছিল তাই রোগী কম পাওয়া যেত।

জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট হাসপাতালের ক্যান্সার রোগতত্ত্ব বিভাগের প্রধান ডা. হাবিবুল্লাহ তালুকদার বণিক বার্তাকে বলেন, দেশে ক্যান্সার রোগীর মধ্যে প্রায় ২০ শতাংশ হিসাবের মধ্যে আসে। বাকিরা হিসাবের বাইরে থেকে যায়। এতে তাদের চিকিৎসাও কঠিন হয়ে পড়ে। এখন নতুন নতুন ক্যান্সার দেখা যায় এমন কথা সঠিক নয়। আগেও বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সার ছিল, তবে প্রয়োজনীয় নির্ণয় পদ্ধতি এবং সচেতনতার বাইরে থাকায় তা আমাদের দৃষ্টির বাইরে ছিল। তখন যেসব ক্যান্সার কম দেখা যেত, তা এখন বেশি করে দেখা যাচ্ছে।

করোনা মহামারী শুরুর বছরে ক্যান্সারে রোগী বেশি হওয়ার কারণ হিসেবে চিকিৎসক বলছেন, যখন দেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয় তখন সবার মধ্যেই অজানা এক আতঙ্ক ছিল। সে বছর করোনা রোগীর বাইরে অন্যান্য রোগের চিকিৎসা বাধাপ্রাপ্ত হয়।

একমাত্র জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট হাসপাতালেই সরকারিভাবে পূর্ণাঙ্গ ক্যান্সারের চিকিৎসা পাওয়া যায়। এর বাইরে আরো প্রায় ২০টি সরকারি হাসপাতালে ক্যান্সারের চিকিৎসা পাওয়া গেলেও তা পূর্ণাঙ্গ নয়। এছাড়া বেশ কয়েকটি বেসরকারি হাসপাতালে ক্যান্সার চিকিৎসা শুরু হয়েছে। তাতে চিকিৎসা পাচ্ছে মোট ক্যান্সার আক্রান্তের এক-তৃতীয়াংশেরও কম।

করোনার কারণে দেশে ক্যান্সার চিকিৎসা কতটুকু ব্যাহত হয়েছে তার সঠিক গবেষণা নেই বলে মন্তব্য করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অনকোলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. সারওয়ার আলম। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, করোনা মহামারীর শুরুতে অন্যান্য রোগের মতো ক্যান্সারের চিকিৎসাও ব্যাহত হয়েছে। তবে সঠিক গবেষণা নেই। ক্যান্সার নিয়ে সরকারি বেসরকারিভাবে গবেষণার অনেক ঘাটতি রয়েছে।

ক্যান্সারের প্রকোপ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, মানুষের মাথার চামড়া থেকে শুরু করে একদম পায়ের পাতা পর্যন্ত ক্যান্সার হতে পারে। যেসব ক্যান্সারের কথা বলা হচ্ছে, তা আগে হতো না এমনটি নয়। আগেও এসব ক্যান্সার ছিল। তবে সুযোগ-সুবিধার অভাবে যেসব ক্যান্সার কম শনাক্ত হয়েছে তা এখন বেশি শনাক্ত হচ্ছে।

একসময় শহরের মানুষের মধ্যে ক্যান্সারের প্রকোপ ছিল বেশি। তবে বর্তমানে সে চিত্র উল্টে গিয়েছে। গ্রামের মানুষের মধ্যেও অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন, দূষণ কৃষিতে ব্যবহূত রাসায়নিকের প্রভাবে ক্যান্সারের প্রাদুর্ভাব বেড়েছে।

এনআইসিআরএইচ বলছে, প্রতি বছর হাসপাতালটিতে যত রোগী ক্যান্সার আক্রান্ত হিসেবে শনাক্ত হচ্ছে, তাদের মধ্যে প্রায় এক-তৃতীয়াংশই কৃষক। এছাড়া শনাক্তকৃতদের মধ্যে কৃষকের হারও এখন উত্তরোত্তর বেড়ে চলেছে। এজন্য কৃষিতে রাসায়নিক কীটনাশকের প্রয়োগের বৃদ্ধিকে দায়ী করেছেন বিশেষজ্ঞরা।

বিভিন্ন কারণে ক্যান্সার হলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মানুষের জীবনযাপনের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত বলে মনে করছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, করোনার কারণে যে ২০২০ সালে ক্যান্সার বেড়েছে এমনটি বলা যাবে না। দুটি বিষয় তেমন সম্পর্কযুক্ত নয়। তবে করোনার কারণে স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হওয়ায় ক্যান্সারের চিকিৎসা ব্যাহত হয়েছে। আগের চেয়ে এখন বিভিন্ন ক্যান্সারের প্রাদুর্ভাব বেশি দেখা যাচ্ছে, তার মূল কারণ হলো, রোগ নির্ণয় স্ক্রিনিংয়ের সক্ষমতা। যারা সুস্থ মানুষ তাদেরও স্ত্রিনিং করে ক্যান্সার শনাক্ত হচ্ছে। আর যারা কোনো না কোনো রোগে আক্রান্ত তাদেরও ডায়াগনোসিস করে ক্যান্সার ধরা পড়ছে। আগে এই সক্ষমতা কম ছিল। সচেতনতা কম ছিল বলে বিভিন্ন ক্যান্সার কম দেখা গেছে। ক্যান্সার গড় আয়ুর সঙ্গেও সম্পর্কযুক্ত। বৃদ্ধরা ক্যান্সারের ঝুঁকিতে বেশি থাকেন।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন