শিপব্রেকিং ইয়ার্ড ঘিরে সীতাকুণ্ডে লাইফবোটের জমজমাট বাজার

দেবব্রত রায়, চট্টগ্রাম ব্যুরো

সীতাকুণ্ডের শিপব্রেকিং ইয়ার্ডকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে লাইফবোটের বাজার। সন্দ্বীপ চ্যানেলের বিভিন্ন খালের ওপর গড়ে ওঠা ভাসমান এসব বাজারে বিক্রি হচ্ছে লাখ লাখ টাকার বিদেশী জাহাজের লাইফবোট। সম্পূর্ণ ফাইবারের তৈরি প্রতিটি লাইফবোটের বিক্রয়মূল্য ২৫ হাজার থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত। সারা দেশের ক্রেতারা এসব লাইফবোট কিনতে সীতাকুণ্ড এলাকার মাদামবিবির হাট, মদনহাট, ভাটিয়ারী, কুমিরা এলাকায় হাজির হয়। দেশীয় কাঠের নৌকার চেয়ে দামে সস্তা লাইফটাইম টেকসই হওয়ায় স্ক্র্যাপ জাহাজের লাইফবোটের দিকে ঝুঁকছেন ক্রেতারা। খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, ফাইবারের তৈরি এসব লাইফবোট পরিবেশবান্ধব মজবুত। এসব বোটের স্থায়িত্ব বেশি হওয়ায় চাহিদাও প্রচুর।

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে-কুমিরায় দেশের একমাত্র জাহাজ ভাঙা শিল্পে আমদানীকৃত স্ক্র্যাপ জাহাজের লাইফবোটগুলো বিক্রয় করা হয় সোনাইছড়ি ইউনিয়নের মদনহাট খাল, মাদামবিবিরহাট ইছামতী খাল সোনারগাঁও খালে। এছাড়া ভাঙ্গাপুল এবং কুমিরার ঘোড়ামারা খালেও সীমিত পরিসরে বিক্রি হয় এসব লাইফবোট। প্রতিটি খালেই বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান তাদের লাইফবোটের পসরা খালের পাশে সাজিয়ে রাখেন। এছাড়া শিপইয়ার্ডগুলোতে স্ক্র্যাপ লোহা সংগ্রহের জন্য এসব বোটের ব্যবসা করা হয়।

সরেজমিনে সীতাকুণ্ড, ভাটিয়ারী কুমিরা এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, ভাসমান তিনটি খালে শত শত বিভিন্ন সাইজের লাইফবোট ভাসিয়ে রাখা হয়েছে। ক্রেতারা এসব বোট খালে ভাসিয়ে পরখ করেই দরদাম করছে। পছন্দ হয়ে গেলে সড়কের পাশেই পুরনো জাহাজের ইঞ্জিন অথবা নতুন ইঞ্জিন লাগিয়ে নৌপথে কিংবা সড়কপথে বিভিন্ন গন্তব্যে নিয়ে যান। অন্যদিকে ক্রেতার চাহিদা অনুসারে পুরনো ফাইবারের এসব বোট কেটে ছোট ছোট ডিঙ্গি বোট তৈরি করেন ব্যবসায়ীরা। যেগুলো দেখে বোঝার উপায় নেই যে সেগুলো হাতে তৈরি করা হয়েছে।

ব্যবসায়ীরা জানান, সমুদ্রে ছোট ডিঙ্গি নৌকার পরিবর্তে জেলেরা স্বল্পমূল্যের লাইফবোট ক্রয় করেন। এলাকায় প্রায় ৫০টি প্রতিষ্ঠান এসব লাইফ বোট বিক্রি করে থাকে। প্রতিটি প্রতিষ্ঠান মাসে গড়ে বড় সাইজের তিন-চারটি এবং ছোট সাইজের ১৫টি বোট বিক্রি করে থাকে। দেশে প্রতি বছর গড়ে প্রায় ২০০ থেকে ২৫০টির মতো স্ক্র্যাপ জাহাজ আসে। এসব জাহাজে সর্বনিম্ন দুটি ভালোমানের বড় সাইজের লাইফবোট থাকে। এর সঙ্গে থাকে ছোট কয়েকটি বোট। স্ক্র্যাপ জাহাজগুলো সীতাকুণ্ডে ইয়ার্ডগুলোতে প্রবেশের পর এসব বোট স্ক্র্যাপ হিসেবে ব্যবসায়ীদের কাছে দরপত্রের মাধ্যমে বিক্রি করা হয়। এরপর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের হাত ঘুরে এসব বোট ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পার্শ্ববর্তী খালে রাখা হয় বিক্রির উদ্দেশ্যে। ৮০ শতাংশের বেশি ফাইবারের হওয়ায় বোটগুলোর ওজন কম টেকসই। ফলে এসব বোটের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে বলে জানান সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা।

ভাটিয়ারীর মাদামবিবির হাট এলাকার মুনস্টার এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী মনির হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, দামের তুলনায় ভালোমানের বোট হওয়ায় দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ব্যবসায়ীরা পুরনো জাহাজের লাইফবোট কিনছেন। একটি কাঠের নৌকা বানাতে লাখ টাকা লাগলেও সমপরিমাণ পণ্য যাত্রী পরিবহনে সক্ষম একটি লাইফবোট অর্ধেক দামেই পাওয়া যায়। ফলে ক্রেতারা লাইফবোট কিনতে আগ্রহ বেশি। এমনকি ক্রেতা চাইলে তার পছন্দ অনুযায়ী বোট আমরা কেটে বানিয়ে দিয়ে থাকি।

তিনি আরো বলেন, ব্যবসায়ী বেড়ে যাওয়ায় স্ক্র্যাপ জাহাজগুলো থেকে বোট সংগ্রহ করাই এখন কঠিন হয়ে পড়েছে। সরকারি প্রতিষ্ঠান যেমন মেরিন কিংবা পর্যটন করপোরেশনের পার্টি এলে তারা বেশি দামে বোটগুলো কিনে নিয়ে যায়। যার কারণে ব্যবসা এখন আগের থেকে বেশি চ্যালেঞ্জিং হয়ে গেছে।

সীতাকুণ্ড এলাকার বিভিন্ন লাইফবোট বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দেশের বিভিন্ন পার্ক, হ্যাচারি, চিংড়ি ঘের, বিল, মাছ চাষের দীঘি, মাছ চাষের পুকুর, ছোট নদীতে মাছ ধরা নৌ-তীরবর্তী শিল্প-কারখানার মালিকরা কাঠের নৌকার চেয়ে জাহাজের লাইফবোট ক্রয় করে। ইলিশ মৌসুমে গভীর সমুদ্রে মাছ ধরতে যাওয়ার জন্য জেলেদের কাছে এসব লাইফবোটের চাহিদা প্রচুর। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান লাইফবোটগুলো নিজস্ব কারিগর দিয়ে হাঁস, পাখির আদলে সাজিয়ে সৌখিন ক্রেতা পর্যটন স্পটগুলোর ক্রেতাদের কাছে বিক্রি করেন। চট্টগ্রাম ছাড়াও বিভিন্ন উপকূলীয় এলাকার মানুষের চাহিদার শীর্ষে আছে লাইফবোটগুলো।

গত ২৯ বছর সীতাকুণ্ডে লাইফবোটের ব্যবসা করছেন মেসার্স খাজা আলম এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী মো. দিদারুল আলম। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, গত আড়াই যুগ ধরে আমি লাইফবোট ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। মাত্র ১০ হাজার টাকা দিয়ে এক জোড়া ফাইবারের বোট কিনে ব্যবসা শুরু করি। শুরুর দিকে বোটের আগ্রহ মানুষের ছিল না। বর্তমানে বোটগুলোর চাহিদা প্রচুর। সাইজ বিবেচনায় ২৫ হাজার থেকে ১০ লাখ টাকার লাইফবোট এখানে বিক্রি হয়। কিছু ক্ষেত্রে আমরা পুরনো বোটগুলো কেটে নতুন ডায়াসে ছোট বোট তৈরি করে বিক্রি করি। বাজারে সেগুলোর অনেক চাহিদা আছে বলে জানান তিনি।

তিনি আরো বলেন, আগে দরপত্রের মাধ্যমে বোটগুলো কিনলেও এখন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বেড়েছে। তাছাড়া অনেক বোট আছে যেগুলো বছরের পর বছর বিক্রি না হওয়ায় পড়ে থাকে। যার কারণে ব্যবসাটি লাভজনক হলেও ঝুঁকিও অনেক বেশি।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন