গুলশান-ধানমন্ডির দখল হওয়া সরকারি জমি উদ্ধারে সংসদীয় কমিটির সুপারিশ

দখলদার উচ্ছেদে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হোক

সরকারি জমি জাতীয় সম্পদ। সম্পদ দেশের উন্নয়ন অগ্রগতিতে ব্যবহার করা দুরূহ কোনো বিষয় নয়। তবে এক্ষেত্রে সরকারের সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা এবং সবকিছুর ঊর্ধ্বে উঠে কাজ করার মানসিকতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। স্বাধীনতা অর্জনের ৫০ বছরেও সরকারি জমির পূর্ণাঙ্গ কোনো তালিকা তৈরি করা হয়নি। দেশের বিভিন্ন স্থানের মতো রাজধানী ঢাকায়ও বিপুল পরিমাণ সরকারি জমি প্রভাবশালীদের দখলে রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে ধানমন্ডি গুলশান এলাকায় দখলে থাকা জমি উদ্ধার করে সেখানে বহুতল ভবন নির্মাণের সুপারিশ করেছে গৃহায়ন গণপূর্ত মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। সুপারিশ বাস্তবায়নে আন্তঃমন্ত্রণালয়ের সমন্বয় খুবই জরুরি। প্রথমেই বেদখল হওয়া জমি চিহ্নিত করতে হবে। পরবর্তী সময়ে পরিকল্পিত উচ্ছেদ অভিযান চালাতে হবে। 

দেশে সরকারি, ব্যক্তিমালিকানাধীন, খাস, অর্পিত সম্পত্তি, পরিত্যক্ত সম্পত্তি এবং বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন অধিদপ্তর, পরিদপ্তর দপ্তরের মালিকানায় জমি রয়েছে। কিন্তু কোন মন্ত্রণালয়ের অধীনে কী পরিমাণ কোন শ্রেণীর সরকারি সম্পদ রয়েছে, তার কোনো পরিসংখ্যান সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়েই পাওয়া যায় না। ভূমি ব্যবস্থাপনায় ভূমি মন্ত্রণালয়, গৃহায়ন গণপূর্ত মন্ত্রণালয়, ভূমি আপিল বোর্ড, ভূমি সংস্কার বোর্ড, রাজউক, ভূমি রেকর্ড জরিপ অধিদপ্তর এবং জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের মধ্যে নেই কোনো সমন্বয়। সরকারি স্থাপনা নির্মাণ কিংবা অন্য কোনো উদ্দেশ্যে অধিগ্রহণ করা সরকারি সম্পত্তিগুলোও রক্ষণাবেক্ষণের কোনো ব্যবস্থা করা হয়নি। ফলে সরকারি সম্পত্তি চলে যাচ্ছে জবরদখলকারীদের নিয়ন্ত্রণে। আবার সেই সম্পত্তি উদ্ধারের জন্য সরকার পক্ষ আদালতে মামলা করছে। সরকারি সম্পত্তি বেহাত হওয়ার পর সেই সম্পত্তি উদ্ধারে মামলা করা হলেও যেসব কর্মকর্তা-কর্মচারীর দায়িত্বহীন আচরণে সরকারি সম্পত্তি বেহাত হয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। গুলশান, ধানমন্ডির মতো এলাকায় রাজনৈতিক আর্থিকভাবে প্রভাবশালীরাই সরকারি জমি দখল করে রেখেছেন। মাঝে এসব জমি উদ্ধারে উদ্যোগ নেয়া হলেও অর্থ লোকবলস্বল্পতার পাশাপাশি প্রভাবশালীদের চাপে খুব বেশি দূর এগোনো যায়নি। এবার যেহেতু সংসদীয় স্থায়ী কমিটি সরকারি জমি উদ্ধারের সুপারিশ করেছে, সেহেতু কিছু পদক্ষেপ জনগণ প্রত্যাশা করে। তবে এক্ষেত্রে আশা খুবই ক্ষীণ। এর আগে দেশের উচ্চ আদালত বেদখলে থাকা সরকারি জমি সম্পত্তি উদ্ধারে বিভিন্ন দিকনির্দেশনা দিয়েছিলেন, এমনকি রুলও জারি করেছেন। কিন্তু তাতে কোনো কাজই হয়নি। কিছু ছোট দোকানপাট উচ্ছেদ হলেও প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার বড় কোনো দৃষ্টান্ত নেই। গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে দেখা যায়, গুলশান-বনানী ধানমন্ডির মতো এলাকায় সরকারি জমি বিভিন্ন কোম্পানি ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী অনেক নেতার দখলে রয়েছে। সংসদীয় কমিটির সুপারিশে তাদের উচ্ছেদ করা সহজ হবে না। এক্ষেত্রে জাতীয় ঐকমত্য আন্তঃমন্ত্রণালয়ের সমন্বয় বাড়াতে হবে। সরকারি বিভিন্ন জমি বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকায় এককভাবে দখল উচ্ছেদ করা কঠিন হয়ে পড়ে। সেক্ষেত্রে যৌথ কমিটি গঠনের মাধ্যমে দখলকৃত জমি উদ্ধার করার বিষয়টি বিবেচনা করা যেতে পারে।

সরকারি জমি সম্পত্তি অবৈধ দখল নিয়ে ভারতেও ব্যাপক বিতর্ক রয়েছে। দেশটির কয়েকটি রাজ্য কেন্দ্রীয় সরকার এরই মধ্যে অবৈধ দখলে থাকা সরকারি জমি চিহ্নিত উদ্ধারে সাফল্য দেখিয়েছে। এক্ষেত্রে দেশটির আদালত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন বিভিন্ন সময়ে। বাংলাদেশের উচ্চ আদালত বিভিন্ন সময় দিকনির্দেশনা দিলেও সেগুলো বাস্তবায়নে প্রশাসনের সক্রিয়তা দেখা যায়নি। সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়নে এমন উদাসীনতা দেখানো হবে না বলে প্রত্যাশা। এক্ষেত্রে ভূমি মন্ত্রণালয়, গৃহায়ন গণপূর্ত মন্ত্রণালয়, রাজউকসহ সংশ্লিষ্ট সবার উদ্যোগে কমিটি গঠনের মাধ্যমে কাজটি সুচারুভাবে করতে হবে। এক্ষেত্রে কেউ যেন অযথা হয়রানির শিকার না হন, তাও নিশ্চিত করতে হবে। অনেক সময় অভিযোগ করা হয়, পর্যাপ্ত অর্থ, জনবল আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তা না পাওয়ায় অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ করা যায় না। এক্ষেত্রে সব ধরনের সহায়তা রাষ্ট্রকে নিশ্চিত করতে হবে। অনেক সময় স্থানীয়দের প্রতিরোধের মুখে উচ্ছেদ অভিযান পরিত্যাগ করতে হয়। জনসচেতনতা বৃদ্ধি উচ্ছেদ অভিযানে বাধাদানকারীদেরও আইনের আওতায় আনতে হবে। উচ্ছেদ অভিযান কেস টু কেস ভিত্তিতে হতে পারে। কেউ যদি সরকারি জমি উৎপাদনশীল কাজে ব্যবহার করে, যেমন কারখানা বা মার্কেট, তবে তাকে আইনের মাধ্যমে বৈধ প্রক্রিয়ায় ইজারা দেয়া যায় কিনা, তাও খতিয়ে দেখা উচিত। 

ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে যেসব পরিত্যক্ত জমি বেদখলে রয়েছে, তার বেশির ভাগই বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের দখলে। অবৈধভাবে সরকারি ক্ষমতার প্রভাব খাটানোর মধ্যেমে হাতিয়ে নেয়া হয়েছে মূল্যবান এসব জমি। যেহেতু কমবেশি সব বড় রাজনৈতিক দলের লোকেরাই এসব দখলবাজির সঙ্গে জড়িত, সে কারণে বেহাত হওয়া সম্পত্তি পুনরুদ্ধারে কার্যকর সমন্বিত পদক্ষেপ নিতে হবে। আইনে রয়েছে, কোনো ব্যক্তি সরকারি বা স্থানীয় কর্তৃপক্ষের ভূমি বা স্থাপনা অবৈধভাবে দখল করলে জেলা প্রশাসক, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ওই ব্যক্তির বিরুদ্ধে থানায় মামলা করতে পারবেন। মামলায় অভিযুক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে অপরাধ প্রমাণ হলে তিনি দুই বছরের কারাদণ্ডে বা সর্বোচ্চ লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। মামলার বিচারকাজ ফৌজদারি কার্যবিধি অনুযায়ী পরিচালিত হবে এবং মামলা মোবাইল কোর্টে পরিচালনা নিষ্পত্তি করা যাবে। কোনো ব্যক্তি সরকারি ভূমি বা স্থাপনা ইজারা নিয়ে থাকলে মেয়াদ শেষ হওয়ার পর ভূমি বা স্থাপনার দখল ছেড়ে দিতে হবে। অন্যথায় জেলা প্রশাসক দখলকারীকে ৩০ দিনের মধ্যে দখল ছেড়ে দেয়ার জন্য নোটিস দেবেন। অবস্থায় দখল না ছাড়লে জেলা প্রশাসক স্থাপনা বা ভূমি থেকে অবৈধ দখলদারকে উচ্ছেদ করতে পারবেন। কোনো ব্যক্তি অবৈধভাবে সরকারি জমি বা স্থাপনা দখল করলেও একই পদ্ধতিতে দখলদারকে উচ্ছেদ করা যাবে। কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হলো, আইনের প্রয়োগ খুব একটা দেখা যায় না।

সরকারি জমি উদ্ধারে বিভিন্ন সময়ে বিচ্ছিন্ন কিছু পদক্ষেপ নেয়া হলেও দেশব্যাপী সমন্বিত কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। বিশেষত রাজধানীর গুলশান-ধানমন্ডির মতো এলাকায় সরকারি জমি উদ্ধারে তেমন সক্রিয়তা চোখে পড়ে না। খাল উদ্ধারে কিছু বাড়ি স্থাপনা ভাঙা হলেও সরকারি জমি দখলে নিয়ে বড় বড় স্থাপনা বা মার্কেট নির্মাণ করা হলেও সেগুলো অপসারণে কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। এমনও অভিযোগ রয়েছে সরকারের কাছ থেকে জমি ইজারা নিলেও তার দখল বুঝে পাননি অনেকে। কারণ এসব জমি প্রভাবশালীরা ভোগদখল করছেন। এক্ষেত্রে সরকারি জমি উদ্ধারে দ্রুত অভিযান পরিচালনা করা প্রয়োজন। একই সঙ্গে উদ্ধারকৃত এসব জমি সম্পত্তি কী কাজে ব্যবহার করা হবে, তারও পরিকল্পনা থাকা আবশ্যক। কেননা সরকারের দখলে নেয়া জমি আবার বেদখল হয়ে যাওয়ার উদাহরণও রয়েছে। সর্বাগ্রে প্রয়োজন গুলশান, বনানী ধানমন্ডিতে সরকারি জমি চিহ্নিত এবং কার কার অবৈধ দখলে সেগুলো রয়েছে তা নির্দিষ্ট করা। জমি উদ্ধার করলেই হবে না, দখলদারদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক আইনি ব্যবস্থাও নিতে হবে, যাতে সরকারি জমি অবৈধভাবে দখল নিরুৎসাহিত হয়। একই সঙ্গে উদ্ধারকৃত জমি উৎপাদনশীল খাতে ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন