গাজীপুরের এলিট কেয়ার হাসপাতাল

সিজারিয়ান নয়, সুনাম স্বাভাবিক প্রসবে

মো. হাজিনুর রহমান শাহীন, গাজীপুর

মাত্র বছর কয়েক আগেও গর্ভবতী নারীদের স্বাভাবিক সন্তান প্রসব ছিল খুবই সাধারণ ঘটনা। কিন্তু সময়ের বিবর্তন অস্ত্রোপচারে শিশু জন্মদানের প্রবণতায় অনেকটাই হারিয়ে যেতে বসেছিল তা। সমাজের অভিজাত শ্রেণীর মানুষেরও প্রসববেদনা ভীতির কারণে আগ্রহ অস্ত্রোপচারের প্রতি। আর এমন প্রবণতাকে পুঁজি করে দেশের বেসরকারি হাসপাতালগুলো অপ্রয়োজনীয় ক্ষেত্রেও ঝুঁকছে অস্ত্রোপচারের দিকে। তাতে ঝুঁকিতে পড়ছে মা শিশুর সুস্বাস্থ্য।

অবশ্য উল্টোচিত্র দেখা যায় গাজীপুর শহরের এলিট কেয়ার হাসপাতালে। প্রয়োজন ছাড়া সেখানে সিজারিয়ান অপারেশন বা অস্ত্রোপচারে শিশু জন্মদানের প্রবণতা কম। সম্পূর্ণ ব্যক্তি উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হাসপাতাল এখন পরিচিতি লাভ করেছে নরমাল ডেলিভারি বা স্বাভাবিক প্রসবের হাসপাতাল হিসেবে।

গাজীপুরের চান্দনা চৌরাস্তার সন্তানসম্ভবা সুমিকে গত ২৫ ডিসেম্বর হাসপাতালে ভর্তি করিয়েছিলেন তার স্বামী সোহাগ। কোনো অস্ত্রোপচার ছাড়াই সন্তান জন্ম নেয়ার একদিন পর ২৬ ডিসেম্বর সুস্থভাবেই হাসপাতাল ছেড়ে যান তিনি। সুমির মতো প্রতিদিনই দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সন্তানসম্ভবা মায়েরা ছুটে আসছেন হাসপাতালে, শুধু স্বাভাবিক প্রসবের মাধমে সন্তান জন্ম দেয়ার জন্য।

নেত্রকোনার খালিয়াজুড়ি উপজেলার কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা আমিনুল ইসলামের কথাই শোনা যাক। গত ১২ ডিসেম্বর ভোরে তার স্ত্রীর প্রসব বেদনা শুরু হয়। প্রথম থেকেই স্বাভাবিক সন্তান প্রসবে আগ্রহী ছিলেন তার স্ত্রীও। কিন্তু কোথাও আস্থা পাচ্ছিলেন না আমিনুল। পরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পরিচিত হওয়া ডা. নাফিসার সঙ্গে তাদের যোগাযোগ হয়। গাড়ি ভাড়া করে এত দূর থেকে এলিট হাসপাতালে স্ত্রীকে নিয়ে আসেন তিনি। সেখানেই চিকিৎসকদের নিবিড় পর্যবেক্ষণে নিরাপদভাবে সন্তানের জন্ম দেন তার স্ত্রী।

গাজীপুর পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক আশরাফ উদ্দিন বলেন, অন্যান্য চিকিৎসা কেন্দ্র যেখানে সিজারিয়ান অপারেশনের পরামর্শ দেয়, এখানে তা নেই। তারা স্বাভাবিক সন্তান প্রসবে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়।

হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, ২০২০ সালের ১৩ আগস্ট গাজীপুরের শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ রোডে এলিট কেয়ার হাসপাতালের যাত্রা শুরু। প্রথম দিন থেকেই এখানে নরমাল বা স্বাভাবিক প্রসবের জন্য রোগীদের উদ্বুদ্ধ করা হয়। প্রতিষ্ঠার পর থেকে গত দেড় বছরে এখানে তিন শতাধিক স্বাভাবিক প্রসব করানো হয়েছে। সে হিসেবে সন্তান জন্মদানের জন্য ভর্তি হওয়া ৬০ ভাগ নারীর স্বাভাবিক প্রসব করানো হয়েছে। মায়ের অবস্থা বা শিশুর অবস্থান জটিল থাকলেই কেবল এখানে অপারেশনের ব্যবস্থা নেয়া হয়। পাশাপাশি গাজীপুরের একমাত্র হাসপাতাল এটি, যেখানে রয়েছে ব্যথামুক্ত স্বাভাবিক প্রসব করানোর ব্যবস্থা।

এলিট কেয়ার হাসপাতালে মায়েদের নিরাপদ স্বাভাবিক সন্তান প্রসবের সেবা ইরই মধ্যেই সারা দেশে সাড়া জাগিয়েছে। অপ্রয়োজনীয় সিজারিয়ান অপারেশন রোধ নিরাপদ স্বাভাবিক সন্তান প্রসবের জন্য হাসপাতালে মায়েদের নিবিড় পর্যবেক্ষণ করা হয়। অসহায় রোগীদের বিনামূল্যে চিকিৎসার ব্যবস্থাও রয়েছে এখানে। সরকারি চাকরির দায়িত্ব পালন শেষে হাসপাতালে এমন কাজের নেতৃত্ব দিচ্ছেন গাইনি বিশেষজ্ঞ সার্জন ডা. নাফিসা আনোয়ার মারিয়ানা।

গাজীপুর মহানগরীর বোর্ড বাজার এলাকার বাসিন্দা সিরাজুল ইসলাম সজীব বহুতল ভবন ভাড়া নিয়ে ১০ শয্যার মা শিশুদের জন্য বিশেষায়িত চিকিৎসা কেন্দ্রটি গড়ে তোলেন। তার উদ্দেশ্য ছিল, গাজীপুরের কোনো মাকে যেন স্বাভাবিক সন্তান প্রসবের জন্য ঢাকায় নিতে না হয়। পরে আগতদের মুখে মুখেই দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ে এর সুনাম। কোনো প্রসূতি মা এখানে ভর্তির পর তাকে অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচারে নিরুৎসাহিত করে স্বাভাবিক প্রসবের জন্য কাউন্সেলিং করানো হয়। পরে প্রসূতি মাকে সন্তান প্রসবের আগে নিবিড় পর্যবেক্ষণ করা হয়। স্বাভাবিক সন্তান প্রসবের জন্য এখানকার সেবিকাদেরও বিশেষভাবে পারদর্শী করে গড়ে তোলা হয়েছে। চিকিৎসা কেন্দ্রে মায়েদের জন্য স্বাভাবিক প্রসব, ব্যথামুক্ত স্বাভাবিক প্রসব, সিজারিয়ান-পরবর্তী স্বাভাবিক প্রসবের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে, যা গাজীপুরে প্রথম।

হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সিরাজুল ইসলাম সজীব জানান, আমার পরিবারের একজন সদস্যের হাসপাতাল সম্পর্কে তিক্ত অভিজ্ঞতা রয়েছে। তার পরই সিদ্ধান্ত নিয়েছি হাসপাতাল গড়ে তোলার, যাতে মানুষকে প্রকৃত সেবা দিতে পারি। একজন মা সুস্থ সন্তান নিয়ে যাতে আনন্দের সঙ্গে প্রথম দিনেই বাড়ি ফিরে যেতে পারেন, সেজন্যই আমরা স্বাভাবিক সন্তান প্রসবের দিকে নজর দিয়েছি।

তিনি জানান, প্রথম প্রথম আমরা বিভিন্ন প্রসূতি স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞদের নিয়ে আসতাম চিকিৎসা দেয়ার জন্য। দেখলাম সবার ঝোঁক সিজারিয়ানের দিকে। পরে আমাদের সর্বোচ্চ সমর্থন দিয়েছেন ডা. নাফিসা। আমাদের মূল প্রচেষ্টা অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচার বন্ধ করা। একজন মাকে নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতার হাত থেকে বাঁচানো। আমরা যেসব মেশিনারিজ সেটআপ করেছি, তা গাজীপুরের কোনো বেসরকারি হাসপাতালে নেই। ভবিষ্যতে হাসপাতালটির পরিসর বড় করার পরিকল্পনা রয়েছে তরুণ উদ্যোক্তার।

গাইনি বিশেষজ্ঞ ডা. নাফিসা আনোয়ার মারিয়ানা বলেন, সঠিক চিকিৎসা, তত্ত্বাবধান, বিশ্বাস আস্থার মাধ্যমে অধিকাংশ প্রসূতি স্বাভাবিক সন্তান জন্ম দিতে পারেন। বিষয়টি প্রসূতি তাদের পরিবারকে বুঝিয়ে রাজি করাতে হয় আমাদের। এছাড়া সিজারিয়ানের নানা কুফল রয়েছে তাও তাদের অবহিত করা হয়। এভাবেই সবাইকে নিরাপদ স্বাভাবিক সন্তান প্রসবের দিকে এগিয়ে আনতে হচ্ছে। এক্ষেত্রে সচেতনতার কোনো বিকল্প নেই। আমাদের মূল স্লোগানই হচ্ছে অপ্রয়োজনীয় সিজারিয়ান অপারেশনকে না বলুন, স্বাভাবিক প্রসবকে উৎসাহিত করুন।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন