শহরাঞ্চলের ৬০ শতাংশ ভবন নির্মাণে নিয়মের ব্যত্যয়

ইমারত বিধিমালা পরিপালনে নজরদারি বাড়াক কর্তৃপক্ষ

একটি পরিকল্পিত শহর গড়ার অন্যতম পূর্বশর্ত নিয়ম অনুযায়ী ভবন নির্মাণ নিশ্চিত করা। কিন্তু দেশের শহরগুলোয় বিরাজ করছে এর উল্টো চিত্র। কোথাও অনুমোদিত নকশার চেয়ে বেশি উচ্চতার ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে, কোথাও একশ্রেণীর ভবনের অনুমোদন নিয়ে নির্মাণ করা হচ্ছে আরেক শ্রেণীর ভবন। আবার কোথাও ভবনের নকশায় চারপাশে যতটা ফাঁকা জায়গার উল্লেখ করা হচ্ছে, বাস্তবে তা থাকছে না। বণিক বার্তায় প্রকাশিত সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, দেশের শহরাঞ্চলের নির্মাণ করা নির্মাণাধীন ৬৬ শতাংশ ভবনই তৈরি হচ্ছে বা হয়েছে নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়ে। এতে একদিকে দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়ছে, অন্যদিকে শহরগুলোরও বিস্তার ঘটছে অপরিকল্পিতভাবে। কাজেই নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়ে এরই মধ্যে নির্মাণ হওয়া ভবনগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন। একই সঙ্গে ভবিষ্যতে ধরনের অনিয়ম রোধে দরকার নজরদারি বাড়ানো। বিষয়টি আমলে নিয়ে নগর কর্তৃপক্ষগুলোর সচেষ্টতাই কাম্য।

কাজের সুবাদে গত দুই দশকে দেশে শহরমুখী মানুষের অভিগমন বেড়েছে লক্ষণীয় মাত্রায়। জনসংখ্যার সমান্তরালে শহরগুলোয় বাড়ছে ভবন নির্মাণও। দেশে প্রচলিত ইমারত আইনে সয়েল টেস্ট করানো, নকশা অনুমোদন, ভবনের ভিত্তি কেমন হবে, কোন শ্রেণীর ভবন শহরের কোন এলাকায় নির্মাণ করতে হবে, কোনো ভবন নির্মাণে নির্দিষ্ট পরিমাণ খোলা জায়গাসহ পার্কিং প্লেস রাখা প্রভৃতি বিষয়ে সুস্পষ্ট বিধান রয়েছে। অথচ একাংশের ক্ষেত্রে মানা হলেও শহরাঞ্চলের একটা উল্লেখযোগ্যসংখ্যক ভবনের ক্ষেত্রে এসব নিয়ম মানা হচ্ছে না। দেখা যাচ্ছে, অনেক ক্ষেত্রে অনুমোদিত উচ্চতার বেশি উঁচু ভবন তৈরি করা হচ্ছে। কোথাও নকশার বাইরে গিয়ে ভবনের সম্প্রসারণ করা হচ্ছে। কোথাও ভবন ব্যবহারেও নিয়মের ব্যত্যয় ঘটছে। আবাসিক ভবনের অনুমোদন নিয়ে তৈরি করা হচ্ছে বাণিজ্যিক ভবন। অনেক ভবনের চারপাশে রাখা হচ্ছে না প্রয়োজনীয় পরিসর।  নিশ্চিত করা হচ্ছে না যথাযথ অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা। সব মিলিয়ে ক্রমেই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে দেশের শহরাঞ্চলের ভবনগুলো।

সব দেশেই শহরের পরিকল্পিত বিকাশে সক্রিয় ভূমিকা রাখছে নগর কর্তৃপক্ষগুলো। জোনিং করে শহরের প্রতিটি অঞ্চলকে সুবিন্যস্ত করে সাজাচ্ছে তারা। কোন এলাকায় কোন ধরনের ভবন নির্মাণ করতে হবে, নকশা অনুযায়ী ভবন নির্মাণ হচ্ছে কিনা, কোথাও নিয়মের লঙ্ঘন ঘটছে কিনা তা নিয়মিত তদারক করা হচ্ছে। কোথাও অনিয়ম পেলে নেয়া হচ্ছে কঠোর ব্যবস্থা। উন্নত দেশের শহরগুলোর কথা দূরে থাক, প্রতিবেশী ভারতের কলকাতা দিল্লি এক্ষেত্রে বিশেষভাবে উল্লেখ করার মতো। একসময়ের খুবই ঘিঞ্জি, অপরিচ্ছন্ন, বেহাল ভবন বিন্যাসের শহর দুটি পরিকল্পিত উদ্যোগে আগের দুরবস্থা অনেকটা কাটিয়ে উঠেছে। এটা সম্ভব হয়েছে নগর কর্তৃপক্ষের আন্তরিক প্রচেষ্টা, নজরদারি আইন প্রয়োগে কঠোরতার কারণে। তাদের অভিজ্ঞতা কর্মপ্রক্রিয়া আমাদের জন্য শিক্ষণীয়।

আমরা দেখছি দেশে বিল্ডিং কোডসহ বিভিন্ন নিয়মকানুন কেবল কাগজ-কলমেই আছে, আসলে তার বাস্তবায়ন নেই। আইনকানুন থাকা সত্ত্বেও নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়ে শহরাঞ্চলে নির্মাণ করা হচ্ছে অবৈধ ভবন। এক্ষেত্রে একশ্রেণীর ভবন মালিকই দায়ী। তারা নিজেদের হীন স্বার্থে আইন ভঙ্গ করছেন। পরিণতিতে তৈরি করছেন অপরিকল্পিত অস্থায়িত্বশীল শহর। নগর কর্তৃপক্ষগুলো কিছুদিন পরপর রুটিন অভিযান চালালেও নিচ্ছে না কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা। ফলে একই অনিয়মের বারবারই পুনরাবৃত্তি ঘটছে, যা মোটেই কাম্য নয়।

ভবনধস অগ্নিদুর্ঘটনার মতো অঘটন ঢাকা বা চট্টগ্রাম শহরে অনেকটা সীমাবদ্ধ ছিল। এখন ঢাকা-চট্টগ্রামের বাইরে অন্য শহরগুলোয়ও ঘটছে। এর পেছনেও বড় কারণ ইমারত বিধি যথাযথভাবে অনুসরণ না করা। ভবন নির্মাণে বিল্ডিং কোড মানার ব্যাপারে নানা রকম সতর্কতামূলক নির্দেশনা সংশ্লিষ্ট মহল থেকে দেয়া হলেও তা অনেক ক্ষেত্রে উপেক্ষা করা হচ্ছে। ফলে ঘটছে দুর্ঘটনা। শুধু ভবন মালিক নয়, এক্ষেত্রে নগর কর্তৃপক্ষের কিছু অসাধু কর্মকর্তার দায়ও আছে। অভিযোগ রয়েছে কিছু কর্মকর্তা অর্থের বিনিময়ে অপরিকল্পিত নকশা অনুমোদন দিচ্ছেন। আর এর ওপর ভিত্তি করে বিল্ডিং কোড না মেনে একের পর এক ভবন গড়ে তুলছেন মালিকরা। এতে বাড়ছে নিরাপত্তা ঝুঁকি। কাজেই দুর্ঘটনার দায় কর্তৃপক্ষও এড়াতে পারে না।

অর্থনৈতিক রূপান্তরের স্বাভাবিক ধারায় দেশে যত নগরায়ণের প্রসার ঘটছে তত আমাদের শহরগুলোও ক্রমেই বাসযোগ্যতা হারাচ্ছে। শহরের বাসযোগ্যতার সূচকে আমরা এখন তলানিতে। এর পেছনে অনেক কারণ দায়ী। তার মধ্যে অনুমোদনহীন অবৈধ ভবন নির্মাণও একটা বড় কারণ। দেশে সুস্পষ্ট ইমারত বিধি পাশাপাশি সব শহরে নগর কর্তৃপক্ষ থাকা সত্ত্বেও যেখানে-সেখানে গড়ে উঠছে অপরিকল্পিত ভবন। প্রবণতা বন্ধ না করলে টেকসই নগরায়ণ নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। এজন্য মালিকদের প্রচলিত বিধিবিধান অনুসরণ এবং সর্বোচ্চ সচেতনতা যেমন অবলম্বন করতে হবে, তেমনি কর্তৃপক্ষেরও আরো কঠোর হতে হবে। পুনঃপুন নির্দেশনা সত্ত্বেও যারা ইমারত বিধি মানছেন না, তাদের চিহ্নিত করে শাস্তি দিতে হবে। রাজনৈতিক বিবেচনার ঊর্ধ্বে উঠে শহরের স্থায়িত্বের স্বার্থে অবৈধ স্থাপনা অপসারণ উচ্ছেদ করতে হবে। অপরিকল্পিত নকশা অনুমোদনে যুক্ত কর্মকর্তাদের চিহ্নিতপূর্বক তাদের বিরুদ্ধে নিতে হবে শক্ত বিভাগীয় ব্যবস্থা। অন্য দেশগুলোর অভিজ্ঞতার আলোকে ভবন নির্মাণের প্রতিটি ধাপে নিশ্চিত করতে হবে উত্তম প্রকৌশলগত চর্চা। ভবন মালিক, নগর কর্তৃপক্ষ সরকারের সম্মিলিত প্রয়াসে দেশের শহরগুলোয় ভবন নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে, এটিই প্রত্যাশা।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন