প্রচলিত সমবায় আইন সংশোধন করতে হবে

অ্যাসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্ম অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (এএলআরডি) বণিক বার্তার যৌথ উদ্যোগে গত ২৭ নভেম্বর ২০২১ প্রচলিত সমবায় আইনের সংস্কার এবং দরিদ্র প্রান্তিক কৃষকের অধিকার শীর্ষক অনলাইন বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। আলোচকদের বক্তব্যের গুরুত্বপূর্ণ অংশ নিয়ে ক্রোড়পত্র


দেওয়ান হানিফ মাহমুদ
সম্পাদক, বণিক বার্তা

বাংলাদেশে সমবায়ের প্রেক্ষিতটা বুঝতে গেলে আমাদের সমবায়ের ইতিহাসটা জানা দরকার। সমবায় উপনিবেশের ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশে এসেছে। ইউরোপ ইংল্যান্ডে সমবায় এসেছে মূলত ইন্ডাস্ট্রিয়াল রেভল্যুশন এবং ক্যাপিটালিজম সম্প্রসারণের সময়ে। অনেকটা বলা যায় কাউন্টার প্রডাক্ট হিসেবেই সেখানে সমবায়ের ব্যাপারটা এগিয়েছে। আমরা রবার্ট ওয়েনের কথা জানি, রসডেল সোসাইটির কথা জানি, সেসব মূলত সোস্যাল ওয়েলফেয়ারের পার্সপেকটিভ থেকে এসেছিল। আর আমাদের এখানে সমবায়টা এসেছে ব্রিটিশদের উৎসাহ থেকেই। তাই ইউরোপের সমবায় আমাদের সমবায়ের যাত্রা নিয়ে যেসব তথ্য পাই তাতে পার্থক্য আছে। আমাদের এখানে আমরা সমবায়ের অধিকার, আন্দোলন, আইনি কাঠামোটাকে তিনটা পর্যায়ে পাই। প্রথম পর্যায় হলো ঔপনিবেশিক। দ্বিতীয় হলো পাকিস্তান সময় এবং তৃতীয় পর্যায় হলো স্বাধীন বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধু সমবায়কে প্রাধ্যান্য দিলেও আইনি কাঠামোর মধ্যে সমবায়ের অনেক বাধা ছিল। সেটাকে নিয়ন্ত্রণ করা বা এর গণতান্ত্রিক প্রবণতাগুলো সুস্পষ্ট নয়। বাংলাদেশে নিবন্ধিত সমবায়ের সংখ্যা কয়েক লাখ। অনিবন্ধিত সমবায় আরো বেশি। কিন্তু খেয়াল করলে দেখব যে, দরিদ্র কৃষককে ঘিরে সমবায়ের সংখ্যা অনেক কম। তুলনামূলকভাবে কনজিউমার সোসাইটি, হাউজিং সোসাইটি, ক্রেডিট সোসাইটির সংখ্যা অনেক বেশি। কৃষক ভূমিহীনদের সমবায়ের সংখ্যা তুলনামূলক কম। সে পরিপ্রেক্ষিতে আজকের আলোচনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।


খুশী
কবির
চেয়ারপারসন, অ্যাসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্ম অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট

(এএলআরডি)
সমন্বয়ক, নিজেরা করি

১৯০৪ সালে প্রথমে আইন করা হয়েছিল, পরে ১৯১২ সালে তা সংস্কার করা হয়। পরে পাকিস্তান আমলে আখতার হামিদ খানের কুমিল্লা মডেল যেটা সারা বিশ্বে নাম করেছিল সেটি শুরু হয়েছিল। আমি যখন ৭২ সালের পর ধরনের কাজে যুক্ত হই তখন সবাই কুমিল্লা মডেলের সম্প্রসারণের চেষ্টা করেছিলাম। কুমিল্লা মডেলে গ্রামীণ কৃষকদের শ্রেণীর ভাগে তেমন নজর দেয়া হয়নি। হতদরিদ্র যারা ওই সমবায়ের অধীনে থাকতেন তারা কিন্তু বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হতেন। বঙ্গবন্ধু সদ্য স্বাধীন দেশের হাল ধরে সমবায় আন্দোলনকে শক্তিশালী করতে চেয়েছেন, আইনের সংস্কার করতে চেয়েছেন, সেগুলো তিনি শেষ করে যেতে পারেননি। অধিকাংশ সমবায়ের বিষয়টা ছিল ঋণ পাওয়া কেন্দ্রিক। ৮০-এর দশকের প্রথম দিকে সমবায় নিয়ে আরেকটি অভিজ্ঞতা হয়েছিল। নোয়াখালীতে প্রচুর চর ছিল এবং সেখানে সমবায়ভিত্তিক ভূমি কর্মকর্তা দায়িত্বে ছিলেন, সেই সময়ে কৃষি ভূমি একসঙ্গেই ছিল। জেডএম ওবায়দুল খান চীন থেকে ফিরে এসে কো-অপারেটিভ করার বিষয়ে উদ্যোগ নেন। কো-অপারেটিভের নামে প্রচুর খাসজমি দেয়া হয়েছিল, পরবর্তী সময়ে যা টেকেনি। পরে ব্যক্তির নামে জমি দিতে সরকার বাধ্য করেছে। তখন ওই কো-অপারেটিভ করার পরে এবং এই কো-অপারেটিভ রেজিস্ট্রি করার পরে দুই অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতে দেখেছি যে, আইনের মধ্যে নানা জটিলতা রয়েছে। ভূমিহীন ক্ষেতমজুর যারা সরকার থেকে জমি পাচ্ছে বা নিজেরা চাষ করছে, সেখানে অনেক দুর্বলতা থেকে যাচ্ছে। বঙ্গবন্ধুর লক্ষ্য ছিল সমবায়ের মাধ্যমে ভূমিহীনদের খাসজমি বিতরণ করা এবং সেখানে তারা একসঙ্গে যৌথভাবে চাষ করবেসেই বিষয়টাও আইনের প্যাঁচের জন্য অনেক জায়গায় ধাক্কা খেয়েছে। সমবায়ের সাফল্য আসবে যদি আমরা দরিদ্র প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর স্বার্থে আইনের কিছু পরিবর্তন আনতে পারি।


রওশন
জাহান মনি
উপনির্বাহী পরিচালক
অ্যাসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্ম অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট
(এএলআরডি)

বাংলাদেশের সংবিধান প্রণেতারা সমবায়ের গুরুত্ব সম্পর্কে সেই সময়ে সুস্পষ্ট চিন্তা করেছিলেন। তাই সংবিধানের ১৩ নং অনুচ্ছেদে সম্পদের তিন ধরনের মালিকানার কথা বলা হয়েছে। . রাষ্ট্রীয়, . সমবায় . ব্যক্তিগত। কিন্তু বাস্তবে রাষ্ট্রীয় মালিকানায় সম্পদের ব্যবহার প্রয়োগে কিছু স্পষ্টতা দেখা যায়। ব্যক্তিগত বিশেষ করে প্রাকৃতিক সম্পদ যদি বলি জমি, জলা বন ৮০ শতাংশের মতো ব্যক্তি মালিকানায় রয়েছে এবং সেটির ব্যবহার, অপব্যবহার যথেচ্ছাচার সবই চলছে। কিন্তু যেটি অনুপস্থিত সেটা হলো সমবায় মালিকানা। সমবায় মালিকানাকে স্বীকার করে নিয়েই আইনের ভিত্তিতে সংবিধান অনুসারে সেটার মালিকানা প্রতিষ্ঠা করা এবং সেটাকে সর্বতোভাবে সহযোগিতা করার কথা ৫০ বছর পরও আমরা একইভাবে বলতে পারি, যা প্রায় অনুপস্থিত। রেজিস্ট্রেশনের ক্ষেত্রে আইনের নং ধারাটি শুধু ব্যতিক্রমের ক্ষেত্রে ব্যবহারের কথা থাকলেও এটি যথেচ্ছ ব্যবহার হচ্ছে। এবং ধারাকে পাশ কাটিয়ে সমবায় সমিতি অকার্যকর এবং আমলা নিয়ন্ত্রিত হয়ে আছে। সমবায় সমিতির রেজিস্ট্রেশনের ক্ষেত্রে আইনে কর্মকর্তাদের সর্বময় ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। বিধানের বিপরীতে যদি মনে হয় যে, সমবায়ীদের প্রতি সুবিচার করা হয়নি বা ঠিকভাবে চলছে না তাহলে চ্যালেঞ্জ করার কোনো সুযোগ নেই। কেননা সেটা করতে গেলেও সমবায় সমিতির রেজিস্ট্রেশন যারা দিয়েছেন বা যারা সরকারি কমিটিতে রয়েছেন তাদের অনুমতি ছাড়া কিছু করা যাবে না। সমবায়ীরা রেজিস্টার্ড হতে চান না জটিলতার কারণে এবং রেজিস্টার্ড না হওয়ার কারণে তারা যা করেন সবই অবৈধ হিসেবে পরিগণিত হয়। এখানে বড় বাধা ম্যানেজিং কমিটির বিধানাবলি। যারা সরকারের পক্ষ থেকে সমবায়ের সঙ্গে জড়িত থাকেন তাদের জন্য এক রকমের ক্রাইটেরিয়া নির্ধারণ করা হয়। অন্যদিকে সমবায়ীদের পক্ষ থেকে যারা ম্যানেজিং কমিটিতে থাকেন তাদের জন্য ক্রাইটেরিয়াগুলো আরো কঠিন হয় এবং সেগুলো সরকারিদের পক্ষে বর্তায় না। এটি সাংঘাতিক

বৈষম্যমূলক। আবার দেখা যায় যে, তাদের ওপরই ম্যানেজমেন্টের সব ধরনের ক্ষমতা দেয়া থাকে। এমনকি সমবায় সমিতির নিবন্ধক বা তার মাধ্যমে ক্ষমতাপ্রাপ্ত কোনো কর্মকর্তার লিখিত পূর্বানুমতি ছাড়া সমবায়ীরা সমবায় সমিতির সংশ্লিষ্ট কোনো বিষয়ে ফৌজদারি মামলা দায়ের করতে পারেন না। আরেকটি বড় বিষয়, যদি কোনো সমবায় সমিতির বিলুপ্তি বা অবসায়ন করতে হয় সেটার জন্য সমবায় আইনের ৪৩ ধারা রয়েছে। কোনো সমিতির অবসায়নের ক্ষেত্রে সদস্যদের কোনো অনুমোদন ছাড়াই নিবন্ধক অবসান করতে পারে। নিবন্ধক হচ্ছেন সেই সব সরকারি কর্মকর্তা যারা রেজিস্ট্রেশন দিয়ে থাকেন। তারা মনে করলেন যে, একটা কমিটি ঠিকঠাক চলছে না। শুধু কারণে তারা সেটার অবসান করে দিতে পারেন। অথচ সমবায় হলো যৌথ চর্চার জায়গা।

অধিদপ্তর নিয়ন্ত্রক নয় বরং অধিকতর সহায়ক ভূমিকায় থাকতে হবে। তার জন্য একটি সমবায় কমিশন প্রতিষ্ঠা করতে স্বচ্ছ, জবাবদিহিমূলক, গণতান্ত্রিক সমবায় সংগঠন তৈরি করতে হবে। কোনো সমবায় সমিতিকে নিবন্ধন দেয়া না হলে সে ব্যাপারে দেওয়ানি আদালতে প্রতিকার চাওয়ার সুযোগ থাকা প্রয়োজন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায়, ম্যানেজমেন্ট কমিটির কোনো একটা অংশ একত্র হয়ে তাদের স্বার্থে সেটিকে পরিচালনা করে। নিবন্ধন দেয়ার ক্ষেত্রেও যখন তারা দেখেএখানে এমন কোনো দল আছে, যাদের তারা নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না, তাদের তারা অনুমতি দেয় না। না দেয়ার বিরুদ্ধেও কোনো পদক্ষেপ নেয়া যায় না। যেসব সমবায় সমিতি কোনো সুনির্দিষ্ট অনগ্রসর সম্প্রদায়, শ্রেণী বা গোষ্ঠী যেমন দলিত, আদিবাসী সদস্যরা করতে চান সেখানে এমন একজন বা একাধিক প্রভাবশালী ব্যক্তি এসে ঢোকেন যে তারা পুরোটাকে নিয়ন্ত্রণ করেন। এক্ষেত্রে কোনো সমবায় সমিতির অন্তর্বর্তীকালীন ম্যানেজিং কমিটিতে সদস্য নিয়োগের ক্ষেত্রে সমবায়ীদের মতামত গ্রহণের বিধান প্রবর্তন করা যেতে পারে। কারণ একজন ম্যানেজিং কমিটিতে এলে পছন্দসই লোক ম্যানেজিং কমিটিতে ঢোকাতে থাকেন। একসময় সেটা অকার্যকর হয়ে যায়। ম্যানেজিং কমিটির অন্য বেসরকারি সদস্যদেরও অযোগ্যতা যোগ্যতার ক্রাইটেরিয়া থাকা উচিত। সমবায় সমিতির কমিটির সদস্যদের বিরুদ্ধে অপরাধমূলক কার্যক্রমের জন্য ফৌজদারি আইনে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে চাইলে অধিদপ্তরের পূর্বানুমতির ব্যাপারটি বাতিল করতে হবে। যিনি এটি করে থাকেন তার কাছেই যদি অনুমতি চাইতে যাই তাহলে এর প্রতিকার কখনই আসবে না। সমিতির সদস্যদের মনোনীত কোনো ম্যানেজিং কমিটির সদস্যকে তার পদ থেকে বহিষ্কারের আগে সমবায়ীদের একটি সাধারণ সভা ডেকে তার পদচ্যুতির কারণ ব্যাখ্যা করা এবং সমবায়ীদের মতামত গ্রহণ অপরিহার্য হওয়া উচিত।


. রওশন আরা
অধ্যাপক
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

হতদরিদ্র জনগোষ্ঠী, মজুর, কৃষক, শ্রমিকদের জন্য বঙ্গবন্ধু সমবায় চেয়েছিলেন। তারা যেন সমবায়ের মাধ্যমে জীবনযাপন করতে পারেন। তাদের জীবনে যেন ইতিবাচক পরিবর্তন আসে। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন এটা কোটারি গোষ্ঠীর জন্য নয় কিন্তু বর্তমানে সেটা ধনী কোটারি গোষ্ঠীর অধীনেই চলে গেছে। কারণ আমি দেখেছি যে, শ্রেষ্ঠ সমবায়ী হিসেবে পুরস্কার পেয়েছে কিছু ব্যক্তি যারা অনেক ধনী। ধনী ব্যক্তিদের সমবায়ের জন্য সমবায় নীতি করা হয়নি। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, সুবিধাটা তারা পাচ্ছে এবং হতদরিদ্ররা বঞ্চিত হচ্ছে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা দুর্নীতির কবলে পড়ে। আরেকটা হচ্ছে, পুরো আইনটার মধ্যেই অনেক ভুলভ্রান্তি রয়েছে, যেটা সমবায়ের বিকাশে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমার তারুণ্যের সময়ে আখতার হামিদ খানের নেতৃত্বে দিদার কো-অপারেটিভ গড়তে দেখেছি। আসলে কুমিল্লায় সেই সময়ে অনেক রিকশা শ্রমিক ছিলেন, তারাই সমবায়ে বেশি ছিলেন। এটাও ঠিক যে, সমবায়ে গ্রামীণ কৃষকরা খুব বেশি ছিলেন না। সুইপাররা ছিলেন এবং আরো অনেকে ছিলেন যারা শ্রমিক দরিদ্র গোষ্ঠী। ছয় আনা দিয়ে শুরু হয়েছিল এবং সেটা সফল ছিল। সেই মডেলের আদলেই পরে আরো সমবায় গড়ে উঠেছে। যদিও কৃষকরা তার মধ্যে আসেননি। কিন্তু কুমিল্লা কোটবাড়ি এলাকার অনেক গ্রাম সমবায়ের সুফলটা পেয়েছে এবং অনেকের অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু সেই সমবায় বা আমরা এখন যেটা চাইছিদুটোর মধ্যে অনেক পার্থক রয়েছে। দেখা যাচ্ছে পুরুষ কৃষকের থেকে নারী কৃষকের সংখ্যা অনেক বেশি। কিন্তু তত্ত্ব বা তথ্যটা কেউ মেনে নেয় না। তার বড় কারণ কৃষিনীতিতে নারী কৃষকের সংজ্ঞা ভালোভাবে দেয়া হয়নি। কোন নারীরা কৃষক সেটা কোথাও উল্লেখ নেই। স্বীকৃতি দেয়াই হয়নি। ফলে হতদরিদ্র নারী কৃষক কার্ড পান না। আর কৃষি কার্ড পান না দেখে তিনি ঋণ পান না, সার পান না, কীটনাশক পান না। আবার দেখা যায় কেউ কেউ স্বামীর নামে কার্ড পান, হয়তো দেখা যায় স্বামী কিছুই করেন না, ঘরে বসে থাকেন, নারীই সব করেন। বিভিন্ন অধিদপ্তরের সমন্বয়হীনতার ফলে লাভ হয় না। এক অধিদপ্তর প্রশিক্ষণ দিয়ে ছেড়ে দেয়; বলে, সমবায় করো, কিন্তু যখন রেজিস্ট্রেশনই পায় না, ঠেকে যায়, তখন তাকে সাহায্য করে না। এসব বাধা দূরীকরণে সমন্বিত প্রচেষ্টা দরকার। আর এই যে নারীরা সমবায় সমিতি গড়তে পারেন না তার সবই নেতিবাচক নয়, কিছু ইতিবাচক দিকও আছে। কারণ বাধা পেলেই মানুষ ঘুরে দাঁড়ায়। মানুষ নিজের মতো করে কাজ করছে।

. মো. নাজিম উদ্দিন
ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট

সমবায়ের আইনটা তৈরি করা হয়েছে ব্রিটিশ আমলে। এখনো আইনে ওই রেফারেন্সগুলো রয়ে গেছে। সেখানে অনেক গলদ আছে। আইনগুলো তৈরি হয়েছিল সে সময়ের প্রেক্ষাপটে তার ক্লায়েন্টকে মাথায় রেখে। তার পরও আইনের ব্যাকগ্রাউন্ডে প্রচণ্ড মাত্রায় গলদ আছে। সেখানে দেশের মানুষের যে মনন, চিন্তাধারা, ঐতিহ্য সেসব তেমনভাবে চিন্তা করা হয়নি। কারণ তখন শাসকগোষ্ঠী ছিল ব্রিটিশ। শিল্প বিপ্লবের পর যখন কৃষি উৎপাদন ব্যাপকভাবে বাড়তে থাকল তখন যান্ত্রিকীকরণ অ্যাফোর্ড করার জন্য শাসকগোষ্ঠী বিশেষ করে ইউরোপে একটা উইন উইন সিচুয়েশন তৈরির জন্য সমবায় করা হয়েছিল। কিন্তু আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটটা ছিল ভিন্ন। স্বাধীনতার পর সেই সুযোগটা ছিল, কিন্তু আমরা সেই সুযোগটা নিইনি। ফলে আইনের অনেক সমস্যা থেকেই গেছে, যেহেতু ব্যাকগ্রাউন্ডটা ছিল এমন। প্রায় ৮০ শতাংশের কাছাকাছি আমাদের প্রান্তিক চাষী, তাদের মধ্যেও এক ধরনের বিভাজন আছে। আমরা রিপোর্টে দেখলাম আমাদের ক্ষুদ্র প্রান্তিক কৃষক আছেন ৭৭ শতাংশ, সেখানে অ্যাকসেস টু দ্য ফার্ম ক্রেডিট মাত্র সাড়ে শতাংশ। অথচ বড় কৃষকদের ১৪ শতাংশ ক্রেডিট অ্যাকসেস পাচ্ছেন। আমি যদি প্রডাক্টিভিটির কথা বিবেচনা করি, তাহলে এক হেক্টরে মার্জিনাল কৃষকরা ৯৫ হাজার টাকার মতো গ্রস ভ্যালু যোগ করছেন, সেখানে বড় কৃষকরা বছরে ৮০ হাজার টাকার মতো যুক্ত করছেন। প্রডাক্টিভিটির দিক থেকে কিন্তু ক্ষুদ্র কৃষক এগিয়ে। এখানে বৈষম্যের সৃষ্টি হচ্ছে। ক্ষুদ্র বড় কৃষকদের মধ্যে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বৈষম্য আছে। যাদের পুঁজি কম তারা সব ক্ষেত্রে ধরনের বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। আমাদের যে ফসলগুলো ঘরে উঠেছে, সেগুলো কৃষিকেন্দ্রিকভাবে শুরু থেকেই সফলতা পায়নি। বাংলাদেশে সমবায় করার মতো প্রফেশনালই তৈরি হয়নি। আমরা হয়তো অন্যদের দায় দিচ্ছি কিন্তু তাদের পক্ষেও প্রফেশনাল সমবায় গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি। কিছু নিয়মকানুন থাকবে, কিছু প্রতিবন্ধকতা থাকবে। সেসব মেনেও আমাদের দেশে সমবায় প্রফেশনাল তৈরি হয়নি। প্রফেশনাল তৈরি হওয়া খুব জরুরি।


শ্রীমতী
সপ্তমী রানী
চাঁদবিল হালদারপাড়া
জনসমবায় দলের প্রতিনিধি
আমঝুপি, মেহেরপুর

আমরা প্রথমে এক মুষ্টি করে চাল জমা করে সঞ্চয় করেছি। সেই সময়ে আমরা ১৫ জন সদস্য ছিলাম। এখন আমাদের সদস্য ২১ জন। তারপর আরো কিছু সঞ্চয় করে আমরা গরু পালন করেছি। আমাদের সঞ্চয় এখন লাখ ১৫ হাজার টাকা। আমাদের টাকা দিয়ে কিছু জমি নেয়া আছে। সেই জমিতে আমরা আবাদ করি। আমাদের দেখাদেখি পাশে আরেকটা দল গঠন হয়েছে। তাদের ৩২ জন সদস্য। তারাও আমাদের মতো করেই সঞ্চয় করে। তাদেরও লাখ ২০ হাজার টাকা সঞ্চয় হয়েছে। আমরা ২০১৭ সাল থেকে জনসমবায় দল গঠন করেছি। আমরা ভবিষ্যতে সামনে যাওয়ার চেষ্টায় আছি। আমাদের প্রতি মাসে মানব উন্নয়ন কেন্দ্রে একটা মিটিং হয়, বাইরে থেকে আমাদের প্রশিক্ষণ দেয়ার জন্য কৃষি অফিসার আসেন। আমরা পশুপালনও করি। সেজন্য পশু কর্মকর্তা এসে আমাদের প্রশিক্ষণ দেন।

আবু সাঈদ খান
উপদেষ্টা সম্পাদক
দৈনিক সমকাল

রাষ্ট্র হিসেবে আমরা উল্টো পথে চলছি। আমাদের সংবিধানে প্রথম রয়েছে রাষ্ট্র মালিকানা, তারপরে সমবায় মালিকানা আর শেষে রয়েছে ব্যক্তি মালিকানা। অথচ এখন ব্যক্তি মালিকানার দাপটে রাষ্ট্রীয় মালিকানা, রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলো রাষ্ট্রের হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। সমবায় প্রতিষ্ঠানগুলো দাঁড়াতে পারছে না, ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। রাষ্ট্রের নীতিগত সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করা দরকার। আমরা ৫০ বছর আগে স্বাধীনতার শুরুতে যে পথে যাত্রা করেছিলাম, এখন আমরা তার উল্টো পথের যাত্রী। স্বাধীনতার ৫০ বছর পর এটা পরিবর্তন হওয়া দরকার। সমবায়ের সদস্যরা সমবায়ের মালিক এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের এখতিয়ার তাদের ওপরই থাকবে, অধিকার তাদের কাছেই থাকবে। কিন্তু এখানে আমলাদের কঠোর খবরদারি আছে। আইন, বিধি এবং এমনকি মানসিকতার কারণে সমবায়গুলো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, দাঁড়াতে পারছে না। অনেক ক্ষেত্রে সমবায়কে যেখানে পৃষ্ঠপোষকতা সহায়তা দেয়া দরকার, সেখানে সেটা না দিয়ে তাদের অধিকার কেড়ে নেয়া হচ্ছে এবং তাদের ক্ষতি কিংবা ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়া হচ্ছে যেন তারা দাঁড়াতে না পারে। আমলাতন্ত্রের মনোভাব পরিবর্তন হওয়া দরকার। সেজন্য আরো বড় পাহারাদার দরকার। এখানে এএলআরডি একটা পাহারাদার। তারা তৃণমূলের সমবায়গুলোকে পাহারা দিচ্ছে। সেজন্য আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা দরকার যেন সমবায়ীরা বিশেষ করে নারী সমবায় আরো বিকশিত হতে পারে। তৃণমূলে অনেক উদ্যোগ রয়েছে সেখানে খাসজমির বিষয় রয়েছে, সেখানে অনেক সমবায় গড়ে তোলা সম্ভব এবং সেখানে তার মালিকানাসহ সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা বাড়ানো সময়ের দাবি। সেজন্য সমবায়ীদের জোট দরকার, ঐক্য দরকার। সেখানে ঐক্যবদ্ধভাবে কাউকে লড়াই করতে হবে এবং সেই লড়াইয়ে আমাদের পাশেও থাকতে হবে। সেটা দুই ধরনের লড়াই, এক আইনি লড়াই, আইনের মধ্য দিয়ে যেটা এখানে আলোচিত হয়েছে যে ব্রিটিশ আমলের পুরনো আইন, এখনো সেগুলোর রেফারেন্স থেকে গেছে। সেগুলোর সংস্কার হওয়া দরকার। সেই সঙ্গে আমাদের অন্য লড়াই সংগ্রাম দরকার।


এম
এম আকাশ
অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

আমাদের ভারতের লিজ্জতকে দেখতে হবে। খুব ক্ষুদ্র ছিল তারা কিন্তু এখন ভারতের পাপড়ের বাজার সেই পাপড় নির্মাতা নারীরা দখল করে নিয়েছেন। তারা কীভাবে পারল এবং আমরা কীভাবে টুকটাকের মধ্যে আটকে আছি বা টুকটাকও আমরা পারছি না? তার মানে হচ্ছে, এখানে দুটো সমস্যা। প্রথমত, দরিদ্র মানুষের জন্য সমবায়। দ্বিতীয়ত, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সমবায়। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে তিন ধরনের উদ্যোগ সম্ভবসার্ভিস কো-অপারেটিভ, মার্কেটিং কো-অপারেটিভ, প্রডাকশন কো-অপারেটিভ। সার্ভিস কো-অপারেটিভের মধ্যে ঋণ সার্ভিস, ঋণ সংগ্রহ প্রভৃতি হতে পারে। আমরা হয়তো জনসেচের যন্ত্র কো-অপারেটিভলি কিনতে পারি, সেখানে জলসেচের সুবিধা আমরা কৃষককে দিই। ভূমিহীনরা ওন করে বা একটা ট্রাক্টর ভূমিহীনরা ওন করে, তারা এটা কেনে। হাসপাতাল, স্কুল, এসবও কো-অপারেটিভের মাধ্যমে করতে পারি এবং সার্ভিস দিতে পারি। মার্কেটিং কো-অপারেটিভের উদাহরণ তো আপনারাই দেখালেন। এটা ইকোনমিকসের এলিমেন্টারি কথা, যেকোনো সময় বিন্দু বিন্দু জল যদি একত্র হয়, তাহলে সেখান থেকে পুকুর, পুকুর থেকে নদী, সেখান থেকে মহাসমুদ্রও হতে পারে। সুতরাং থিওরেটিক্যালি সেটা কারেক্ট। কিন্তু এই স্কেলিং আপটা করতে গেলে প্রথম স্টার্টিং পয়েন্ট হলো, যে দরিদ্র লোকদের আপনি একত্র করবেন তাদের হোমোজিনিয়াসলি কো-অপারেটিভে আনতে হবে। আপনি যদি শিয়াল মুরগিকে একই কো-অপারেটিভে আনেন, তাহলে সেখানে শিয়ালের আধিপত্যই প্রতিষ্ঠিত হবে। দিদার কো-অপারেটিভে রিকশাওয়ালার আধিপত্য ছিল দেখে সেটা সাকসেসফুল হয়েছে। কুমিল্লা কো-অপারেটিভে ধনী কৃষক মধ্য কৃষক ছিলেন দেখে সেটা সাকসেসফুল হতে পারেনি। সেজন্য আইনি সংস্কার দরকার। মধ্যবিত্তরা মধ্যবিত্তদের কো-অপারেটিভ করুক আর ধনীরা ধনীদের কো-অপারেটিভ করুক। আমরা তৃতীয় বিশ্ব-দ্বিতীয় বিশ্বের অ্যাগেইনস্টে কো-অপারেটিভ করি। তারা একত্র হয়ে ফার্স্ট ওয়ার্ল্ডের বিরুদ্ধে কো-অপারেটিভ করলেও তাতে কোনো সমস্যা নেই। মনে রাখতে হবে, আমরা কাজ করতে চাইছি ধনীদের জন্য নয়, মধ্যবিত্তের জন্য নয়, দরিদ্রদের জন্য। কাজেই তাদের সংগঠন একটা শক্তি। তাদের লেখাপড়া একটা শক্তি, দক্ষতা একটা শক্তি, পুঁজি তাদের আরেকটি শক্তি। পুঁজি দখল করে, পুঁজি সঞ্চয় করে, পুঁজির সঙ্গে দক্ষতা সংগঠনের সম্পর্ক তৈরি করে এগোলে সমবায় এগোবে, না হলে এগোবে না। সমবায় আইনের যে জটিলতাগুলো তুলে ধরা হলো, সেগুলো খুব সঠিক। আপনি যদি আমলাতন্ত্রের হাতে ক্ষমতা দিয়ে দেন যে যেকোনো সময় সমবায় ভাঙতে পারবে, আপনি যদি এমন একটা লাইসেন্সিংয়ের নীতি প্রণয়ন করে রাখেন যে, সেখানে আমাদের গরিব হরিদাসী কিছু বোঝেই না এবং যেতেই পারে না। আরেকজনের মাধ্যমে না গেলে সে ব্যাংকের অ্যাকাউন্টও খুলতে পারে না, লাইসেন্সও করতে পারে না, আপনি যদি অনানুষ্ঠানিক সমবায়গুলো যেসব নিজের প্রয়োজনে মানুষ তৈরি করে সেগুলোকে এমন প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেন তাহলে সেগুলো কখনই আনুষ্ঠানিক হতে পারবে না। তাহলে নিশ্চয়ই সংস্কার করে করে এগোনোর রাস্তাটা বন্ধ হয়ে যাবে। আমি চাইছি আইনের সংগ্রামটা চলুক, সচেতনতা তৈরির সংগ্রামটা চলুক, মানবসম্পদ উন্নয়নের চেষ্টাটাও চলুক। বহুমাত্রিক উদ্যোগ দিয়ে আমরা আমাদের গরিব মানুষের কণ্ঠস্বর যত দিন না তৈরি করতে পারব ততদিন সংগ্রাম, সংগ্রাম, সংগ্রাম।



লিপি
কুজুর
খেলোবাড়িয়া আদিবাসী নারী জনসমবায় দলের প্রতিনিধি
লক্ষ্মীপুর, নাটোর

আমি একজন ক্যাশিয়ার। আমাদের এখানে আদিবাসী সমাজ উন্নয়ন থেকে রায়হান ভাই আসেন। সেখানে আমরা ১০-১৫ জন বসি। তারা বলেন আমরা দল করতে চাই, তোমাদের কী মত। তখন আমরা মুষ্টিচাল দিয়ে শুরু করে। পরে যখন - হাজার টাকা হয়েছে তখন আমরা জমি লিজ নিলাম। সেখানে আমরা অ্যালোভেরা চাষ করি। দলের সবাই সেখানে শ্রম দিই। এখন এভাবে এগোচ্ছি। রেজিস্ট্রেশন সমবায়ের চিন্তাধারাও আমাদের আছে। অ্যালোভেরা কেটে শুকিয়ে পাউডার তৈরি করি। সহযোগিতা পেলে আমরা সেগুলো বিক্রি করতে পারব। পুরুষরা আগে বাধা দিত এসব কী করছ, মেয়েরা এসব পারবা না, তখন তাদের বোঝানো হয় যে, এসব করলে আমরা ছেলেমেয়েদের জন্য কিছু করতে পারব।


শাহ
মবিন জিন্নাহ
নির্বাহী পরিচালক
কমিউনিটি ডেভেলপমেন্ট অ্যাসোসিয়েশন (সিডিএ)
দিনাজপুর

পরিসংখ্যানে দেখা যায় গ্রামীণ দরিদ্র মানুষই সংখ্যাগরিষ্ঠ। এদের মধ্যে সংখ্যালঘিষ্ঠের কোনো ব্যাপার নেই। মেজরিটি হচ্ছে গরিব মানুষ। এবং তারা তৃণমূলের মানুষ। তারাই আবার গ্রামে একটা প্রধানতম সিস্টেমের সঙ্গে বা উৎপাদনের যে প্রক্রিয়া তার মধ্যে রয়েছে। সেটা হলো প্রধান খাদ্য উৎপাদন। সেটার মধ্য দিয়ে খাদ্যটা হয়তো অন্যকে দিয়ে দিচ্ছি। অন্য পণ্যগুলো বাজারে দিয়ে দিচ্ছি। সেখানে যে বৈষম্য  বিদ্যমান সেটাও খুব চমত্কারভাবে উঠে এসেছে। এই প্রসেসটা একদিনে আর আমরা আনিনি। সেটা আমাদের স্বাধীনতার পর থেকে চলছে। যারা উন্নয়নবাদী বা অধিকারবাদী এনজিও তারা সবসময় বটম আপ ডেমোক্রেসি দিয়েই জায়গায় এসে পৌঁছেছে। কয়েকটা সাজেশন এসেছে হোমোজেনাস কো-অপারেটিভ। খুব ভালো সমাধান। স্থানীয়ভাবে কমিউনিটি শব্দ ব্যবহার করে কাজ করি। সেটাকেও রিডিফাইন করে এখানে আনা যায় যে হোমোজেনাস কো-অপারেটিভ। বাংলাদেশের সংবিধান সমবায় আইনে পরিষ্কারভাবে বলে দেয়া আছেধনিক শ্রেণীর মানুষরা ধরনের শ্রমজীবীদের জন্য গড়া সমবায় সমিতিতে অনুপ্রবেশ করবে না। সেটাই কোড অব এথিকস। আর দুটো সুপারিশ যোগ করে আমি শেষ করব। আন্দোলন করতে হবে। কো-অপারেটিভ গঠন করার জন্য একটা ন্যাশনাল অ্যাকশন প্ল্যান থাকতে হবে। সেই ন্যাশনাল অ্যাকশন প্ল্যানের কাজ হবে অর্থনৈতিক মানবাধিকার বিষয় সংযোজন করে আমাদের দেশের বৈষম্য নিরসন করার জন্য, ন্যায্যতা সাম্যতা সৃষ্টি করার জন্য, মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকার প্রতিষ্ঠা করার জন্য উদ্যোগ নেয়া।

শামসুল ইসলাম দীপু
মিশন চিফ, স্পিড ট্রাস্ট
বরিশাল

সমবায়টা আমরা আসলে এজন্য চাই যে আমাদের বেশির ভাগ মানুষ হতদরিদ্র। তাদের যদি দ্রুত অর্থনৈতিক বা সামাজিক উন্নতি করতে হয় তাহলে সমবায়ই একমাত্র টুলস বা উপায়, যা দিয়ে তাদের পুঁজি দ্রুত গঠন করা সম্ভব একসঙ্গে কাজ করতে পারব, একসঙ্গে পণ্য উৎপাদন করতে পারব এবং সেগুলো একসঙ্গে বাজারজাত করতে পারব। দেশের তৃণমূলের মানুষ কিন্তু বসে নেই। তারা সমবায়ের নাম ধারণ না করলেও অন্য প্রক্রিয়ায় সমবায়ের দল গঠন করছে। দলের মাধ্যমে তারা বিভিন্ন আয়মূলক কর্মকাণ্ড করছে, উৎপাদন করছে, বিপণন করছে। এভাবে তারা আল্টিমেটলি অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি খুঁজে পাচ্ছে। যারা সরকারিভাবে নিবন্ধিত তারা আনুষ্ঠানিক সমবায় আর যারা নিবন্ধিত না কিন্তু আমরা একসঙ্গে কাজ করছি সেগুলোকে অনানুষ্ঠানিক সমবায় বলতে পারি। চ্যালেঞ্জটা হলো ওই জায়গায়, আমাদের রেজিস্ট্রেশন না হলেও চলত কিন্তু রেজিস্ট্রেশনের দরকার আছে। আমরা সমবায় চালাচ্ছি কিন্তু আমাদের সরকারি আইডেন্টিটি নেই। এটা না থাকার একটা সমস্যা হলো, আমরা ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে পারছি না। আরেকটা সমস্যা হলো, সমবায় সমিতি যদি কিছু জমি ক্রয় করতে চায় সেখানে আইডেন্টিটির ঘাটতির কারণে ক্রয় করতে পারে না। এগুলো বড় চ্যালেঞ্জ। বাধাগুলোর জন্যই কিন্তু অনিবন্ধিত যারা কাজ করছে তারা একটা জায়গায় গিয়ে থেমে যাচ্ছে। তাদের উন্নতি সেভাবে হচ্ছে না। সবচেয়ে দরকারি হচ্ছে, সরকারি ইনটেনশন। সরকারি ইনটেনশন যদি সমবায়ের প্রতি পজিটিভ হয় তাহলে আমরা অনেক দূর যেতে পারি। এজন্য সমবায়ের যে নীতিমালা আছে, যে আইন আছে সেটার সংস্কার অবশ্যই করতে হবে। সংস্কার করে সরকারি আমলাদের দৃষ্টিকোণ থেকে যদি আমরা আইন প্রণয়ন করি তাহলে কিন্তু ফলদায়ক হবে না। সেজন্য আমাদের সুপারিশ থাকবে, আমরা যারা সমবায়ের মানুষ আছি, সিভিল সোসাইটি আছি, আমরা যারা সমবায়ের কথা ভাবি, চিন্তা করি তারা এর ড্রাফট বা নীতিমালা প্রণয়ন করে সরকারের হাতে যেন দিতে পারি।


ফজলুল হাদী সাব্বির
নির্বাহী পরিচালক
বেনিফিশিয়ারিজ ফ্রেন্ডশিপ ফোরাম, ফরিদপুর

বঙ্গবন্ধু দেশ গঠনের শুরুতেই দেশের তাঁতি, জেলে, কামার কুমারদের কথা ভেবেছেন। তাদের উন্নয়নের জন্য সমবায়ের কথা ভেবেছেন। তিনি তখনই ভেবেছিলেন জমির বিভাজনের কথা এবং বিভাজনের ভিত্তিতে সমবায়ের গুরুত্বের কথা। আমাদের এখানে সমবায়ের যে আইন সেখানে সমবায় শব্দটি ব্যবহার করতে গেলে নিবন্ধন লাগে। একই সঙ্গে যারা সমবায় করবেন তাদের অধিকারের জায়গা বা সংগঠনের জায়গা এতটা সীমিত যে তারা স্বাধীনভাবে তাদের স্থানীয় যে সম্পদ, স্থানীয় যে সুযোগ, তাদের যে চিন্তা-চেতনা প্রয়োজন, যে বিষয়গুলোকে নিয়ে তারা সমবায়ের ভিত্তিতে এগিয়ে যাবেন, খুব একটা স্বাচ্ছন্দ্যের সঙ্গে তারা করবেনসেই বিষয়টি আমরা আইনের মধ্যে দেখতে পাচ্ছি না। আশা করছি, আইনটি সংস্কার করে জনবান্ধব হবে, কৃষকবান্ধব হবে। আইনের সংস্কারের মাধ্যমে দেশের সাধারণ প্রান্তিক কৃষক, ক্ষুদ্র কৃষক, বর্গাচাষী একত্র হয়ে সমবায় আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সমবায়ের মূল সুযোগটি গ্রহণ করতে পারেন এবং বাংলাদেশের কৃষি অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে অবদান রাখতে পারেন।

 

মো. সায়েদুজ্জামান খোকন
নির্বাহী পরিচালক, গ্রাউস, মুক্তাগাছা, ময়মনসিংহ

কৃষক নিয়ে আমরা যে সমবায় গঠন করেছি সেখানে প্রথম জটিলতা হলো আইনগত। আরেকটা হলো কৃষিভিত্তিক যে কর্মকর্তারা আছেন তারা প্রকৃতপক্ষে কৃষকের দুঃখ-কষ্ট যতক্ষণ না বুঝবেন ততক্ষণ অগ্রগতি হবে না। আমরা যখন কোনো উদ্যোগ নিই তখন বিভিন্ন জায়গা থেকে বিভিন্ন বাধা আসে। তার পরও আমরা হাঁটি হাঁটি পা পা করে এগিয়ে যাচ্ছি। আমরা সমবায় গঠন করেছি সমবায় প্রতিষ্ঠার জন্য। আমরা বলতে চাই, একসময় এএলআরডি না থাকলেও আমরা আমাদের এলাকায় সমবায়গুলো এগিয়ে নিয়ে যেতে পারব। আমরা সমবায়ীদের জন্য একটা তহবিল গঠন করেছি। প্রায় ১২ লাখ টাকা আমাদের তহবিলে জমা হয়েছে। আগামী তিন মাসের মধ্যে সমবায়গুলো থেকে আমরা ১৮ লাখ টাকার সবজি বিক্রির একটা পরিকল্পনা করেছি। সরকারি বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা পেলে আমরা অবশ্যই সমবায় দলগুলোকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারব।


ফিরোজ আহমেদ
নির্বাহী পরিচালক
আলো, কুষ্টিয়া

আমার কর্ম এলাকায় বাস করে আদিবাসী জেলে সম্প্রদায়। তারা বিন্তি নামে পরিচিত। তাদের জাল আছে কিন্তু জলা নেই। এলাকায় সরকারি জলাধারগুলো লিজ দেয়া হয়। বিন্তিদের মত্স্যজীবী সমিতি থাকা সত্ত্বেও তারা সেটা পায় না। ভুট্টার সময়ে তাদের নারীরা ভুট্টা সংগ্রহ করে রাখে। পরে সেটার খই ভেজে তারা সারা বছর বিক্রি করে। দরিদ্র প্রান্তিক কৃষকের অধিকার সম্পর্কে বলতে চাই, আদিবাসীদের মধ্যে অনেক দরিদ্র কৃষক আছেন। সরকারি নির্দেশনা আছে তাদের সহজ শর্তে ঋণ দেয়ার কিন্তু তারা আদৌ সে সুযোগ পান না। সে ব্যাপারে কিছু করার থাকলে ভেবে দেখার অনুরোধ জানাই।

 

শামসুল হুদা
নির্বাহী পরিচালক
অ্যাসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্ম অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট
(এএলআরডি)

সমবায় আইনটাকে আমরা আমলাতান্ত্রিক একাধিপত্য প্রতিষ্ঠার একটা আইন করে রেখেছি এবং সেটা দিয়েই চালাচ্ছি। বলতে দ্বিধা নেই, দীর্ঘদিন একাধিপত্যের আইনটি প্রয়োগের মধ্য দিয়ে একটা কায়েমি স্বার্থ তৈরি হয়েছে, ধারাবাহিক কায়েমি স্বার্থ তৈরি হয়েছে। সেই কায়েমি স্বার্থ আইনের পরিবর্তনে শুধু যে বাধা দিচ্ছে তা- নয়, সেই আইনের কথা শুনতেও বাধা দিচ্ছে। আইনটাকে আমরা প্রথমেই এনেছি কারণে যে আইনটা খুবই মৌলিক একটি বিষয়। কারণ এটা আইডেন্টিটির বিষয়। পৃষ্ঠপোষকতা সমর্থন পেতে হলে আমার আইনি সমর্থন লাগবেই। আইনি সমর্থন না থাকলে ব্যাংকঋণ চাইতে পারছি না। এর অর্থ এই না যে আইনটা যেদিন পরিবর্তন হয়ে যাবে সেদিন থেকেই সর্বত্র সমবায় গড়ে উঠবে খুব দ্রুত এবং সফলতা পাবে। সমবায় একটি আন্দোলন। এটি দীর্ঘ ধারাবাহিক আন্দোলন। আন্দোলনে সমবায়ের স্পিডটা লাগবে। যৌথভাবে উদ্যোগ নেয়া, যৌথভাবে সফল হওয়া, সেটার সুফল পাওয়া, সেটা সামনের দিকে এগিয়ে নেয়া পরের প্রজন্মের কাছে তুলে ধরা ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। সমবায়কে এগিয়ে নেয়ার চিন্তা বাস্তবে রূপ দিতে গেলে একটা প্রক্রিয়া লাগবে। সেই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবেই আমরা আইনটাকে ধরে শুরু করতে পারি। ততদিন আমরা বসে থাকব না। বাংলাদেশ এমন একটা দেশ যেখানে বেশির ভাগ মানুষের জমি নেই। যেটুকু আছে সেটাকেও বণ্টন করলে কৃষকরা খুব অল্প পরিমাণে পাবে। অর্থনৈতিকভাবে এটাকে লাভজনক করতে হলে সমবায় ছাড়া কোনো পথ নেই। বহু ধরনের সমবায় আছে। সে সবকে আমরা অনুপ্রাণিত করব। কৃষিভিত্তিক দেশ হওয়ায় কৃষি সমবায় হবে সবচেয়ে বেশি জোরদার। তাছাড়া সব সমবায়ে আমরা মনোযোগ দেব। সমবায়ের মধ্যে আসল-নকল আছে। নকলগুলোকে বাঁচিয়ে রাখার জন্যই বিদ্যমান আইনটি সমর্থন দেয়। তা আমরা চাই না। দরিদ্র মানুষের সংখ্যা অনেক বেশি, করোনাকালে তাদের সংখ্যা বেড়েছে। থেকে উত্তরণে তাদের নিয়ে তাদের প্রচেষ্টাগুলোকে সমন্বিত করে এগোনো ছাড়া পথ নেই।

শ্রুতলিখন: শর্মিলা সিনড্রেলা

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন