অভিমত

করোনার নতুন বাস্তবতায় খাপ খাইয়ে নেয়ার সংকট

তানভীর শাতিল

করোনাভাইরাসের নতুন ধরনের সঙ্গে নতুন বছরের (২০২২) শুরুটা কী বার্তা দেয় তা হয়তো কিছুটা অনুমান করা যায় বিগত দুই বছরের অভিজ্ঞতার প্রেক্ষাপট থেকে। গত দুই বছরে করোনা মহামারীর ধাক্কা কতটা প্রকট তার নানা তথ্য-উপাত্ত সহজলভ্য। অর্থনৈতিক খাতে এর ধাক্কা পরিবহন শ্রমিক থেকে শুরু করে রাস্তার ধারের জুতা সেলাইকারী মুচি, শিল্প শ্রমিক, শিল্পপতি সবাই যার যার জায়গা থেকে অনুধাবন করেছেন। দেশের শ্রমজীবী মানুষ থেকে শুরু করে ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তথা গোটা রাষ্ট্র থমকে গিয়েছিল, যার প্রভাব এখনো কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি। দারিদ্র্যের হার লকডাউনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়ে উঠেছে। মানুষের শারীরিক ভোগান্তির সঙ্গে সঙ্গে মানসিক, পারিবারিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক হতাশা আর অস্থিরতা বেড়েছে। মানুষ নানা কায়দাকানুন করে অবস্থার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে চেয়েছে; কিছুটা পেরেছে, কিছুটা পারেনি। ফলে মানুষের জীবনে একটা নতুন বাস্তবতা এসে হাজির হয়েছে। এ বাস্তবতাকে ‘নিউ নরমাল’ বললে মূর্ততা পায় আমাদের সামজিক ভাষা কাঠামোয়। সামনের দিনগুলোয় এ বাস্তবতা মানিয়ে নিয়েই বিশ্বকে সামনের দিকে এগোতে হবে তা মোটামুটি প্রমাণিত হয়েছে গত দুই বছরের মহামারী অভিজ্ঞতায়। ২০২০-এর মার্চ থেকে শুরু করে ২০২২-এর জানুয়ারি পর্যন্ত করোনা ঢেউয়ের উত্থান-পতন, ভাইরাসের নতুন ধরন আর আক্রান্তের ধরনের গতি-প্রকৃতি বারবার মনে করিয়ে দেয় নিউ নরমাল বাস্তবতাকে মানিয়ে নেয়ার প্রয়োজনীয়তা। আর এ করোনাভাইরাস মোকাবেলায় যে ধরনের অভ্যাসগত জায়গায় পরিবর্তনের জরুরত দেখা দেয় তা শুনতে যতটা সহজ মনে হয়, প্রাত্যহিক (অতি সাধারণ ব্যক্তিক তথা সামাজিক) বাস্তবতায় তা ততটা কঠিন। করোনা প্রতিরোধে যে স্বাস্থ্য বিধিমালা, সেগুলোর অধিকাংশই ব্যক্তিক পর্যায়ে অভ্যাস পরিবর্তনের সঙ্গে সম্পৃক্ত। অর্থাত্, করোনা মোকাবেলা করতে হলে, এই করোনা মহামারীর গর্ভ থেকে জন্ম নেয়া নিউ নরমাল বাস্তবতার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে হলে ব্যক্তিক পর্যায়ে মানুষের অভ্যাস পরিবর্তন হতে হবে। এ নতুন বাস্তবতায় যেহেতু আমরা জানি না কখন কোন ঢেউয়ে আক্রান্ত হতে যাচ্ছি—ডেল্টা না ওমিক্রন! তাই এই নতুন বাস্তবতায় সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক সব পরিসরে ধাক্কা সামলিয়ে ওঠার জন্য এখনই এ বিষয়ে গুরুত্ব সহকারে ভাবা দরকার। উদাহরণ হিসেবে বর্তমান ওমিক্রন জোয়ারের প্রেক্ষাপট বিবেচনা করলে দেখা যায়, ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট যখন নতুন ঢেউ হিসেবে হানা দেয় (সাধারণ মানুষের মাঝে অস্পষ্টতা ছিল এটা প্রথম ধাক্কা শেষ হয়ে দ্বিতীয় এল কিনা), তখন এটাকে দ্বিতীয় ঢেউ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এই দ্বিতীয় ঢেউ ধীরে ধীরে স্তিমিত হয়ে আসে ২০২১-এর শেষ দিকে, আক্রান্তের হার ১-২ শতাংশের কোটায় নেমে আসে আর জনজীবনে অর্থনৈতিক ও সামাজিক কার্যক্রমগুলো অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে আসতে থাকে। কিন্তু ২০২২-এর একদম শুরু থেকেই আক্রান্তের হার ক্রমেই বাড়তে থাকে। প্রথম ১০ দিনের মধ্যে প্রায় ৮-৯ শতাংশের কোটায় পৌঁছে। আর এ আক্রান্তের হার দ্রুত বেড়ে যাওয়ার পেছনে ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টটি কতটা কাজ করছে, সে বিষয়েও সঠিক তথ্য-উপাত্ত পাওয়ার অবকাঠামো এখনো আমাদের স্বাস্থ্য খাত অর্জন করতে পারেনি। তাছাড়া যদিও ব্যক্তিক পর্যায়ে মানুষের কভিড টেস্ট করানোর প্রবণতা লক্ষ করা যায়, তবে তা অত্যন্ত কম। অবশ্য টেস্ট করানো-বিষয়ক উদাসীনতার পেছনে সামাজিক ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা কাঠামো উভয়েই ভূমিকা রাখে।

সামগ্রিক করোনার স্বাস্থ্যবিধি মানার ব্যাপারে মানুষের উদাসীনতা যেমন রয়েছে, আবার কিছু জায়গায় মানুষের সচেতনতাও বৃদ্ধি পাচ্ছে ধীরে ধীরে। তবে সচেতনতা বৃদ্ধির গতি আর করোনা বৃদ্ধির গতিতে অনেক ব্যবধান। করোনা যে হারে বিস্তার হয়, সে হারে মানুষের সচেতনতা বাড়ে না; অভ্যাসও গড়ে ওঠে না। এর পেছনে মানুষের নানা ব্যক্তিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ভোগান্তি কাজ করে। করোনার স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি ও অভ্যস্তকরণে সরকারি-বেসরকারি নানা উদ্যোগ চোখে পড়ে। তবে এসব উদ্যোগের স্থায়িত্ব মানুষের মধ্যে পুরনো একটা অভ্যাস ভেঙে নতুন অভ্যাসের জায়গায় আসার সময়াবধি স্থায়ী থাকে না কিংবা যে নিবিড়তার সঙ্গে থাকা প্রয়োজন তা থাকে না। এ কার্যক্রমগুলোর নিবিড়তা ও ব্যাপ্তি করোনা বিস্তার হারের সঙ্গে যেন ওঠানামা করে। মূলত সরকার স্থানীয় সরকার ও অন্যান্য সংস্থার মাধ্যমে যে পদ্ধতিতে মানুষকে সচেতন করার চেষ্টা করে, তার ধারাবাহিকতা ও প্রকটতা সমতালে থাকে না। তবে একটা জিনিস লক্ষ করা যায়, জরুরি সময়ে প্রশাসনের চাপ প্রয়োগ ফলপ্রসূ হয়। পুলিশের ভয়ে সবাই অন্তত স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার চেষ্টা করে। কিন্তু এ চেষ্টাটা মানুষের ভেতর থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে না এলে এই নতুন অভ্যাস মানুষের ভেতর কতটা গড়ে উঠবে তা নিয়ে অনিশ্চয়তা থেকেই যায়। এখন প্রশ্ন হলো, করোনা সংক্রমণের মতো একটা বিষয় প্রশাসনিক বলপ্রয়োগের মাধ্যমে কতটা সময় নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব, যদি না ব্যক্তিক পর্যায়ে এ বিষয়ে সচেতনতা তৈরি হয় এবং সেই মতে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার অভ্যাস তৈরি হয়! এ অভ্যাস তৈরির প্রেক্ষাপট থেকে সাম্প্রতিক সময়ে ব্র্যাকের করোনা মোকাবেলায় সামাজিক দুর্গ (কমিউনিটি ফোর্ট ফর রেজিস্টিং কভিড-১৯ ইন বাংলাদেশ সংক্ষেপে সিএফআরসি) উদ্যোগটি তৃণমূলে কীভাবে কাজ করছে সে বিষয়ে একটা গবেষণা কাজে সম্পৃক্ত থাকার প্রেক্ষাপটে আলোচনা দাঁড় করাতে চাই।

বিশেষ করে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট বিস্তার নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে ব্র্যাক ভারতের সীমান্তবর্তী অঞ্চলসহ অধিক ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলগুলোয় তাদের এই সামাজিক দুর্গ উদ্যোগ শুরু করে। এ উদ্যোগের মাধ্যমে মূলত সমাজের নানা স্তরের মানুষকে সম্পৃক্ত করে স্থানীয় মানুষকে সচেতন এবং করোনার স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার অভ্যাস তৈরি করার প্রচেষ্টা চালানো হয়। এ উদ্যোগের মাধ্যমে স্থানীয় জনগণকে সম্পৃক্ত করার যে প্রক্রিয়া, তাতে দেখা যায় সমাজের মানুষকে সঙ্গে নিয়ে সমন্বিত একটা উদ্যোগের মাধ্যমে সামাজিকভাবে করোনার বিরুদ্ধে একটা দুর্গ গড়ে তোলার প্রচেষ্টা। বিনামূল্যে মানসম্মত মাস্ক বিতরণ, প্রয়োজনীয় তথ্য সরবরাহ, ব্যক্তিক ও সামাজিক পর্যায়ে মাস্ক পরিধানের ওপর জোরারোপ করা, স্থানীয় পর্যায়ের ব্র্যাকের মাঠকর্মীদের পাশাপাশি সামাজিক ও ধর্মীয় নেতাদের মাধ্যমে মাস্ক পরিধানসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করা এ কার্যক্রমের মূল অনুষঙ্গ। এছাড়া খানা পর্যায়ে সম্ভাব্য করোনা রোগী শনাক্তকরণ, তাদের হোমকোয়ারেন্টিনে থাকতে উত্সাহিত করা কিংবা টেলিমেডিসিন সেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে যোগাযোগ স্থাপন করে দেয়াসহ বিনামূল্যে মানসম্মত মাস্ক বিতরণ ও করোনার স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে স্বাস্থ্যসেবিকা ও স্বাস্থ্যকর্মীদের কাজে লাগানো হচ্ছে এ সামাজিক দুর্গ তৈরিতে। এই সামাজিক দুর্গ কার্যক্রমটি করোনা মোকাবেলায় সামগ্রকিভাবে মানুষের সচেতনতা বৃদ্ধি ও স্বাস্থ্যবিধি চর্চার অভ্যাস গড়ে তোলার লক্ষ্যে কাজ করছে।

কিন্তু করোনা মোকাবেলায় যে স্বাস্থ্যবিধিগুলো মেনে চলার ওপর জোর দেয়া হয়, তার সব অভ্যাস নিশ্চিতকরণে ব্যক্তিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক নানা প্রেক্ষাপট ও বাস্তবতার সঙ্গে সম্পূরক। সঠিকভাবে মাস্ক পরিধান করোনার বিস্তার রোধ করতে পারে—বিষয়টি সবারই জানা, কিন্তু এই সঠিকভাবে মাস্ক পরিধান গত দুই বছরে ব্যাপক হারে মানুষের অভ্যাসে পরিণত হয়নি। সামাজিক পরিসরে মাস্ক পরিধান নিশ্চিত করার বিষয়টিকে কেন্দ্রে রেখে যদি আমাদের সাম্প্রতিক মাঠ পর্যবেক্ষণ, অভিজ্ঞতা ও সাধারণ মানুষের দেয়া তথ্যের আলোকে দেখি, তবে দেখা যায় মানুষ মাস্ক পরিধানের বিষয়টিকে করোনা সংক্রমণের হার, মৃত্যুহার ও তাদের স্থানীয় পর্যায়ে এর প্রকোপের মাত্রার সঙ্গে মিলিয়ে গুরুত্ব দেয়। অর্থাত্, করোনা পরিস্থিতি খারাপের দিকে বাড়লে এর স্বাস্থ্যবিধি মানার প্রবণতা মানুষের মাঝে বৃদ্ধি পায়। এখানে অবশ্য করোনা পরিস্থিতি খারাপ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সরকারের পক্ষ থেকে প্রশাসনিক তত্পরতাও বাড়ানো হয়। কিন্তু গত দুই বছরে মানুষের দৈনন্দিন অভিজ্ঞতায় করোনা এমন বাস্তবতায় এসে পৌঁছেছে, মানুষ যেকোনো উপায়ে তাদের আর্থসামাজিক স্বাভাবিকতা বজায় রাখতে চায়, কিন্তু নতুন বাস্তবতার অভ্যাসগুলোর প্রতি উদাসীন থেকে যায়। বর্তমান সময়ে ওমিক্রন ঢেউয়েও রাস্তাঘাটে মানুষের সঠিকভাবে মাস্ক পরিধান করা ও অন্যান্য স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার হালচাল হতাশাজনক। এ থেকে সহজে অনুমেয় গত দুই বছরে করোনা স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা, বিশেষত জনসমাগম এলাকায় মাস্ক পরিধানের মতো অতিগুরুত্বপূর্ণ অভ্যাসকে বিস্তৃত করতে সামাজিক পর্যায়ে সচেতনতা কার্যক্রম যে ব্যাপকতা, স্থায়িত্ব ও সৃজনশীলতার সঙ্গে পরিচালনা করা দরকার, সে পর্যায়ে এখনো পৌঁছানো যায়নি। তবে এর মধ্যেও কিছু আশাজাগানিয়া দিক লক্ষ করা যায়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো প্রায় দুই বছর বন্ধ থাকার পর ২০২১ সালে যখন পুনরায় তাদের কার্যক্রম শুরু করে, প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে মাস্ক পরিধানকে বাধ্যতামূলক করায় স্কুল-কলেজ প্রাঙ্গণে ছাত্রছাত্রীদের মাঝে মাস্ক পরিধান চোখে পড়ার মতো ছিল। আবার একইভাবে বিভিন্ন কলকারখানায় যেখানে কর্তৃপক্ষ মাস্ক বাধ্যতামূলক করেছে কিংবা যে প্রতিষ্ঠান ‘নো মাস্ক, নো সার্ভিস’ কঠোরভাবে মেনে চলার পদক্ষেপ নিয়েছে, সেখানেও মাস্ক পরিধান করার প্রবণতা বেশি দেখা গেছে মানুষের মাঝে। একই সঙ্গে ব্র্যাকের মতো সামাজিক উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানগুলোর তত্পরতাও অনেকাংশেই মানুষকে উত্সাহিত করছে মাস্ক পরিধান করার ক্ষেত্রে। তবে এসব তত্পরতার প্রয়োজনীয় স্থায়িত্ব অধিকাংশেই দেখা যায় না। এই করোনাকালে আরেকটি বিষয় পর্যবেক্ষণ করা গেছে—সামাজিক পর্যায়ে অনেক সচেতন মানুষ ও রাজনৈতিক নেতাও সাধারণ মানুষকে মাস্ক পরিধানে সচেতন করতে এগিয়ে এসেছেন; বিভিন্ন সামাজিক, রাজনৈতিক অনুষ্ঠানে মানুষের মাঝে বিনামূল্যে মাস্ক বিতরণ করেছেন। তবে এক্ষেত্রেও করোনা প্রকোপের তালের সঙ্গে সামাজিক, রাজনৈতিক উদ্যোগও ওঠানামা করে।

তাছাড়া মাস্ক পরিধানের অভ্যাস ব্যক্তিক পর্যায়ে কত বিবিধ বিষয়ের সঙ্গে সম্পর্কিত হতে পারে তার একটা উদাহরণ দিলে পরিষ্কার হয়। চাঁপাইনবাবগঞ্জের একজন শ্রমিকের সঙ্গে আলাপ করে জানতে পারি, তিনি কাজের সন্ধানে চট্টগ্রাম গিয়েছিলেন ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট বিস্তারের আগে। তিনি চট্টগ্রামে যখন কাজ করতেন তখন কাজে যাওয়ার সময় নিয়মিত মাস্ক পরতেন এবং মাস্ক পরা তার কাছে স্বাভাবিক একটা বিষয় মনে হতো, কেননা তার চারপাশে সবাই মাস্ক পরতেন। কিন্তু যখন ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের বিস্তার শুরু হয়, বিশেষত লকডাউন আরোপিত হয়, তার আগে আগে তিনি চট্টগ্রাম থেকে নিজের গ্রামে ফিরে আসেন। এলাকায় এসে তার গ্রামের মানুষের বেশির ভাগের কাছে মাস্ক দেখতে পান না, তিনিও সবার দেখাদেখি মাস্ক পরা ছেড়ে দেন। কিন্তু কয়েক দিন যেতে না যেতেই গ্রাম পর্যায়ে প্রশাসনের তত্পরতা বৃদ্ধি পায়, গ্রামের বাজারগুলোয় মাস্ক না পরার কারণে ভ্রাম্যমাণ আদালত জরিমানা করতে থাকেন। ফলে বাজারঘাট, মসজিদসহ সব জনসমাগম স্থানে মানুষ মাস্ক পরা শুরু করলে তিনিও আবার মাস্ক পরা শুরু করেন। এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আশেপাশের সবাই মাস্ক পরলে আমিও মাস্ক পরি। একা একা মাস্ক পরলে কেমন বোকা বোকা লাগে।’ অন্যদিকে ব্যক্তিক পর্যায়ে শারীরিক অস্বস্তি, অর্থনৈতিক অসচ্ছলতাসহ নানা বিষয় এ মাস্ক ব্যবহারের সঙ্গে সংযুক্ত। ফলে এটা বলা যায়, করোনার নতুন বাস্তবতায় মাস্ক ব্যবহার প্রাত্যহিক জীবনাচরণে অবিচ্ছেদ্য একটা অভ্যাস হিসেবে এখনো তৈরি হতে পারেনি। এমন বাস্তবতায় ২০২২ সালের শুরুতে ওমিক্রন ঢেউয়ের ধাক্কায় সরকার যখন আবার বিধিনিষেধ আরোপের দিকে অগ্রসর হয় তখন পুরনো শঙ্কা—জীবন না জীবিকা আবার সামনে এসে দাঁড়ায়। বিশেষ করে ২০২১ সালের শেষের দিকে সারা দেশ যখন করোনার আর্থসামাজিক, সাংস্কৃতিক ধাক্কা সামলে উঠতে শুরু করেছে তখন ওমিক্রন ঝড় এক শঙ্কার বার্তা দিয়ে যায়। সরকার ওমিক্রন ঠেকানোর লক্ষ্যে যে ১১ দফা জনস্বাস্থ্যবিষয়ক সতর্কতা জারি করেছে, তার বেশির ভাগ জায়গায় মাস্কের প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্বারোপ করেছে। পাশাপাশি সরকারের এ বিধিনিষেধ আরোপের প্রকৃতি বিশ্লেষণে গেলে বোঝা যায় বর্তমান পরিস্থিতিতে মানুষের অর্থনৈতিক কার্যক্রমে বিঘ্ন ঘটিয়ে করোনা মোকাবেলা করা দুঃসাধ্য। তাই লকডাউনের মতো কঠোরতায় না গিয়ে মানুষকে স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণে বাধ্য ও উদ্বুদ্ধ করাই বড় কাজ। এমন বাস্তবতায় সমাজে আমরা যারা সাধারণ জনগণ, তাদের ওপরও দায়িত্ব বর্তায়। ব্যাপক হারে সাধারণ জনগণ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে উদ্বুদ্ধ হলেই জীবন-জীবিকার যে টানাপড়েন তা সামলে দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক কার্যক্রম যথাসম্ভব সচল রাখা সম্ভব হবে। তবে এখানেও আগের মতো ব্যক্তিক পর্যায়ে অভ্যাস তৈরির পেছনে বিবিধ সমস্যা অচলায়তন হয়ে রয়ে যায়। তাই সামাজিক পর্যায়ে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য স্থানিক বাস্তবতাকে আমলে নিয়ে স্থানীয় জনসাধারণ, প্রতিষ্ঠান, নেতা-নেত্রী, সুশীল সবার সম্পৃক্ততার ভিত্তিতে সামাজিক তত্পরতা জরুরি। এক্ষেত্রে ব্র্যাকের করোনা মোকাবেলায় হাতে নেয়া সামাজিক দুর্গের ন্যায় কার্যক্রমগুলোর পরিধি ও নিবিড়তা বৃদ্ধি করারও প্রয়োজন আছে বলে আমার মনে হয়।

পাশাপাশি সমাজে এ ধরনের কার্যক্রম পরিচালনা থেকে দেখা যায়, সবার মাস্ক নিশ্চিত করার জন্য স্থানীয় কিছু বিষয়কে গুরুত্ব দেয়ার সুযোগ রয়েছে, বাস্তবতার নিরিখে কিছু জায়গা/বিষয়কে চিহ্নিত করা যেতে পারে, যেগুলোকে কাজে লাগিয়ে মাস্ক ব্যবহারে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করা যেতে পারে। এ বিষয়ে ২০২১ সালে ঈদুল আজহার আগে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে কোরবানির পশুর হাটে ‘মাস্ক আমার-সুরক্ষা সবার’ শিরোনামে পরিচালিত বিনামূল্যে মাস্ক বিতরণ ও সচেতনতা বৃদ্ধির প্রচারণায় বিআইজিডির গবেষণা সহযোগী হিসেবে কাজ করা এবং আমাদের মাঠ পর্যবেক্ষণের প্রেক্ষাপট থেকে তখনকার পশুর হাটের অনুধাবনগুলো আবার প্রাসঙ্গিকতা পায়, বিশেষ করে ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলার মতো বিশাল গণজমায়েতে মাস্ক পরিধান নিশ্চিতকরণ প্রসঙ্গে। পশুর হাটে আমরা দেখতে পাই শক্তি ফাউন্ডেশনের ভলান্টিয়ারদের সার্বক্ষণিক তত্পরতা ও মাস্ক বিতরণ এ জনবহুল স্থানেও মানুষের মুখে মাস্ক তুলে দিতে ভূমিকা রেখেছিল। আর সঠিকভাবে মাস্ক পরিধান করতে হাট কমিটির উত্সাহ ও তত্পরতা, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তত্পরতা ও বিক্রেতাদের সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে মাস্ক ব্যবহারে মানুষের সাড়া লক্ষ করা গিয়েছিল। সেখানে যে বিষয়টা বিশেষভাবে চোখে পড়ে তা হলো, পশুর হাটের ব্যবস্থাপনায় কর্তৃপক্ষ যদি মাস্ক বাধ্যতামূলক করে এবং সেই মতে ভলান্টিয়ার ও অন্যান্য অনুষঙ্গ ঠিকঠাক কাজ করে, তবে এমন গণজমায়েতেও মাস্ক পরা অনেকাংশেই নিশ্চিত করা সম্ভব হয়। সেই কোরবানির পশুর হাটের অভিজ্ঞতা থেকে বর্তমান সময়ে ওমিক্রন জোয়ারের সময়ে ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলার বিষয়টি যদি বিবেচনা করি, তবে দেখতে পাই এ বাণিজ্য মেলায় আসা ক্রেতাদের মুখে মাস্কের হার বৃদ্ধির ক্ষেত্রে সমন্বিত উদ্যোগ ও প্রচারণা কার্যক্রম সঠিকভাবে হাত নেয়া জরুরি। এছাড়া আমরা দেখতে পাই গণপরিবহনে যাত্রীদের আসন সংখ্যা কমিয়ে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে চলাচলে যে বিধি আরোপ করা হয়েছে, তা মালিকপক্ষ ভাড়া না বাড়িয়ে বাস্তবায়নে যেতে নারাজ। আর ভাড়া বাড়ালে জনভোগান্তি বৃদ্ধি পায়। এমন উভয় সংকটপূর্ণ বাস্তবতায় সামাজিক উদ্যোগ তথা পরিবহন খাতের সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন অংশীদার, যেমন চালক, সহকারী, টিকিট কাউন্টারের লোকজন, যাত্রী, প্রশাসন সবাইকে মাস্ক পরিধান ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলায় সজাগ হতে হবে। বাসে আসন ফাঁকা রেখে যাত্রী পরিবহন সম্ভব না হলেও যাতে এ পরিবহন ব্যবস্থায় মাস্ক পরিধান ও হাত স্যানিটাইজ করার ব্যবস্থা যথাযথভাবে কাজ করে, সে বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সবার গুরুত্ব দেয়া জরুরি। এক্ষেত্রে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলোর অভিজ্ঞতাকেও সরকার সমন্বয়ের কথা চিন্তা করতে পারে।

সব শেষে, মানসম্মত মাস্ক সবার হাতে পৌঁছানো ও সঠিকভাবে পরিধানের ব্যাপারে কর্তৃপক্ষকে সচেতন হওয়া যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি এই ওমিক্রন ধরনটি মোকাবেলা করতে সব দিক বিবেচনা করে সুন্দর ও সমন্বিত একটি জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম দেশব্যাপী গ্রহণ করা জরুরি বলে অনুধাবন করা যায়।

 

তানভীর শাতিল: উন্নয়ন গবেষক, বিআইজিডি

ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন