আউটার রিং রোড প্রকল্প

বাস্তবায়নের মাঝপথেই হারাচ্ছে উপযোগিতা

সুজিত সাহা ও দেবব্রত রায়, চট্টগ্রাম ব্যুরো

২০০৬ সালে জাপান ব্যাংক ফর ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশনের (জেবিআইসি) এক সমীক্ষায় চট্টগ্রাম নগরীর ভবিষ্যতের জন্য টেকসই যোগাযোগ অবকাঠামো বাড়াতে সমুদ্র তীরবর্তী একটি সড়ক নির্মাণের সুপারিশ করা হয়। সুপারিশের ভিত্তিতে শহররক্ষা বেড়িবাঁধের ওপর আউটার রিং রোড নির্মাণের প্রকল্প হাতে নেয় চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) কিন্তু শুরুতে যথাযথ সমীক্ষা না করা, প্রকল্প এলাকায় সরকারি একাধিক মেগা প্রকল্পকে বিবেচনায় না নেয়া এবং সংশ্লিষ্ট সরকারি সংস্থাগুলোর সঙ্গে সমন্বয়ের অভাবে প্রকল্পটির শতভাগ সুফল প্রাপ্তি নিয়ে শঙ্কায় পড়েছে বাস্তবায়নকারী সংস্থা সিডিএ। শেষদিকে এসে নতুন করে প্রকল্প পরিমার্জন, পরিবর্তন সংশোধন করার পরিকল্পনাও করছে সংস্থাটি।

২০১৩ সালের আগস্টে একনেকে আউটার রিং রোড প্রকল্পটি অনুমোদন পায়। ২০১৪ সালে পতেঙ্গা এলাকা দিয়ে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে বঙ্গবন্ধু টানেল নির্মাণের জন্য চীনের সঙ্গে সমঝোতা স্মারকে স্বাক্ষর করে সরকার। ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে আউটার রিং রোড নির্মাণের প্রকল্পটি আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করার মাধ্যমে জুলাইয়ে কাজ শুরু করে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। কিন্তু দুটি মেগা প্রকল্পের সংযোগস্থলকে বিশেষ গুরুত্ব না দিয়ে কাজ চালিয়ে যাওয়া এবং ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা না করার কারণে আউটার রিং রোড প্রকল্পটির সুফল নিয়ে দেখা দিয়েছে শঙ্কা।

এছাড়া একই সংযোগস্থলে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, বন্দরের বে-টার্মিনাল প্রকল্পও বাস্তবায়নের পথে রয়েছে। ফলে চারটি মেগা প্রকল্পের সঙ্গে আউটার রিং রোডের সংযোগ নিয়ে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার অভাবে যানবাহন চলাচলে ট্রাফিক সংকট দেখা দিতে পারে বলে আশঙ্কা করছে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন ট্রাফিক বিভাগ। গত বছরের ২৮ সেপ্টেম্বর বঙ্গবন্ধু টানেলের উভয় প্রান্তে ট্রাফিক রুট নির্মাণসংক্রান্তে গঠিত কমিটির এক সভায় বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। ওই আলোচনায় সিডিএর প্রধান প্রকৌশলী বলেন, চট্টগ্রাম বন্দরের বে-টার্মিনাল নির্মাণকাজ শেষ হলে আউটার রিং রোডের যানবাহনগুলো পতেঙ্গা সার্কেলে এসে স্বাভাবিক গতি সময়ে নামতে পারবে না। বৈঠকে ওই এলাকায় যানজট নিরসনজনিত সংকট মোকাবেলায় টানেল অ্যাপ্রোচ রোড দুই লেনের একটি সার্ভিস সড়ক নির্মাণের প্রস্তাব দেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব।

সিএমপির উপকমিশনার (ভূ-সম্পত্তি উন্নয়ন) এসএম মোস্তাইন হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, বে-টার্মিনাল, বঙ্গবন্ধু টানেল কিংবা নগরীর এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে চালু হলে এসব গাড়ির চাপ পড়বে আউটার রিং রোডের ওপর। এত গাড়ির চাপ রোডের পক্ষে বহন সম্ভব নয়। সে কারণে আমাদের ট্রাফিক বিভাগ সিডিএসহ অন্য সংস্থাগুলোকে বিষয়টি অবহিত করেছে।

খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, চট্টগ্রামের অবকাঠামো উন্নয়নে সিডিএ কার্যক্রম সবচেয়ে বেশি সক্রিয় হলেও সংস্থাটির প্রায় সব প্রকল্পই ত্রুটিপূর্ণ। প্রকল্পের কাজ শুরু কিংবা শেষ হওয়ার পর নকশার ত্রুটি, নকশায় পরিবর্তন ছাড়াও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য সংস্থার সঙ্গে সমন্বয়হীনতার কারণে সুফলবঞ্চিত হওয়া প্রতিনিয়ত বাড়ছে। তাছাড়া নির্মাণ ত্রুটিসহ নানা সংকটে বাস্তবায়নের সুফল কমে যাওয়ার পাশাপাশি দুর্ঘটনা ঝুঁকিও দেখা দিয়েছে একাধিক প্রকল্পে।

প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, চট্টগ্রাম সিটি আউটার রিং রোড ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকত সংলগ্ন সরকারি-বেসরকারি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা রক্ষা করবে, শহররক্ষা বাঁধ হিসেবেও কাজ করবে। সড়কটির কাজ শেষ হলে চট্টগ্রাম বন্দর ইপিজেডের ট্রাক, লরি, কাভার্ড ভ্যানের মতো ভারী যানবাহন নগরীতে প্রবেশ না করে ফৌজদারহাট হয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহসড়কে প্রবেশ করতে পারবে। আবার যাত্রীবাহী বাসসহ বিভিন্ন ধরনের যানবাহনও চট্টগ্রাম নগরীতে প্রবেশ না করে সড়ক দিয়ে কর্ণফুলী নদীর বঙ্গবন্ধু টানেল ব্যবহার করে আনোয়ারা হয়ে কক্সবাজারের দিকে চলে যাবে। এতে রিং রোডের ওপর যানবাহনের চাপ ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে চলাচলকারী দৈনিক যানবাহনের সংখ্যাকেও ছাড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখছে সরকারি সংস্থা যোগাযোগ বিশেষজ্ঞরা। যার কারণে প্রকল্পের শেষার্ধে এসে নতুন করে রিং রোড প্রকল্পটি পরিমার্জন, পরিবর্তন সংশোধন করে চার লেনের পরিবর্তে আট লেনে উন্নীত করার পরিকল্পনা করছে সিডিএ। এজন্য নতুন করে নকশা প্রণয়নসহ প্রকল্পটি শেষ পর্যন্ত বাস্তবায়ন করতে দীর্ঘ সময় লেগে যেতে পারে। পতেঙ্গা এলাকায় বাস্তবায়নাধীন অন্য প্রকল্পগুলোর কাজ শেষ হয়ে গেলে রিং রোডের কারণেই যানবাহন নিয়ে ট্রাফিক সংকটে পড়বে বলে মনে করছে সিএমপির ট্রাফিক বিভাগ।

আউটার রিং রোড নির্মাণ নিয়ে সিডিএ শুরু থেকেই সংকটে রয়েছে। প্রায় ১৫ দশমিক কিমি দূরত্বের প্রকল্পটির ব্যয় ধরা হয়েছিল হাজার ৪৯৬ কোটি টাকা। বাস্তবায়নের সময় ধরা হয় ২০১৭ সালের জুনে। পরবর্তী সময়ে ২০১৮ সালের জুনে ব্যয় বাড়িয়ে করা হয় হাজার ৪২৬ কোটি টাকা। প্রকল্পের আওতায় তিনটি ফিডার রোডের (আউটার রিং রোডে ওঠা নামার জন্য সড়ক) একটির কাজ শেষ হলেও অন্য দুটির কাজ এখনো বাকি রয়েছে। যার কারণে পেভমেন্ট তৈরির মাধ্যমে কার্পেটিং শেষে ৬০ শতাংশ কাজ হলেও রিং রোডে যানবাহন চলাচল করতে পারছে না। সংকট নিরসনে আরো নতুন কিছু কাজ সংযুক্ত করে দ্বিতীয় ধাপে আউটার রিং রোড- নামে আরেকটি প্রকল্প গ্রহণের পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে সিডিএ। তাই প্রকল্পের ব্যয় বৃদ্ধি ছাড়াও ২০২৪ সালের আগে প্রকল্পটির বাস্তবায়ন সম্ভব হচ্ছে না বলে আশঙ্কা করছে খোদ সিডিএ কর্তৃপক্ষ।

সিডিএর প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস বণিক বার্তাকে বলেন, সিএমপির সঙ্গে আলোচনার পর সিডিএ বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে। তাছাড়া মিরসরাই ইকোনমিক জোনের কারণে রোডটি আমরা সীতাকুণ্ড পর্যন্ত বর্ধিত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। যার কারণে আউটার রিং রোডের ভবিষ্যৎ যানজটের কথা চিন্তা করে আমরা নতুন করে প্রকল্প নেয়ার বিষয়ে একমত হয়েছি।

জানা গেছে, চট্টগ্রামের পতেঙ্গা এলাকাকে ঘিরে সরকারি চারটি মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন। এর মধ্যে বন্দরের বে-টার্মিনালের কাজ শেষ হবে ২০২৪ সালে, টানেলের নির্মাণকাজ শেষ হবে ২০২২ সালের শেষার্ধে, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েরও নির্মাণকাজ শেষ হবে ২০২৩ সালের মাঝামাঝিতে। রিং রোড প্রকল্পের সঙ্গে তিনটি বড় প্রকল্পের সংযোগ নিয়ে পরিকল্পিত সংযোগ, প্রবেশ কিংবা নির্গমন কাজের সমন্বয় না থাকায় প্রকল্পটি দিয়ে সুবিধার পরিবর্তে যানজটসহ নতুন জটিলতায় পড়ার শঙ্কা রয়েছে।

নগর পরিকল্পনাবিদ প্রকৌশলী সুভাষ বড়ুয়া বণিক বার্তাকে বলেন, সড়কের পরিধি বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। সংস্থাগুলোর সমন্বয়হীনতার কারণে সরকারের ব্যয়সহ ভোগান্তিও বাড়ছে। 

বঙ্গবন্ধু টানেলের ট্রাফিক পূর্বাভাস অনুযায়ী, প্রতি বছর শতাংশের বেশি হারে টানেল দিয়ে যানবাহন চলাচলে প্রবৃদ্ধি হবে। হিসেবে ২০৩০ সাল নাগাদ প্রতিদিন পারাপার হওয়া যানবাহনের সংখ্যা দাঁড়াবে প্রায় ৩৮ হাজারে। ২০৪০ সালে তা ৬২ হাজার ছাড়িয়ে যাবে। আর প্রতিদিন প্রায় লাখ ৩০ হাজার যানবাহন চলাচল করবে ২০৬০ সাল নাগাদ। যে হারে যানবাহনের সংখ্যা বাড়বে, বিদ্যমান অবকাঠামো দিয়ে সে চাপ সামাল দেয়া কঠিন হয়ে যাবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।  

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন