৭৫ বছরে প্রথমবারের মতো নিরাপত্তা কৌশলপত্র উন্মোচন

সার্ককে শক্তিশালী করতে চায় পাকিস্তান

বণিক বার্তা ডেস্ক

পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান সম্প্রতি প্রথমবারের মতো দেশটির স্থানীয় জনসাধারণের সামনে জাতীয় নিরাপত্তা কৌশলপত্র উন্মোচন করেছেন। ন্যাশনাল সিকিউরিটি পলিসি (এনএসপি) শীর্ষক কৌশলপত্রে মূলত জাতীয় অর্থনৈতিক প্রতিরক্ষা নিরাপত্তার পাশাপাশি আঞ্চলিক বৈশ্বিক পর্যায়ে দেশটির ভূরাজনৈতিক অবস্থান নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। পাশাপাশি অর্থনৈতিক রাজনৈতিকভাবে লাভবান হওয়ার জন্য আঞ্চলিক আন্তর্জাতিক বহুপক্ষীয় ফোরামগুলোয় পাকিস্তানের সক্রিয়তা বাড়ানোর ওপরও জোর দেয়া হয়েছে কৌশলপত্রে। বিশেষ করে দক্ষিণ এশীয় সহযোগিতা সংস্থা সাউথ এশিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর রিজিওনাল কোঅপারেশনকে (সার্ক) পুনরায় সক্রিয় শক্তিশালী করে তোলার বিষয়ে পাকিস্তান জোর দিচ্ছে বলে ওই কৌশলপত্রে দাবি করা হয়েছে।

ইমরান খান সরকার দাবি করছে, দেশটির ৭৫ বছরের ইতিহাসে এবারই প্রথম সমন্বিত জাতীয় নিরাপত্তা কৌশলপত্র তৈরি করেছে পাকিস্তান। এতে বলা হয়েছে, মূলত দেশটির জাতীয় অর্থনৈতিক নিরাপত্তাকে কেন্দ্রে রেখে কৌশলপত্রটি তৈরি করা হয়েছে। কারণ আগামী এক দশকে দেশটির জাতীয় সংহতি, আঞ্চলিক অখণ্ডতা, অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা নাগরিক কল্যাণের মতো বিষয়গুলো অনেকটাই নির্ভর করবে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর ওপর।

বহুপক্ষীয় ফোরামগুলো থেকে অর্থনৈতিক রাজনৈতিকভাবে লাভবান হওয়া প্রসঙ্গে দেশটির কৌশলপত্রে বলা হয়, জাতিসংঘ, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ), বিশ্বব্যাংকসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা ফোরাম পাকিস্তানের নিরাপত্তা, অর্থনীতি কূটনীতির মতো বিষয়গুলোয় প্রভাব বিস্তার করে রয়েছে। বিশেষ করে সার্ককে ন্যায়সংগতভাবে পুনরায় সক্রিয় করে তোলার বিষয়ে অঙ্গীকারবদ্ধ পাকিস্তান। একই সঙ্গে ওআইসি, সাংহাই কোঅপারেশন অর্গানাইজেশন, তেহরানভিত্তিক ইকোনমিক কোঅপারেশন অর্গানাইজেশন (ইসিও) সমজাতীয় বহুপক্ষীয় প্লাটফর্মগুলোকে আরো কার্যকর করে তোলার বিষয়েও প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ইসলামাবাদ। এসব ফোরাম থেকে অর্থনৈতিক রাজনৈতিকভাবে লাভবান হওয়ার জন্য পাকিস্তান সদস্য দেশগুলোর সঙ্গে একযোগে কাজ করে যাবে।

আন্তর্জাতিক কূটনীতি ভূরাজনীতির পর্যবেক্ষকরা বলছেন, পাকিস্তান মুহূর্তে আর্থসামাজিকভাবে খুবই কঠিন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। পাকিস্তানের নতুন কৌশলপত্রেও দেশটির জাতীয় নিরাপত্তায় সামরিক শক্তির চেয়ে অর্থনৈতিক সক্ষমতা তৈরিতেই বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। কৌশলপত্রটি জনসাধারণের সামনে প্রকাশের মাধ্যমে ইমরান খান সাধারণ পাকিস্তানিদের কাছে বার্তা দিতে চেয়েছেন, দেশটিকে অর্থনৈতিক দুর্বিপাক থেকে বের করে আনতে তিনি বদ্ধপরিকর।

তবে জনসাধারণের জন্য উন্মোচিত ৬২ পৃষ্ঠার এনএসপিটিই পাকিস্তানের নিরাপত্তা কৌশলপত্রের মূল সংস্করণ নয়। দেশটির স্থানীয় আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলো জানিয়েছে, ১১০ পৃষ্ঠার মূল কৌশলপত্রটিতে ইমরান খান সই করেছিলেন গত মাসে। ওই বিস্তারিত কৌশলপত্রটি এখনো গোপন অবস্থাতেই রেখেছে পাকিস্তান সরকার। যদিও ইসলামাবাদ দাবি করছে সম্প্রতি প্রকাশিত কৌশলপত্রটি মূল সংস্করণেরই সারসংক্ষেপ মাত্র।

পাকিস্তানি জনসাধারণের জন্য প্রকাশিত কৌশলপত্রের ভাষ্য অনুযায়ী, প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে মুহূর্তে ভারতের কাছ থেকেই বড় ধরনের সামরিক হুমকি তৈরি হতে পারে বলে মনে করছে দেশটি। এতে বলা হয়, পাকিস্তানের লাগোয়া প্রতিবেশী দেশটিতে মুহূর্তে পশ্চাদমুখী মারাত্মক চিন্তাধারার সম্প্রসারণ ঘটছে। এতে সহিংস বিবাদের আশঙ্কাও বেড়েছে। কারণে

বিরোধী পক্ষের নীতিগতভাবে শক্তি প্রয়োগের আশঙ্কাকে উড়িয়ে দেয়া যায় না। যেকোনো ধরনের সামরিক আঘাতের জবাবে নিজস্ব আঞ্চলিক অখণ্ডতা রক্ষা করতে পাকিস্তান অঙ্গীকারবদ্ধ। এজন্য কোনো ধরনের অস্ত্রের প্রতিযোগিতাকে এড়িয়ে সামরিক বাহিনীর আধুনিকায়ন অব্যাহত রাখতে বিনিয়োগ করে যাবে দেশটি। এছাড়া বৃহত্তর ভারত মহাসাগর এলাকায় কোনো একক একটি দেশ স্বঘোষিতভাবে নিট নিরাপত্তাদাতার ভূমিকা নিতে গেলে তা আঞ্চলিক নিরাপত্তা অর্থনৈতিক স্বার্থের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে মনে করছে পাকিস্তান।

তবে ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটাতে পাকিস্তান ইচ্ছুক বলে কৌশলপত্রে দাবি করা হয়। এক্ষেত্রে জম্মু কাশ্মীর ইস্যুর ন্যায়সংগত শান্তিপূর্ণ সমাধান দুই দেশের সম্পর্কে কেন্দ্রীয় ভূমিকা নিতে পারে। কিন্তু বর্তমানে ভারতে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির উত্থানের বিষয়টি গভীর উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠেছে এবং তা পাকিস্তানের নিরাপত্তার ক্ষেত্রেও প্রভাব ফেলতে পারে। ভারতীয় নেতাদের পাকিস্তানের প্রতি যুদ্ধংদেহী মনোভাব প্রকাশের মাধ্যমে রাজনৈতিক সুবিধা গ্রহণের নীতি সামরিক হঠকারিতা পাকিস্তানের পূর্ব সীমান্তে নন-কন্টাক্ট ওয়ারফেয়ারের ঝুঁকি তৈরি করেছে। উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার শক্তি সম্প্রসারণের নীতি লঙ্ঘনের মাধ্যমে সীমান্তে ভারতের শক্তিবৃদ্ধি পাকিস্তানের জন্য উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠেছে।

আরেক প্রতিবেশী আফগানিস্তান সম্পর্কে পাকিস্তানি এনএসপিতে বলা হয়, অর্থনৈতিক, মানবিক নিরাপত্তা ইস্যুগুলোয় আন্তর্জাতিক মহলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সহযোগিতার ভিত্তিতে আফগানিস্তানে শান্তি স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার বিষয়ে পাকিস্তান প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। মধ্য এশীয় দেশগুলোর সঙ্গে সংযোগ স্থাপনকারী হিসেবে সম্ভাবনার কারণেই পাকিস্তান আফগানিস্তানে শান্তি ফিরিয়ে আনার বিষয়ে আগ্রহী।

কৌশলপত্রে ভারতের দিক থেকে সবচেয়ে বড় হুমকির কথা বলা হলেও পশ্চিমে আফগান সীমান্তের পরিস্থিতিও পাকিস্তানের জন্য এরই মধ্যে বড় মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠেছে বলে সম্প্রতি আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদগুলোয় উঠে এসেছে। বিশেষ করে খাইবার পাখতুনওয়া অঞ্চলের পরিস্থিতি এখনো বেশ সংঘাতমুখর। তালেবান ছাড়াও আরো বেশ কয়েকটি উগ্র জঙ্গিগোষ্ঠীর উত্থান ওই অঞ্চলকে অশান্ত করে রেখেছে। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় পর্যবেক্ষকরা বলছেন, দুই সীমান্তে একসঙ্গে সংঘাতে জড়াতে হলে তা পাকিস্তানের জন্য বড় ধরনের বিপদের কারণ হয়ে উঠতে পারে।

অন্যদিকে ভারত পাকিস্তান গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে সীমান্তে যুদ্ধবিরতি বজায় রাখতে ঐকমত্যে পৌঁছে। মাঝেমধ্যে লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠলেও এখন পর্যন্ত দুই পক্ষই মোটাদাগে চুক্তির শর্ত পালন করে চলেছে।

কৌশলপত্রে চীনের সঙ্গে পাকিস্তানের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের প্রতিনিয়তই উন্নয়ন ঘটছে বলে দাবি করা হয়। এনএসপিতে চীন পাকিস্তানের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক নিয়ে বলা হয়, পারস্পরিক স্বার্থ সমঝোতার ভিত্তিতে ঐতিহাসিকভাবে দুই দেশের মধ্যে গভীর দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক বিদ্যমান। পারস্পরিক বিশ্বাস কৌশলগত মিলের ওপর ভিত্তি করে সম্পর্ক প্রতিনিয়তই আরো গভীর হচ্ছে। দুই দেশেরই সংশ্লিষ্টতা রয়েছে, এমন সব ক্ষেত্রেই চীনের সঙ্গে সম্পর্ককে আরো শক্তিশালী করে তুলতে চায় পাকিস্তান। পাকিস্তানের সবখানেই চীন-পাকিস্তান ইকোনমিক করিডোরকে (সিপিইসি) দেখা হচ্ছে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প হিসেবে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, দারিদ্র্য বিমোচন এবং আঞ্চলিক কানেক্টিভিটির উন্নয়নের সম্ভাবনা সৃষ্টির মাধ্যমে প্রকল্পটি পাকিস্তানের অর্থনীতিকে গতিশীল করে তুলবে।

একসময় দক্ষিণ এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় মিত্র ধরা হতো পাকিস্তানকে। তবে বর্তমানে সে পরিস্থিতিতে পরিবর্তন এসেছে। ইসলামাবাদকে এখন আর আগের মতো ভূরাজনৈতিক ব্ল্যাংক চেক দিচ্ছে না যুক্তরাষ্ট্র। দেশটি সম্পর্কে এনএসপিতে বলা হয়েছে, পাকিস্তান যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরেই দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতার সম্পর্ক বজায় রয়েছে। পাকিস্তান এখন আর কোনো (বৈশ্বিক ভূরাজনীতির) ক্যাম্প পলিটিকসে আগ্রহী নয়। তবে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক আঞ্চলিক শান্তি স্থিতিশীলতার জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে বলে মনে করছে পাকিস্তান। পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে কাজ করার মাধ্যমে সম্পর্কে বৈচিত্র্য আনতে চায় পাকিস্তান। এক্ষেত্রে পাকিস্তানের চিন্তাভাবনা নিয়ে ওয়াশিংটনের নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে যোগাযোগ এবং সন্ত্রাসবিরোধী কার্যক্রমের পরিসরের বাইরের গিয়ে সম্পর্কের সম্প্রসারণকেই গুরুত্ব দেয়া হবে সবচেয়ে বেশি। এছাড়া বাণিজ্য, বিনিয়োগ, কানেক্টিভিটি, জ্বালানি, কাউন্টার টেরোরিজম, নিরাপত্তা গোয়েন্দা তথ্যের মতো বিষয়গুলোয় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একযোগে কাজ করার সুযোগ অনুসন্ধান করবে পাকিস্তান।

সোভিয়েত আমলের বৈরিতার বাইরে গিয়ে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় রাশিয়া মধ্য এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্কের বেশ উন্নয়ন হয়েছে। দেশটির এনএসপিতেও এর প্রতিফলন দেখা গিয়েছে। কৌশলপত্রটিতে বলা হয়, মুহূর্তে পাকিস্তানের ভূ-অর্থনৈতিক পদক্ষেপগুলো অনেকটাই কানেক্টিভিটিকে কাজে লাগিয়ে মধ্য এশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্য অর্থনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তোলাকেন্দ্রিক হয়ে উঠেছে। ভিশন সেন্ট্রাল এশিয়ার আওতায় মধ্য এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে জ্বালানি ট্রানজিটসংক্রান্ত চুক্তিগুলো বাস্তবায়ন নিয়ে কাজ করে চলেছে পাকিস্তান। এছাড়া রাশিয়ার সঙ্গে জ্বালানি, প্রতিরক্ষা সহযোগিতা বিনিয়োগ-সংশ্লিষ্ট জায়গাগুলোয় অংশীদারিত্বকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করার বিষয়েও অঙ্গীকারবদ্ধ পাকিস্তান। দুই দেশের সম্পর্ক এরই মধ্যে ইতিবাচক দিকে এগিয়ে চলেছে এবং পাকিস্তান উভয় দেশকে লাভবান করে তোলার মতো ক্ষেত্রগুলোর সম্প্রসারণ করতে বদ্ধপরিকর। এছাড়া আফগানিস্তানে শান্তি স্থিতিশীলতা নিশ্চিতের ক্ষেত্রে পাকিস্তান, রাশিয়া মধ্য এশিয়ার দেশগুলো গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হিসেবে কাজ করে চলেছে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন