বিশ্ব খাদ্য নিরাপত্তা

দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ভোগান্তি

জয়তী ঘোষ

কীভাবে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করা যায়, অর্থনীতির এজেন্ডায় বিষয়টি পুনরায় ফিরে এসেছে। তবে কীভাবে একে চিহ্নিত করা যায় তা নিয়ে তৈরি হয়েছে মতপার্থক্য। মূলধারাটি কঠোর আর্থিক নীতির প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেয় এবং উচ্চ সুদের হার হ্রাসকৃত তারল্য বিধানকে ন্যায়সংগত হিসেবে বিবেচনা করে। যদিও বিষয়গুলো অনেক দেশের চলমান ভঙ্গুর অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার বাধাগ্রস্ত করে। এদিকে অন্যদের যুক্তি হচ্ছে, বর্তমানের মূল্যস্ফীতির বিষয়টি ক্ষণস্থায়ী; যা অস্থায়ী সরবরাহকে বাধাদানের পাশাপাশি  শ্রমবাজার পরিবর্তনকে প্রতিফলিত করে। তাই স্বয়ংক্রিয়ভাবে এটি ঠিক হয়ে যাবে।

ধনী দেশগুলোয় নীতিনির্ধারকরা এখনো মূল্যস্ফীতি মোকাবেলার ক্ষেত্রে প্রধানত সামষ্টিক অর্থনৈতিক নিয়মনীতির ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু একজাতীয় খাবার থেকে অন্য ধরনের খাবারের মূল্যবৃদ্ধির বিষয়টি কিন্তু সম্পূর্ণ ভিন্ন। উন্নয়নশীল দেশগুলোয় -জাতীয় ঘটনা কেবল মানুষের জীবনকে সরাসরি অনেক বেশি প্রভাবিতই করে না, বরং আরো জটিল কারণগুলোকেও প্রতিফলিত করে; যা কার্যকরভাবে মোকাবেলা করার জন্য সম্পূর্ণ একটি ভিন্ন কৌশলের প্রয়োজন পড়ে। 

দুর্ভাগ্যবশত, সরকারগুলো বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে আলোচনা করছে না। তাদের ধরনের উদাসীনতা অচিরেই গভীর সংকটের জন্ম দেবে। ২০২১-এর শেষের দিকে জাতিসংঘের খাদ্য কৃষিবিষয়ক সংস্থার (এফএও) খাদ্য মূল্যসূচক এক দশকের মধ্যে সবচেয়ে শীর্ষ অবস্থানে পৌঁছে। সংখ্যাটি ২০১১ সালের জুন সূচকের প্রায় কাছাকাছি। আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে যে ২০১১ সালে খাদ্য মূল্যসূচক বৃদ্ধিকে ঘিরে অনেকেই বৈশ্বিক খাদ্য সংকটের বিষয়ে সতর্কবার্তা জারি করেছিলেন। 

উপরন্তু, গত বছর মূল্যসূচক বৃদ্ধির বিষয়টি ছিল অপ্রত্যাশিত: ২০১৫ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত খাদ্যমূল্য তুলনামূলক কম এবং স্থির ছিল। কিন্তু ২০২১ সালে গড়ে বৃদ্ধি পায় ২৮ শতাংশ। এর নেপথ্য কারণ ভুট্টা গমজাতীয় খাদ্যসহ সিরিয়ালের (বিভিন্ন শস্যদানা দিয়ে তৈরি খাবার, যা সকালের নাশতায় খাওয়া হয়) দাম ৪৪ থেকে ৩১ শতাংশ বৃদ্ধি। এছাড়া দাম বেড়েছে অন্যান্য খাদ্যপণ্যেরও: গত বছর ভেজিটেবল অয়েলের দাম রেকর্ড ছাড়িয়ে যায়। চিনির দাম বাড়ে ৩৮ শতাংশ। মাংস দুগ্ধজাতীয় পণ্যের দাম তুলনামূলক কম থাকলেও ডাবল ডিজিট থেকে সিঙ্গেল ডিজিটে নামেনি। খাদ্য মূল্যস্ফীতি বর্তমানে সামগ্রিক মূল্যসূচকের বৃদ্ধি ছাড়িয়ে গেছে। কভিড-১৯ মহামারী চলাকালীন শ্রমিকদের মজুরি আয়ের উল্লেখযোগ্য হ্রাসের কারণে এটি আরো উদ্বেগজনক, বিশেষ করে নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশগুলোয়। অধিক ব্যয়বহুল খাদ্যের প্রাণঘাতী সংমিশ্রণ এবং নিম্ন আয় ক্ষুধা অপুষ্টিকে বিপর্যয়কর অবস্থার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। খাবারের দাম বাড়ার সম্ভাব্য কারণ কিন্তু অনেক, যার কিছুটা পদ্ধতিগত। যেমন সরবরাহ শৃঙ্খলের সমস্যা, বিশেষ করে পরিবহনসংক্রান্ত, যা পণ্যের বিস্তৃত পরিসরে মূল্যবৃদ্ধির প্রধান কারণ হিসেবে কাজ করছে। তবে দশমিক বিলিয়ন টন রেকর্ড পরিমাণ বৈশ্বিক উৎপাদন সত্ত্বেও ২০২১ সালে শস্যের দাম অনেক বেশি দ্রুত হারে বেড়েছে। তাছাড়া শস্য উৎপাদন পরিবহন খরচ নির্ধারণের ক্ষেত্রে জ্বালানির মূল্যও গুরুত্বপূর্ণ। ২০২১ সালে তেলের দামের ব্যাপক বৃদ্ধির কারণে ভোক্তাদের খাদ্যপণ্য ক্রয়ের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত মূল্য পরিশোধ করতে হয়েছে। এছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে শস্য উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হ্রাস পাচ্ছে। এদিকে কেউ কেউ যুক্তি দেখাচ্ছেন যে গত বছর জলবায়ু পরিবর্তন উৎপাদনকে প্রভাবিত করার কারণে কৃষিপণ্যের দাম ঠিক ব্রাজিলিয়ান কফি, বেলজিয়ামের আলু কিংবা কানাডিয়ান হলুদ মটরের (বর্তমানে মাংসের বিকল্প হিসেবে উদ্ভিদভিত্তিক খাবারগুলো ব্যাপক হারে ব্যবহার হচ্ছে) মতো পণ্যের মূল্য দ্রুত অসমভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।

২০২১ সালের মার্চে এফএও সতর্ক করে দিয়ে বলেছে যে কৃষি সরবরাহকে প্রভাবিত করছে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবজনিত বিপর্যয়। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বৃহৎ হুমকি হয়ে এসেছে খরা। যা নিম্ন নিম্নমধ্যম আয়ের দেশগুলোয় ফসল গবাদি পশুর এক-তৃতীয়াংশ ক্ষতির জন্য দায়ী। কিন্তু বন্যা, ঝড়, পোকামাকড়ের আক্রমণ এবং বনাঞ্চলে দাবানলের ঘটনাগুলো আগের তুলনায় কয়েক গুণ বেশি ব্যাপক আকারে ঘটছে। বিশেষ করে আমরা যদি আগের বছরটির সঙ্গে ২০২১-এর তুলনা করি তাহলে দেখতে পাই জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবগুলো আগের তুলনায় বাড়ছে। এরই ধারাবাহিকতায় চলতি বছরে খাদ্য উৎপাদনে জলবায়ু পরিবর্তনগত প্রভাব আগের তুলনায় বৃদ্ধি পাবে বলেই অনুমেয়।

বিশেষ করে এশিয়া আফ্রিকার মতো উন্নয়নশীল অঞ্চলগুলোয় জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রভাব আঘাতের মাত্রা বেশি হবে। অবস্থায় জলবায়ু ঝুঁকি থেকে শুরু করে খাদ্য উৎপাদনের হুমকি বৈশ্বিক উষ্ণতা এবং এর পরিণতি মোকাবেলায় বৃহত্তর আন্তর্জাতিক সহযোগিতার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেয়। দুঃখজনকভাবে, সার্বিক পরিস্থিতি দেখে ধরনের সহযোগিতার বিষয়গুলো অনেকটা অসম্ভাব্যই মনে হয়। বিশেষ করে বিশ্বনেতাদের অবস্থান, নীতিনির্ধারণে অপারগতা বা -বিষয়ক মতানৈক্যে পৌঁছার অপারগতার কথা যদি বিবেচনা করি। তবে খাদ্যের মূল্যবৃদ্ধিতে সরাসরি অবদান রাখে এমন কয়েকটি কারণের মধ্যে রয়েছে নীতি নিয়ন্ত্রক পরিবর্তন। যেমন কভিড-১৯-এর ঊর্ধ্বগতি আবারো হয়তো খাদ্য সরবরাহকে চাপের মুখে ফেলতে পারে ধরনের ভয় থেকে সরকার ভোক্তা দ্বারা উল্লেখযোগ্য হারে মজুদ বৃদ্ধির মতো ঘটনা ঘটে। অতিরিক্ত চাহিদার কারণে ভবিষ্যতে খাদ্যমূল্য বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি তখন অনেকটাই প্রত্যাশিত ঘটনা হয়ে আসে। গত নভেম্বরে এফএও তাদের এক হিসাবে দেখিয়েছে ২০২১ সালে বিশ্বব্যাপী খাদ্য আমদানির ব্যয় ছিল সবচেয়ে বেশি। প্রায় দশমিক ৭৫ ট্রিলিয়ন ডলার; যা ২০২০ সালের চেয়ে ১৪ শতাংশ এবং এফএওর অনুমানের তুলনায় ১২ শতাংশ বেশি।

আমি মনে করি, নিম্ন আয়ের অর্থনীতির জন্য এটি একটি খারাপ খবর। কেননা অন্যান্য দেশের তুলনায় খাদ্য আমদানির ক্ষেত্রে তাদের চাহিদা যেমন বেশি হতে পারে, আবার চাহিদা বৃদ্ধির কারণেই তারা বৈশ্বিক বাজার থেকে ছিটকে যেতে পারে। আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হচ্ছে খাদ্যপণ্যের বাজার সম্পর্কিত আর্থিক অনুমান; যা সম্প্রতি পুনর্জাগরণের অভিজ্ঞতা লাভ করেছে। চলতি শতকের শূণ্য দশকের গোড়ার দিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আর্থিক নিয়ন্ত্রণহীনতার পর খাদ্যদ্রব্য রীতিমতো উচ্চসম্পদে পরিণত হয়। তাছাড়া গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য-প্রমাণও রয়েছে যে বিষয়টি ২০০৭-০৯ সাল পর্যন্ত খাদ্যপণ্যের মূল্যের অস্থিতিশীলতার নেপথ্যে প্রধান অনুঘটক হিসেবে কাজ করে। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় খাদ্যপণ্য বিনিয়োগকারীদের কাছে খানিকটা কম আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। তবে মহামারী শুরুর পর ধারণা বদলে যায়।

আমরা দেখি বড় ধরনের অস্থিরতা সত্ত্বেও ২০২১ সালজুড়ে প্রধান প্রধান খাদ্যপণ্যের বাজারগুলো ইতিবাচক ছিল। এর মানে আর্থিক বিনিয়োগকারীরা মূল্যবৃদ্ধির প্রত্যাশা করছেন। নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানের ক্রমাগত ত্রুটি এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সস্তা ঋণের কারণে গত বছর ধরনের বিনিয়োগের পরিমাণ উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে।

মধ্য মেয়াদে খাদ্য সরবরাহ দামকে প্রভাবিত করে এমন কিছু পদ্ধতিগত শক্তির বিপরীতে নীতিনির্ধারকরা সহজেই মজুদ এবং অনুমানের সমস্যার সমাধান করতে পারেন। তবে এজন্য সরকারের পক্ষ থেকে ওই সমস্যা মেনে নিয়ে তা চিহ্নিত সমাধান করতে উদ্যোগী হওয়া চাই। সরকারগুলো যতদিন না পর্যন্ত উদ্যোগ গ্রহণ করবে, খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি ততদিন পর্যন্ত বিশ্বের দরিদ্রগোষ্ঠীকে সবচেয়ে বেশি আঘাত করতে থাকবে। তাদের ভোগান্তি বাড়িয়ে চলবে।

[স্বত্ব:
প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
]

 

জয়তী ঘোষ: ভারতের জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক; ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট ইকোনমিকস অ্যাসোসিয়েটসের এক্সিকিউটিভ সেক্রেটারি ইনডিপেনডেন্ট কমিশন ফর দ্য রিফর্ম অব ইন্টারন্যাশনাল করপোরেট ট্যাক্সেশনের সদস্য

ভাষান্তর: রুহিনা ফেরদৌস

 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন