আলোকপাত

বাংলাদেশ-ভারত বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সম্পর্কের পাঁচ দশক

ড. সেলিম রায়হান

গত পাঁচ দশকে বাংলাদেশ ভারতের অসম বাণিজ্য বিনিয়োগের অংশীদার হয়েছে। আমদানির ক্ষেত্রে ভারত আমাদের একটা বড় উৎস ছিল। যদিও এখন চীন অবস্থানটি নিয়েছে। ভারত এখন বাংলাদেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ আমদানি ক্ষেত্র। ভারত থেকে আমরা যেসব পণ্য আমদানি করি গত কয়েক বছরে তার কম্পোজিশনে বড় পরিবর্তন এসেছে। শুরুর দিকে আমাদের অতিমাত্রায় নির্ভরতা ছিল খাদ্যপণ্য নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানির ওপর। বর্তমানে কাঁচামাল শিল্পায়নে প্রয়োজনীয় মূলধনি যন্ত্রের মতো পণ্যের দিকে আমদানিটা স্থানান্তরিত হয়েছে। তার অর্থ হলো ভারত থেকে আমরা যা আমদানি করছি তার বড় অংশ রফতানি খাতে কাঁচামাল হিসেবে কিংবা যন্ত্রপাতি হিসেবে ব্যবহার করতে পারছি এবং দেশীয় শিল্প-কারখানায় তার ব্যবহার দেখছি। ভারত থেকে আমদানির ক্ষেত্রে এই যে কম্পোজিশনাল শিফট সেটি ইতিবাচক। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিসরে বেশ একটা ইতিবাচক পরিবর্তন হিসেবে দেখব। কারণ ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য করা অন্য প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে ধরনের গাঠনিক/উপাদানগত রূপান্তরটা  দেখা যাচ্ছে না। শ্রীলংকার ক্ষেত্রে কিছুটা হয়েছে, নেপাল-ভুটানের ক্ষেত্রে একদমই না। নেপাল ভুটানের ভারতের ওপর একটা অতিমাত্রায় নির্ভরতা আছে একেবারে বেসিক কমোডিটিজ নিয়ে। সেদিক থেকে বাংলাদেশ ভারত থেকে আমদানির ক্ষেত্রে নিজের সক্ষমতা বৃদ্ধি করেছে। সক্ষমতাকে অনেকের তুলনায় যথাযথভাবে ব্যবহার করতে পেরেছে।

রফতানি ক্ষেত্রে লক্ষ করছি বাংলাদেশ থেকে ভারতে রফতানি বেড়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় ভারতে পণ্য রফতানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করেছে। কিন্তু বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যায় যে ভারতে বাংলাদেশের রফতানি করার আরো অনেক বেশি সক্ষমতা আছে। আরো সম্ভাবনাও আছে। এক্ষেত্রে কিছু শুল্ক অশুল্ক বাধা আছে, এগুলোকে যদি দূর করা যায় তাহলে বাংলাদেশ থেকে ভারতে রফতানি বেশ কয়েক গুণ বাড়বে। তবে বাংলাদেশ এখনো পিছিয়ে আছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় শুল্ক বাধা অবশ্য তেমন নেই, যেহেতু উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে ২০১১ সাল থেকে ভারত শুল্ক সুবিধা দিয়েছে। কিন্তু বিভিন্ন সময়ে অশুল্ক বাধার মুখোমুখি হয়েছেন বলে রফতানিকারকরা অভিযোগ করেছেন।

কিছু ক্ষেত্রে অবশ্যই অগ্রগতি হয়েছে। কিন্তু বেশকিছু ক্ষেত্রে বিশেষ করে ভারত বাংলাদেশের মধ্যে যে বাণিজ্যের ধরন এবং বাণিজ্যের যে উপায় অর্থাৎ নদী স্থলবন্দরের কাঠামোগত অবকাঠামোগত অবস্থা অনেক দুর্বল। ফলে এটা বাংলাদেশ থেকে ভারতে রফতানির ক্ষেত্রে ভালো রকম প্রতিবন্ধকতা হিসেবে কাজ করছে। পাশাপাশি কিছু লেজিটেমেট নন-ট্যারিফ মেজারস আছে, যেমন টেকনিক্যাল পণ্যের ক্ষেত্রে ফাইটো-স্যানিটারি মেজারস।

কৃষিপণ্য থেকে শুরু করে প্রক্রিয়াজাত কৃষিপণ্য অথবা শিল্প পণ্য সেগুলোর ক্ষেত্রে বাংলাদেশ যে সার্টিফিকেট ইস্যু করে, সার্টিফিকেটের যে অথরিটি তাদের অনেক সার্টিফিকেট ভারত গ্রহণ করে। সেক্ষেত্রে মেজর রিকগনিশন এগ্রিমেন্ট বলি অথবা আমাদের যে সার্টিফিকেট ইস্যু ইন অথরিটির সক্ষমতা বৃদ্ধি এগুলো সামনের দিনগুলোতে যথেষ্ট গুরুত্ব পাবে।

আমদানি রফতানির ক্ষেত্রে ভারত বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হয়েছে বিগত বছরগুলোতে। সাম্প্রতিক দশকগুলোতে রফতানি বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে রফতানিতে সাফল্যও এসেছে। বিশেষ করে গার্মেন্টস সেক্টরে ভারত থেকে কাঁচামাল আমদানির যে পণ্য সেগুলো যথাযথ ব্যবহার করে রফতানি করতে পেরেছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের রফতানি হয়তো কয়েক গুণ বেড়েছে, কিন্তু সম্ভাবনা আরো বেশি আছে। এটা গেল বাণিজ্যের দিক।

বিনিয়োগের দিকে লক্ষ করা যাক। ভারতের যে বিনিয়োগকারীরা আছেন তারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যে পরিমাণ বিনিয়োগ করেন, এশিয়া-আফ্রিকাসহ অনেক দেশে, সে তুলনায় বাংলাদেশে তাদের বিনিয়োগ অনেক কম। বড় ধরনের কোনো বিনিয়োগ এখনো করেনি ভারত। বিশেষ করে ম্যানুফ্যাকচারিংসহ আনুষঙ্গিক যে খাতগুলো রয়েছে। সুবিধা ভারত থেকে এখন পর্যন্ত নেয়া যায়নি। বাংলাদেশ যেহেতু শুল্কমুক্ত সুবিধা পায় পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ভারত অথবা কানাডায় পায়। ভারতের বিনিয়োগকারীদের আমি দেখিনি যে তারা বাংলাদেশে বিনিয়োগ করে ওই দেশগুলোতে রফতানি করা বা সুযোগ-সুবিধা নেয়ার উদ্যোগ নেয়। কিছু কিছু ভারতের বিনিয়োগকারী হয়তো বাংলাদেশের আমদানি-রফতানিতে আছেন, তবে বড় পরিসরে নেই। সম্প্রতি যে উদ্যোগগুলো দেখছি, বিশেষ কোনো জোনের মাধ্যমে বিশেষ করে ভারতীয় বিনিয়োগকারীদের জন্য ডেজিগনেটেড। কিন্তু যতটুকু আমরা দেখি তথ্য-উপাত্ত সেগুলোর অগ্রগতি সন্তোষজনক নয়। জায়গাটা আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ একটা দিক। এজন্য বাংলাদেশ-ভারত বাণিজ্য ভারসাম্যের দিকে যদি তাকাই প্রতি বছরই সেটি বাংলাদেশের বিপক্ষে যাচ্ছে। দুদেশে বাণিজ্যিক ঘাটতি রয়েছে। যদিও আমি আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ছাত্র হিসেবে বলি যে বাণিজ্যিক ঘাটতি খুব বেশি উদ্বেগজনক নয়। বাংলাদেশ ভারতের যেমন দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যিক ঘাটতি আছে ঠিক তেমনই দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যিক উদ্বৃত্ত আছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন বা ইইএসের সঙ্গে। বাংলাদেশ যে পরিমাণে পণ্য ভারত থেকে আমদানি করে তার একটি বড় অংশ রফতানি খাতে ব্যবহূত হয়। ধরনের বাণিজ্যিক ঘাটতি উদ্বেগের বিষয় নয়। কিন্তু ওই জায়গাটা অবশ্যই থাকবে বাংলাদেশের, যে জায়গায় সম্ভাবনাগুলো রয়েছে সে জায়গাগুলোতে রফতানি বাড়াতে হবে। সে ক্ষেত্রে বিনিয়োগটা বড় একটা চালিকাশক্তি হতে পারত ভারতের বিনিয়োগে। সে জায়গায় ভালোভাবে নজর দেয়া দরকার। বিশেষ করে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বাংলাদেশে বিনিয়োগের পরিবেশের দিক থেকে অনেক পিছিয়ে আছে। বিনিয়োগের ক্ষেত্রে যেসব আইন বা নীতি আছে, সেক্ষেত্রে দেশে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা বড় বাধা হয়ে আছে। এগুলো দূর করে ভারতের বিনিয়োগ বিভিন্ন খাতে, বিশেষ করে অবকাঠামো, সেবা, পর্যটন, যোগাযোগ, পরিবহনে জোর দেয়ার সুযোগ আছে।

বাণিজ্য বিনিয়োগে আমরা যদি একটা আন্তঃসম্পর্ক দেখতে চাইসে আন্তঃসম্পর্কের ক্ষেত্রে তাদের ভেতরে যে মিথস্ক্রিয়া হয় এবং মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে যে সর্বোচ্চ লাভ করা যেতে পারে সে সুযোটা আমি মনে করি এখনো রয়েছে বাংলাদেশের। দুদেশের যে সুযোগগুলো রয়েছে তার কিয়দংশ মাত্র কাজে লাগাতে পেরেছি।

মাঝেমধ্যে এমন ঘটনাও দেখছি, ভারত কিছু পণ্য হঠাৎ বন্ধ করে দিয়েছে। এতে বাংলাদেশ কিছুটা ঝুঁকিতে পড়েছে। এখানে দুদিকেই কাজ করার সুযোগ রয়েছে। একদিকে ভারত ধরনের রফতানি বন্ধ করার ক্ষেত্রে শুধু পেঁয়াজই না, টিকার ক্ষেত্রেও বন্ধ করেছে। তাদের অভ্যন্তরীণ যে সমস্যাগুলো রয়েছে, যেমন তাদের দেশের মানুষের চাহিদার ওপর জোর দেয় তারা। যখনই ভারতের রফতানির ক্ষেত্রে ধরনের সমস্যা দেখেছি তখন দেখা যায় যে তাদের দেশে এসব পণ্যের উৎপাদন কম হয়েছে অথবা তাদের দেশে অনেক চাহিদা বেড়ে গেছে। ফলে ওই অবস্থায় রফতানি করলে দেশের চাহিদা পূরণ হবে না বলে মনে করেছে ভারত। একটি দেশ তার রফতানি বন্ধ করবে কিনা, তা আন্তর্জাতিক নিয়মের মধ্যে করলে ভালো হয়। হুট করে রফতানি বন্ধ করার চেয়ে যেসব দেশে আমদানিনির্ভরতা আছে, সে দেশগুলো যেন বিকল্প উপায়গুলো খুঁজে বের করতে পারে সে সুযোগটা থাকা উচিত। বাংলাদেশকে আমরা দেখেছি রকম সময়ে কোনো পূর্বপ্রস্তুতি না থাকায়, যথেষ্ট সংকটের মধ্যে পড়ে গেছে। নীতিনির্ধারকদেরও কিন্তু স্টাডি করার ব্যাপার আছে। যেসব দেশের পণ্যে বাংলাদেশের অতিমাত্রায় আমদানিনির্ভরতা আছে, সেসব দেশে ওই পণ্যের উৎপাদন চাহিদার তথ্য-উপাত্তগুলো আপডেটেড আছে কিনা, সেক্ষেত্রে আমি মনে করি আমাদের যথেষ্ট পরিমাণে হোমওয়ার্ক নিয়মিত করা উচিত। তা না হলে আমরা রকম পরিস্থিতির শিকার হব। আমাদের দিক থেকে হোমওয়ার্কের দুর্বলতা আছে। আমরা দেখি যখন রফতানি বন্ধ করে দেয়, তখন আমরা সাঁতরাতে থাকি কোন দেশ থেকে আমরা আমদানি করব এবং কীভাবে করব। এখন তো লাইভ ডাটা পাওয়া যায়। আমরা যদি সব ক্ষেত্রে সংযুক্ত থাকি, এমনকি আমাদের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে শুরু করে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলো আছে, তারা যদি ওই অংশীদার দেশগুলোর সংস্থাগুলোর সঙ্গে এক ধরনের যোগাযোগ রাখতে পারে, পরস্পর তথ্য বিনিময় করে তাহলে ধরনের ঝুঁকিগুলোকে কাটানোর সুযোগ থাকে।

দীর্ঘ সময় হয়ে গেল পাটের ওপর ভারত অ্যান্টিডাম্পিং শুল্ক আরোপ করেছে। অনেক জায়গা থেকে তাদের অনুরোধও করা হয়েছে এটা তুলে নেয়ার জন্য। কিন্তু এটা তুলে নেয়া হয়নি। এটা শুধু বাংলাদেশের ওপর না, যারা পাটজাত দ্রব্য রফতানি করে, যেমন নেপালের ওপরও এটা আরোপ করা হয়েছে। এটা মোকাবেলা করার জন্য যারা পাটজাত দ্রব্যের রফতানিকারক বা প্রস্তুতকারক, তাদের হিসাবরক্ষণের স্বচ্ছতা লাগবে। এটাকে যদি আমরা ডিজবার্স সেটেলমেন্টে নিতে চাই, তার জন্য আমাদের রফতানিকারকরা যে ডাম্প করছে না তার প্রমাণ লাগবে। সেক্ষেত্রে তাদের খরচে বা হিসাবরক্ষণে কোথায় ডাম্পিং হচ্ছে, সেখানে স্বচ্ছতা লাগবে। দুর্ভাগ্যবশত, অনেকের মাঝে এই স্বচ্ছতাটা নেই। এটার একটা কারণ হচ্ছে, বাংলাদেশে এই হিসাবরক্ষণ প্রক্রিয়াটা সঠিকভাবে করা হয় না। হয়তো তারা ডাম্পিং করছে না, কিন্তু যেহেতু তাদের হিসাবরক্ষণ প্রক্রিয়াটা ভালোভাবে করা হয় না, তাই তারা কোনো কোনো ক্ষেত্রে অন্যায় বা ট্যারিফের শিকার হচ্ছে। এটা আমাদের জন্য একটা শিক্ষা। সামনের দিনগুলোতে ধরনের অ্যান্টি ডাম্পিং বিভিন্ন ধরনের নন-ট্যারিফ পদক্ষেপ বাংলাদেশকে মোকাবেলা করতে হবে। এগুলো মোকাবেলা করার জন্য বাংলাদেশের ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন, মিনিস্ট্রি অব কমার্স, বেসরকারি খাতের যেসব অ্যাসোসিয়েশন আছে এবং উৎপাদকদের যথেষ্ট রকমের সচেতন হতে হবে। অনেকে বিষয়গুলো সম্পর্কে ভালো করে জানেনও না।  অনেক সময় আলংকারিক উপায়ে অথবা পপুলারভাবে আমরা বলি এগুলো অন্যায়ভাবে চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। এসব কথায় কিন্তু আমাদের যথেষ্ট প্রমাণ থাকতে হবে। সে জায়গায় আমরা দুর্বল। আমার কাছে মনে হয় শুধু প্রতিবাদ করার জন্য প্রতিবাদ করাটা যথেষ্ট নয়। আমাদের যথার্থ তথ্যপ্রমাণ নিয়ে প্রতিবাদ করতে হবে। আমি মনে করি কোনো কোনো ক্ষেত্রে আমাদের যথেষ্ট প্রস্তুতি নেই। সেক্ষেত্রে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, ট্যারিফ কমিশন গবেষণার কাজ করার কথা। এছাড়া বেসরকারি পর্যায়ে যারা নেতৃত্বস্থানীয় প্রতিষ্ঠান রয়েছে বিভিন্ন কর্মশালা করে তাদের সক্ষমতা বাড়ানো যেতে পারে। পাশাপাশি নেগোসিয়েশন স্কিলও বাড়াতে হবে। কোনো কোনো জায়গায় অবশ্যই হয়তো আমাদের অন্যায়ভাবে চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে। সেটাকে তো নেগোসিয়েট করতে হবে। নেগোসিয়েশনের কতগুলো লেভেল আছে, যেসব জায়গায় সমস্যা হচ্ছে সেসব জায়গায় শক্ত জবাব দেয়ার সুযোগ থাকলে উচ্চ পর্যায়ে যাওয়ার কোনো দরকার নেই। আমাদের যেটা হচ্ছে আমরা যখন শক্তভাবে জবাব দিতে পারি না তখন অন্যভাবে সমাধান করার চেষ্টা করি। আমরা প্রতিটি দেশের সঙ্গে রাজনৈতিকভাবে সমাধান করার চেষ্টা করব? প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতি বলে দেবেনআমাদের যেটা করতে হবে ট্যারিফ বা নন-ট্যারিফ রিলেটেড যে সমস্যাগুলো হচ্ছে সেসব ক্ষেত্রে যথেষ্ট পরিমাণে সক্ষমতা অর্জন করতে হবে। আমরা যদি সঠিকভাবে সমস্যাগুলো মোকাবেলা করতে না পারি তাহলে এটি দীর্ঘায়িত হতে থাকবে। আমাদের বিএসটিএর সক্ষমতা বাড়াতেই হবে। বিএসটিএর সক্ষমতা বাড়ানোর পর যদি দেখি এটির পণ্য ভারতের চেয়ে অগ্রগতি হয়েছে, যেমন সিঙ্গাপুর নিচ্ছে ভারত নিচ্ছে না। এমন অবস্থা তৈরি হলে ভালোভাবে বলার সুযোগ থাকবে। আমরা বলতে পারব আমাদের পণ্য অন্যান্য দেশ নিচ্ছে। তোমরা কেন নিচ্ছ না। তাহলে তোমরা অন্যায়ভাবে আমাদের পণ্য নিচ্ছ না। কথা বলার পূর্বশর্ত হলো আমাদের সক্ষমতা বাড়াতে হবে।

বাংলাদেশের অনেক বিনিয়োগকারী আছেন যারা ভারতে বিনিয়োগ করতে চান। যদিও তারা দেশে বিনিয়োগ করার ক্ষেত্রে নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতার কথা বলেন। তাদের ভারতে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে দোষের কিছু দেখি না। যেহেতু আমাদের দেশে ক্যাপিটাল অ্যাকাউন্ট রাখতে একটা ভয় আছে। তাছাড়া টাকা পাচারের অভিযোগও রয়েছে। আবার আমাদের রেগুলেটর অথরিটি বা বাংলাদেশ ব্যাংক মনে করে, যদি পুরোপুরি অনুমতি দেয়া হয় বাইরে বিনিয়োগ করার, তাহলে হয়তো বেশ বড় পরিমাণে টাকা বাইরে ঠেলে দেব। তারা হয়তো অ্যাপ্রোচটা নিয়েছে কেস বাই কেসেস। আমি মনে করি কেস বাই কেসেস বেসিসে আর কিছুদিন বাংলাদেশের বাইরে বিনিয়োগ করার বিষয়টিকে বিবেচনা করা যেতে পারে। হয়তো কোটেশনটা বাড়ানোর সুযোগ আছে। যে বিনিয়োগটা বাংলাদেশ থেকে ভারতে হচ্ছে সেটা যদি আরো কিছু বিনিয়োগকারী বাংলাদেশ থেকে ভারতে করতে চায়, তাহলে শর্তটা হচ্ছে, কী পরিমাণে অর্থ তারা বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনছে এবং লাভটা বাংলাদেশের কী হচ্ছে, সে জায়গায় হয়তো প্রতিষ্ঠানগুলোর দেন-দরবার করার সুযোগ আছে। আমি মনে করি যে ভারতে বিনিয়োগ করার ক্ষেত্রে বালাদেশের বিনিয়োগকারীরা বেশি সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছেন। ভারতে প্রতিনিয়ত নানা ধরনের নিয়ম-নীতি হচ্ছে। বিশেষ করে উত্তরে অবস্থিত রাজ্যগুলোতে বিনিয়োগ করার ক্ষেত্রে ভারত নতুন নতুন নিয়মনীতি চালু করেছে। যদিও ওই অঞ্চলগুলোতে বড় ধরনের বিনিয়োগ করার সুযোগ আছে। অনেক ক্ষেত্রে আমি মনে করি বাংলাদেশের জয়েন্ট ভেঞ্চারে যাওয়া উচিত। আমরা পণ্যের কথা বাদ দিই, পর্যটনের কথাও যদি বলি বিশেষ করে পর্যটন খাতে বাংলাদেশ-ভারত একসঙ্গে বিনিয়োগ করার সুযোগ আছে। বাংলাদেশ ভারতের যে পর্যটনের জায়গাগুলো রয়েছে, সেটা কালচারভিত্তিক হতে পারে বা ধর্মীয় দিকসহ বিভিন্ন দিক হতে পারে। এছাড়া শিক্ষা খাতে জয়েন্ট ভেঞ্চারের সুযোগ আছে। সেবা খাতেও জয়েন্ট ভেঞ্চারের সুযোগ আছে।

ভারতের অর্থায়নে প্রকল্পগুলোর অগ্রগতি শ্লথগতির বলে অভিযোগ রয়েছে। আমাদের এখানেও কিছু সমস্যা আছে। অনেক ক্ষেত্রে প্রজেক্টটা যথাযথভাবে ডিজাইন করতে না পারা, সময়মতো প্রপোজালটা ডেভেলপ করতে না পারা, যথাযথভাবে নেগোসিয়েট করতে না পারা। আমাদের তো ভারত থেকে অর্থ নিয়ে উন্নত করাই একমাত্র উদ্দেশ্য না, আমাদের তো আরো বিভিন্ন দেশ থেকেও নেয়ার সুযোগ আছে। সেগুলোও কিন্তু এক্সিকিউট করার সুযোগ আছে। আর এসব সমস্যা আমাদের কমন। শুধু ভারত থেকে পাওয়ার জন্য নয়, অন্যান্য বিভিন্ন প্রকল্পেই দীর্ঘসূত্রতা রয়েছে। আমার কাছে যেটা মনে হয় যে ভারতেরও আমলাতান্ত্রিক সমস্যাগুলো আছে। তাদের বেশকিছু মনমানসিকতাও বাধা হিসেবে কাজ করছে।

সমাধানের পথ হচ্ছে ট্রান্সপারেন্সি থাকা। অর্থাৎ কোন ধরনের প্রজেক্টগুলো হচ্ছে এবং সে প্রজেক্টগুলো বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কতটুকু ভূমিকা রাখাতে পারে, তথ্য-উপাত্তের একটা স্বচ্ছতা থাকা উচিত। পাশাপাশি জবাবদিহিতার জায়গায় আসা উচিত। আমলাতান্ত্রিক জটিলতাগুলো দূর করা। দুই পক্ষের দক্ষ লোকগুলোকে কাজে লাগানো। যারা বিষয়ে অভিজ্ঞ রয়েছেন তারা যদি কাজে অংশগ্রহণ করেন, তারা যাতে সুন্দর মতামত দিতে পারেন সে সুযোগটা থাকা। অনেক সময় আমরা দেখি যে বিভিন্ন প্রজেক্ট হয়, সেগুলোতে ডিজাইনে বড় ধরনের সমস্যা হয় যা কিনা আমরা পরে উপলব্ধি করি। অনেক সময় প্রথম থেকে অভিজ্ঞ লোকগুলোর ইনভলভ থাকে না। জায়গাগুলোতে নজর দেয়া যেতে পারে। পাশাপাশি আমি যেটা জোর দেব যে ভারতের বিনিয়োগকারীদের জন্য যে ইকোনমিকস হোমগুলো প্রস্তাবিত আছে, এগুলোকে যত দ্রুত সম্ভব বাস্তবায়ন করা যায়।

বিবিআইএন মোটর ভেহিকল এগ্রিমেন্ট থেকে ভুটান বের হয়ে গেছে। নেপালেরও কিছু সমস্যা আছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ভারত দ্বিপক্ষীয়ভাবে এটা শুরু করতে পারে। এটা অনেক ক্ষেত্রেই খরচ কমিয়ে দেবে। বিশেষ করে বাংলাদেশের রফতানি আমদানিকারকদের জন্য। সেটা করার জন্য যে পূর্বশর্তগুলো আছেঅবকাঠামো উন্নয়নের যে জায়গাগুলোএসব অবকাঠামো উন্নয়নের জায়গাগুলোতে ভারত কিন্তু বিনিয়োগ করতে পারে। লাভ কার বেশি হবে সেটি চিন্তা করলে দেখা যাবে বৃহৎ দেশ হিসেবে ভারতের এটা সুযোগ আছে। এটা আমাদের মনে করতে হবে যে চট্টগ্রাম বন্দর, মোংলা বন্দর আছে সেগুলোর মাধ্যমে যদি আমরা ইন্টিগ্রেটেড আঞ্চলিকভাবে গড়ে তুলতে পারি সেটাতে কিন্তু বাংলাদেশও পাবে। সেটা কিন্তু নেপাল ভুটানকেও দিতে পারবে। ভারতের অন্য যে রাজ্যগুলো আছে তারা তো বটেই এই যে বিদ্যমান পরিকল্পনাগুলো আছে, এগুলো বাস্তবায়ন করা এবং তার জন্য যে উদ্যোগগুলো নেয়া সেটাকে আরো ত্বরান্বিত করা দরকার।

বাংলাদেশের যে অতীতের অগ্রগতি তার ওপর ভিত্তি করে নতুন ধরনের উদ্যম নিয়ে সামনে এগোতে হবে। এটা কিন্তু ভাবার কারণ নেই যে বিগত দিনগুলোতে গতানুগতিক যেভাবে আমরা এগিয়েছে সামনের দিনগুলোতে সেভাবে এগোব। কারণ আপনি দেখেন, বাংলাদেশের সামনের দিনগুলোতে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ আছে। যেমন আগামী ১০ বছরের মধ্যে উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা। ২০ বছরের মধ্যে ধনী দেশে পৌঁছানো। সে জায়গায় পৌঁছাতে বাংলাদেশের বড় ধরনের অ্যাটিচিউড উন্নতি দরকার। তার অর্থ হচ্ছে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের যে চুক্তি রয়েছে সেগুলোতে বাংলাদেশকে আরো প্রোঅ্যাকটিভ হতে হবে। বাংলাদেশ আগামী কয়েক বছরের মধ্যে এলএসির মাধ্যমে তার বাণিজ্য সুবিধা হারাবে ২০২৬-এর পর থেকে। ভারতের সঙ্গে যে দ্বিপক্ষীয় চলমান চুক্তি আছে সেটিকে কীভাবে কার্যকর জায়গায় নিয়ে যাওয়া যায়। পাশাপাশি শুধু ভারত বাংলাদেশ না, আমি যেটা বৃহত্তর পরিসরের কথা বলছি, আঞ্চলিক জায়গাগুলোতে আরো প্রোঅ্যাকটিভ হওয়া। আমাদের যারা নীতিনির্ধারক রয়েছেন, যারা বাণিজ্য বিষয়ে মন্ত্রণালয়গুলোতে যুক্ত, তাদের দক্ষতা বৃদ্ধি, তাদের মনমানসিকতাকে আরো বেশি ডায়নামিক করা। আমি যেটা বলব যে নতুন নতুন যে উন্নয়নগুলো হচ্ছে বিশ্বব্যাপী বা আঞ্চলিকভাবে বাণিজ্য আলোচনার ক্ষেত্র বা চুক্তির বিষয়ে তাদের আপডেট থাকতে হবে। নতুন অ্যাপ্রোচ নিয়ে যদি এগোনো যায়, তাহলে আমার মনে হয় যে সামনের দিনগুলোতে যে নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ আসছে সেগুলো মোকাবেলা করতে পারবে। পুরনো পদ্ধতিতে এগোলে সামনের দিনগুলোতে বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে।

গতানুগতিক প্রক্রিয়াটা কী ছিল, আমরা তো বিভিন্ন দেশ থেকে সুবিধা পেয়েই আসছি। সে সময় আমাদের এত বেশি প্রোঅ্যাকটিভ হতে হয়নি। এখন আমরা যে সুবিধাগুলো হারাব, সামনের দিনগুলোতে সুবিধা হারানোর কারণে আমাদের ওপর বেশকিছু চাপ আসবে। বিশেষত রফতানির ওপর চাপ আসবে, ওষুধ শিল্পের ওপর চাপ আসবে। এছাড়া বেশকিছু জায়গা থেকে ঋণ পাওয়ার সুযোগও হারাব। সামনের দিনগুলোতে এসব সুবিধা কমে আসবে। সুতরাং সে বিষয়গুলো বিবেচনা করে আমাদের অ্যাপ্রোচ, মনমানসিকতা আরো অনেক বেশি ডায়নামিক হওয়া দরকার। আমাদের দক্ষতা সক্ষমতা অনেক বেশি দরকার।

বাংলাদেশ ভারতের বর্তমান সম্পর্ক যে পর্যায়ে রয়েছে সেখানে কিছু বিষয় একেবারেই খাপ খায় না। নদী পানি বণ্টনের মতো যে বিষয়গুলো আছে সে বিষয়গুলো সমাধানে বেশি দীর্ঘসূত্রতা রয়েছে। এটা কাম্য নয়। এমনকি সীমান্তে যে হত্যাগুলো হয়, সেসব বিষয় বা ঘটনাগুলো নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের তরফ থেকে বিভিন্ন সময় অভিযোগ করা হয়। অথচ দুই দেশের সম্পর্কের সঙ্গে এটা সংগতিপূর্ণ নয়। বিষয়গুলো অবশ্যই বাংলাদেশের পক্ষ থেকে তুলে ধরা দরকার। আর ভারতের যারা বিষয় নিয়ে আন্তরিক, সরকারে কিংবা সরকারের বাইরে, তাদেরও বিষয়টি সমাধানের জায়গায় নিয়ে আসতে হবে।

[শ্রুতলিখন: রুহিনা ফেরদৌস]

 

. সেলিম রায়হান: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক সানেমের নির্বাহী পরিচালক

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন