পাঠক মত

অপুষ্টি মোকাবেলায় প্রয়োজন পুষ্টিবিষয়ক সচেতনতা

 

গত এক দশকে আমাদের দেশের খাদ্য পুষ্টিনিরাপত্তার প্রচেষ্টা প্রশংসিত হয়েছে বিশ্বজুড়ে। যদিও কয়েক বছরে দেশে পুষ্টির অবস্থা তুলনামূলকভাবে খারাপ হয়েছে। গড় আয়ু বেড়েছে। শিশু মাতৃমৃত্যুর হার উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। কিন্তু কভিড-১৯ মহামারীর কারণে জনসাধারণের আয়ের সামগ্রিক প্রবাহ সংকুচিত হওয়ায় এটি বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে দেশের খাদ্যনিরাপত্তা পুষ্টির অবস্থার ওপর যথেষ্ট প্রভাব ফেলেছে।

আমরা জানি, অপুষ্টিতে ভুগছে এমন লোকদের উৎপাদনশীলতা কম, দৈহিক শক্তি ক্ষমতা তুলনামূলকভাবে কম। তাই অপুষ্টির চক্র থেকে বেরিয়ে আসতে পুষ্টি অবস্থার উন্নতির জন্য আরো বেশি বিনিয়োগ বিচক্ষণ উদ্যোগ আবশ্যক। ধরনের বিনিয়োগগুলো অপুষ্টি অবস্থা কাটিয়ে ওঠার পাশাপাশি জিডিপি প্রবৃদ্ধি বাড়াতে সাহায্য করবে। দরিদ্র মানুষ তাদের দৈনন্দিন আয় কমার কারণে এরই মধ্যে খাওয়ার খরচ কমিয়ে দিয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই তারা প্রাণিজ প্রোটিন কম গ্রহণ করছে। তাই দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য পুষ্টিকর খাবারের সহজলভ্যতা তাদের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ানো জরুরি। এখন থেকে সব উন্নয়ন কর্মসূচিতে খাদ্য পুষ্টিনিরাপত্তার বিষয়টিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করতে হবে। পুষ্টির অভাবসহ দারিদ্র্যের মধ্যে বসবাসকারী পরিবারগুলোকে খাদ্য পুষ্টিনিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় আনতে হবে, যাতে তাদের জন্য স্বাস্থ্যকর খাবারের ব্যবস্থা করা যায়। তুলনামূলকভাবে টেকসই সমাধানের জন্য আনুষ্ঠানিক অনানুষ্ঠানিক উভয় ক্ষেত্রেই কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করতে হবে। সংকটের সময় নিম্ন আয়ের গোষ্ঠীর আয়প্রবাহ ত্বরান্বিত করতে হবে, যাতে তারা তাদের খাদ্য পুষ্টির চাহিদা মেটাতে পারে। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে উপযুক্ত কার্যক্রম হাতে নিতে হবে। কারণ বাস্তব প্রত্যাশিত উন্নয়ন নির্ধারণের জন্য সুস্থ মানবসম্পদের বিকল্প নেই।

কৃষকদের  উৎপাদিত পণ্যের যুক্তিসংগত মূল্য নিশ্চিত করা জরুরি। কৃষকদের জন্য প্রয়োজনীয় সহযোগিতা সরবরাহ করতে হবে। আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতি সরবরাহ করার পাশাপাশি তাদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে। নজর দিতে হবে কৃষি বিপণন ব্যবস্থার দিকেও। একই সময়ে প্রণোদনা উদ্দীপনা প্যাকেজ প্রদান, ন্যায্যমূল্য, বাজারের নিশ্চয়তা, মধ্যস্বত্বভোগীদের হস্তক্ষেপ বন্ধ করার পাশাপাশি কৃষিঋণ যথাসময়ে বিতরণ করার বিষয়গুলো গুরুত্বপূর্ণ। দেশ এখন খাদ্য উৎপাদনে যথেষ্ট পরিমাণে সক্ষমতা অর্জন করেছে। এটা সত্যিকারের আশার বিষয়। কিন্তু বিপুল খাদ্য উৎপাদন সত্ত্বেও আমরা এখনো পুষ্টিনিরাপত্তায় পিছিয়ে আছি। কভিড-১৯ মহামারী দরিদ্র প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ওপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করেছে। অনানুষ্ঠানিক কর্মসংস্থানে নিযুক্ত ব্যক্তিদের মধ্যে ক্রমাগত ভীতি কাজ করছে যে তাদের জীবনযাত্রার মান আরো খারাপ হতে পারে, কারণ তাদের আয়প্রবাহ এরই মধ্যে সংকুচিত হয়ে গেছে।

বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির প্রতিবেদন আনুসারে, বর্তমানে দেশের অর্ধেক জনসংখ্যা তাদের দৈনন্দিন খাবারের জন্য সুষম খাদ্যের জোগান নিশ্চিত করতে অপারগ। পরিচালিত সমীক্ষায় দেখা গেছে যে বাংলাদেশে প্রতি ছয়জনের মধ্যে একজন অপুষ্টিতে ভুগছে এবং পাঁচ বছরের কম বয়সী ৩৫ শতাংশ শিশুর বৃদ্ধি বন্ধ হয়ে গেছে এবং ৩৩ শতাংশের ওজন কম। এটিও একটি গুরুতর উদ্বেগের বিষয় যে প্রতি তিনজন নারীর মধ্যে একজন (১০ থেকে ৪৯ বছরের মধ্যে) প্রয়োজনীয় পরিমাণে পুষ্টিকর খাবার পান না। দেশে এরই মধ্যে কয়েক বছর ধরে কম ওজনের শিশুজন্মের সংখ্যা ধারাবাহিকভাবে হ্রাস পেয়েছে। তবে সেই হার আবারো বাড়তে শুরু করেছে। আমরা জানি, একটি শিশু যখন কম ওজন নিয়ে জন্মায় তখন তার বৃদ্ধি স্থবির হয়ে পড়ে। যদি গর্ভবতী মা অপুষ্টি সহ্য করেন, তবে প্রত্যাশিত শিশুর ওজন কম হওয়ার ঝুঁকি থেকে যায়।

চলমান মহামারীতে নারী শিশুদের পুষ্টির অবনতি ঘটছে। তাছাড়া নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধিতে পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। তাই বিশেষ করে কিশোর-কিশোরী, শিশু নারীদের জন্য পুষ্টির অভাব মোকাবেলা করার একটি বাস্তবসম্মত উপায় হচ্ছে পুষ্টি পরিকল্পনা এবং -জাতীয় কর্মসূচি গ্রহণ। বিশ্ব অর্থনীতি যখন কভিড-১৯-এর কারণে বহুমুখী চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছে, তখন বাংলাদেশের গড় জিডিপির ইতিবাচক প্রবাহ আশার ইঙ্গিত দেয়।

আমরা জানি, অপুষ্টিতে ভুগছে এমন লোকদের উৎপাদনশীলতা কম। তারা তুলনামূলকভাবে কম দৈহিক শক্তি ক্ষমতাসম্পন্ন। অতএব, অপুষ্টি চক্র থেকে বের করে আনতে তাদের জন্য আরো বেশি বিনিয়োগ বিচক্ষণ উদ্যোগ অপরিহার্য। ধরনের বিনিয়োগ অপুষ্টি দূর করার পাশাপাশি জিডিপি প্রবৃদ্ধি বাড়াতে সাহায্য করবে। পরিবারে পর্যাপ্ত খাদ্য মজুদ থাকার অর্থ এই নয় যে সবকিছু ঠিক আছে। বরং পর্যাপ্ত পরিমাণে পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবারের যথাযথ বরাদ্দের পাশাপাশি সুষম খাদ্য নিয়মিতভাবে খাওয়া পরিবারগুলোর জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই সবার জন্য পুষ্টিকর খাদ্যের গুরুত্বকে কেন্দ্র করে সচেতনতা তৈরির প্রচারাভিযান সম্পন্ন করতে হবে। পরিশেষে, পুষ্টিনিরাপত্তা অর্জনের লক্ষ্যে আমাদের সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করতে হবে।

 

অভিরাজ নাথ গবেষক প্রাবন্ধিক

 

শিক্ষকতায় মেধাবীদের আকর্ষণে বাড়ানো চাই আর্থিক সুবিধা 

 

শিক্ষকতা’—শব্দটি শোনামাত্রই আমাদের মনে শ্রদ্ধা জেগে ওঠে। কিন্তু বাস্তবে আমাদের শিক্ষকদের কী অবস্থা। তারা কেমন আছেন?

আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে আলোচনাটা দাঁড় করাই। আমাদের দেশে শিক্ষকতা পেশায় আত্মনিয়োগ করে দেশ-জাতি সমাজসেবা করার তীব্র ইচ্ছা কেবল পরীক্ষার খাতায় আমার জীবনের লক্ষ্য রচনায় শোভা পায়। ছাত্রের সুনিপুণ লেখনী উচ্চ চিন্তাধারা শিক্ষক কর্তৃক ভালো নম্বর প্রাপ্ত হলেও শিক্ষকই তার সন্তানের ব্যাপারে জীবনের লক্ষ্য স্থির করায় নিজ পেশায় আহ্বান করবেন কিনা তা সন্দেহ। কেননা প্রত্যেক মা-বাবা চান তার সন্তান স্বাচ্ছন্দ্যে বাঁচুক।

বোধ করি, একজন ছাত্র শিক্ষকের সদাচার, স্নেহ, ভালোবাসায় ছাত্রের মধ্যে শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন সৃষ্টি করে। আর সেই বাসনা থেকেই হয়তো আমার জীবনের লক্ষ্য রচনায় শিক্ষক হওয়ার আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ পায়। ছাত্রটি যখন সমাজ বাস্তবতা বুঝতে শিখে তখনই তার জীবনের লক্ষ্য পরিবর্তন হয়ে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার কিংবা বিসিএস ক্যাডারে রূপান্তর হয়। কেননা পেশায় অর্থ সম্মান দুটিই আছে।

চাকরির যুদ্ধে মেধাবীরা ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হয়ে জীবনসংগ্রামে নিজেকে নিয়োজিত করেন। আর ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও ব্যর্থতার ফলে শিক্ষকতার পেশায় আসেন মন ভাঙা অপেক্ষাকৃত কম মেধাবীরা। যেন ভাগ্যদোষে  শিক্ষকতা পেশায় আগমন। তবে অপেক্ষাকৃত দুর্বল শিক্ষার্থীরা জীবিকা নির্বাহের তাগিদে শিক্ষকতা  পেশায় আসেন। তবে ব্যতিক্রমও আছে। এখন প্রশ্ন, অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও শিক্ষকতা পেশায় আসা অপেক্ষাকৃত কম মেধাবীদের দ্বারা যুগোপযোগী, গবেষণানির্ভর, মেধাসম্পন্ন ছাত্রসমাজ প্রত্যাশা করতে পারি? যে ছাত্রসমাজ বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলবে? তার উত্তর নিশ্চয়ই পাঠক ভালো করে অবগত।

আমরা যদি উন্নত বিশ্বের দিকে তাকাই। তবে দেখি, পশ্চিমা উন্নত দেশগুলো আমাদের তুলনায় শিক্ষকতা পেশাকে বহুগুণে সম্মানের চোখে দেখে। শুধু সম্মানের চোখে দেখে, এটা বললে ভুল হবে। কেননা সম্মানের সঙ্গে সঙ্গে তারা শিক্ষকদের প্রাপ্য সন্তোষজনক সম্মানী দেয়। তারা সম্মানজনক ১৪টি পেশার মাঝে সপ্তম স্থানে রেখেছে শিক্ষকতা পেশাকে। শিক্ষকদের সামাজিক সূচকে ১০০ পয়েন্টের মধ্যে সবচেয়ে এগিয়ে থাকা দেশ চীনের সূচক ১০০, দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে গ্রিস (সূচক ৭৩ দশমিক ), তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে তুরস্ক (সূচক ৬৮), খারাপ সূচকে সবচেয়ে এগিয়ে ইসরায়েল (সূচক ), দ্বিতীয় (ব্রাজিল দশমিক ), তৃতীয় চেক প্রজাতন্ত্র (১২ দশমিক )

আমাদের দেশে শিক্ষকদের অর্থ মর্যাদার অবস্থা প্রকাশিত বিভিন্ন প্রতিবেদন দেখলেই বুঝতে পারব। সম্প্রতি প্রকাশিত একটি দৈনিকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সরকারি প্রাথমিকের সহকারী শিক্ষকরা এখনো তৃতীয় শ্রেণীর কর্মচারী। তারা ১৩তম গ্রেডে ১১ হাজার টাকার স্কেলে বেতন পান সাকল্যে ১৯ হাজার টাকা। প্রতিবেশী ভারতে প্রাথমিকের পদমর্যাদার শিক্ষকদের বেতন বাংলাদেশী মুদ্রায় প্রায় ৩০ হাজার টাকা। আর এমপিওভুক্ত মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকরা শুরুতে ১১তম গ্রেডে ১২ হাজার ৫০০ টাকা মূল বেতনের সঙ্গে হাজার টাকা বাড়িভাড়া ৫০০ টাকা চিকিৎসা ভাতা পান।

এখন একটু সম্ভাবনাময় বাস্তবতার প্রসঙ্গে আসি, যদি আমাদের দেশে শিক্ষকতা পেশায় বেতন আশানুরূপ হতো, তাহলে পেশার আশানুরূপ মর্যাদা অর্থের পরিপ্রেক্ষিতে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার পাশাপাশি শিক্ষক হওয়ার ইচ্ছা প্রথম পছন্দ হিসেবে বিবেচিত হতো মেধাবী প্রজন্মের কাছে। অতএব, জাতি পেত মেধাবী শিক্ষক।  যখন মেধাবী শিক্ষক থাকত তখন নিশ্চয়ই জাতির যুগোপযোগী, গবেষণানির্ভর, মেধাসম্পন্ন ছাত্রসমাজ প্রত্যাশা করা সহজ ব্যাপার হতো। আর তৈরি হতো মেধাবী ছাত্রসমাজ। এই মেধাবী শিক্ষার্থীরা তাদের মেধাকে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশকে উন্নত দেশের সারিতে পৌঁছাতে সহযোগিতা করতে সমর্থ হতো।

এখন সরকারের উচিত শিক্ষকদের বেতন বৃদ্ধি করা এবং তাদের সুযোগ-সুবিধা দেয়া। যখন শিক্ষকতা পেশায় আশানুরূপ বেতন পাওয়া যাবে, সেই সঙ্গে শিক্ষকদের কোচিং বা প্রাইভেট বাণিজ্য বন্ধ হবে তখন নিশ্চয়ই ক্লাসে শিক্ষকের সক্রিয়তা বাড়বে। তবে শিক্ষার্থীদের প্রাইভেট বা কোচিং একান্তভাবে দরকার হলে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া বেকার শিক্ষার্থীরা তাদের পড়াবেন। কিন্তু সরকারিভাবে নিশ্চিত করতে হবে যেন কোনো শিক্ষার্থীর প্রাইভেট পড়া না লাগে, যেন ক্লাসের পড়া ক্লাসেই শেষ হয়। একদিকে  বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া বেকার শিক্ষার্থীরা তাদের পড়াশোনার খরচ হাতখরচ অনায়াসে বহন করতে পারছেন, অন্যদিকে বেতন বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষকসমাজ স্বচ্ছন্দে বসবাস করতে পারছে। একটা বাস্তব বিষয় খেয়াল করি, পাঠকের কাছে প্রশ্ন, স্কুল-কলেজে শিক্ষার্থীদের আলাদা জায়গায় প্রাইভেট পড়তে হয় কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের কোনো প্রাইভেট পড়তে হয় না কেন? উত্তরটা হলো, বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, স্কুল-কলেজের শিক্ষকদের চেয়ে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা ক্লাসের ব্যাপারে বেশি সক্রিয়। ক্লাসের পড়া ক্লাসেই শেষ হয়ে যায়। তখন প্রাইভেট পড়াও অবশ্যই অনর্থক।

আমরা চাই একজন আদর্শ শিক্ষক। প্রতিটি শিক্ষার্থী সেই আদর্শ শিক্ষকের স্পর্শে আলোকিত হবে।

 

শেখ সায়মন পারভেজ শিক্ষার্থী, ফার্মেসি বিভাগ

মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন