লকডাউন আর না দেয়ার আহ্বান এফবিসিসিআইয়ের

ক্ষুদ্র-মাঝারি উদ্যোক্তা ও দরিদ্রদের জন্য হবে বিপর্যয়কর

ওমিক্রনের দাপটে দেশে সংক্রমণ প্রবণতা এখন আবারো ঊর্ধ্বমুখী। দিন দিন বাড়ছে শনাক্ত রোগীর সংখ্যা। গত এক সপ্তাহে ১৭০ শতাংশ সংক্রমণ বেড়েছে বলে খবর মিলছে। সংক্রমণের বিস্তার প্রতিরোধে সরকার এরই মধ্যে কিছু বিধিনিষেধ জারি করেছে। আবারো লকডাউন দেয়া হবে কিনা, তা নিয়ে সর্বসাধারণের  মধ্যে বিরাজ করছে শঙ্কা। অবস্থায় ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই লকডাউন না দেয়ার আহ্বান জানিয়েছে। বরং এর বদলে সচেতনতা বাড়ানো স্বাস্থ্যবিধি পরিপালনের কথা বলছেন তারা। ব্যবসা-বাণিজ্যসহ দেশের সার্বিক অর্থনীতি অতিমারীর অভিঘাত কাটিয়ে উঠছে, ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। পুনরুদ্ধারকালে আবার যদি লকডাউন দেয়া হয়, বিশেষ করে ক্ষুদ্র-মাঝারি উদ্যোক্তা দরিদ্র শ্রমজীবী মানুষের জন্য তা হবে চরম বিপর্যয়কর।   

বিদায়ী বছরের শেষের দিকে দেশে সংক্রমণ পরিস্থিতি - শতাংশের কাছাকাছি নেমে এসেছিল। নতুন বছরের শুরু থেকে সংক্রমণ আবার বাড়তে শুরু করেছে। এর পেছনে বেশকিছু কারণ দায়ী। গণপরিবহনে গাদাগাদি করে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যাতায়াত করছে মানুষ। অফিস-শিল্পকারখানা-শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান-স্বাস্থ্যকেন্দ্র সবখানে যাচ্ছে। ভিড় ঠেলে বাজারসদাই করছে। যাচ্ছে জনসমাগমে, অংশ নিচ্ছে সমাবেশ-সেমিনারে। বিয়েসহ সামাজিক অনুষ্ঠানে পরস্পরের সঙ্গে মিলিত হচ্ছে। সবকিছু অনেকটা স্বাভাবিক ধরে নিয়েই আচরণ করছে আগের মতো। ন্যূনতম শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখছে না। সাবান-পানি দিয়ে নিয়মিত হাত ধোয়ার অভ্যাসে এনেছে শিথিলতা। অনেকেই মাস্ক পরছে না। যারা পরছে তাদের মধ্যেও এক ধরনের দায়সারার প্রবণতা দৃশ্যমান। বলতে গেলে স্বাস্থ্যবিধি পরিপালনে বর্তমানে আমাদের মধ্যে বিরাজ করছে চরম শিথিলতা। সব মিলিয়ে ফের বাড়ছে সংক্রমণ।

শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বজুড়েই সংক্রমণের হার বর্তমানে উদ্বেগজনক ভাবে বেড়ে চলছে। প্রেক্ষাপটে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, ফ্রান্স, ইতালিসহ প্রতিটি দেশের সরকারই বেশ তত্পর হয়ে উঠেছে। তারা স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলায় জনগণকে উদ্বুদ্ধ করছে। জনসমাবেশ সীমিত করছে। আমরা দেখেছি কিছু দেশ গত বড়দিনে সমবেত প্রার্থনা বাদ দিয়েছে, অনেকটা ঘরোয়াভাবে পালন করেছে। কেবল তা- নয়, লন্ডন, প্যারিস, বার্লিনসহ ইউরোপের বিভিন্ন শহরের নগর কর্তৃপক্ষ এবার নববর্ষ উদযাপনও বাতিল করেছে। ধরনের নিবৃত্তিমূলক পদক্ষেপের পাশাপাশি দেশগুলো বিশেষ করে বয়োবৃদ্ধ জনগোষ্ঠীকে বুস্টার ডোজ দিচ্ছে। কিন্তু অর্থনীতির ক্ষত মানুষের ক্ষতি বিবেচনায় এবার দেশব্যাপী লকডাউন আরোপ করছে না তারা। বড়জোর এলাকাভিত্তিক কড়াকড়ি আরোপ করছে। দেশগুলোর গৃহীত পদক্ষেপ অভিজ্ঞতা আমাদের জন্যও অনুসরণীয়।

গতবার আমরা দেশের মানুষের জীবন-জীবিকা অর্থনীতিতে লকডাউনের গভীরতর নেতিবাচক প্রভাব প্রত্যক্ষ করেছিলাম। ব্যবসা-বাণিজ্য অনেকটা রুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। পোশাক কারখানাগুলোর জন্য ক্রয়াদেশ মেটানো হয়ে পড়েছিল কষ্টসাধ্য। উল্লেখযোগ্য মাত্রায় রফতানি কমে এসেছিল। ক্ষুদ্র অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। কিছু সাময়িক আর কিছু একেবারে বন্ধ হয়েছিল। পুঁজি হারিয়ে ক্ষুদ্র-মাঝারি অনেক উদ্যোক্তাই নিঃস্ব হয়েছিল। অনেক মানুষ কাজ হারিয়েছিল। বন্ধ হয়ে গিয়েছিল আয়-রোজগারের ব্যবস্থা। নিম্ন আয়ের পরিবারগুলোর দিশেহারা অবস্থা। অর্থ নেই, খাবার নেই, চারদিকে আহাজারি। নতুন করে অনেক মানুষ আবার হয়ে পড়েছিল দরিদ্র। সরকার বিভিন্নভাবে সহায়তা দিলেও তা দরিদ্র জনগোষ্ঠীর চাহিদা অনুপাতে ছিল অপর্যাপ্ত। তার মধ্যে অনিয়মের কারণে সেটিও যথাযথভাবে পৌঁছেনি সুফলভোগীদের কাছে। অতীতের অভিজ্ঞতায় এফবিসিসিআই যে আর লকডাউন আরোপ না করার দাবি জানিয়েছে তা সময়োচিত। নীতিনির্ধারকদের এটা বিবেচনায় রাখা চাই। 

আমরা দেখছি দেশের অর্থনীতি ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। রফতানি বাড়ছে। রফতানি খাতে প্রচুর ক্রয়াদেশ আসছে। শিল্প-কারখানা পুরোদমে চলছে। শ্রমজীবী মানুষগুলো নতুন উদ্যমে টিকে থাকার লড়াই করছে। কাজ করছে, আয়-রোজগার করছে। পরিবারের জীবিকা নির্বাহ করছে। অবস্থায় লকডাউন দিলে সেটি হবে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘার মতো। বরং জোর দিতে হবে স্বাস্থ্যবিধি পরিপালনের ওপর। দেখা যাচ্ছে অনেক মানুষ মাস্ক পরছে না। শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখছে না। অনেক ক্ষেত্রে অহেতুক ভিড় করছে। যারা স্বাস্থ্যবিধি মানছে না, তাদের প্রথমে সতর্ক করতে হবে। প্রয়োজনে দিতে হবে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি। একই সঙ্গে জনসচেতনতা বাড়াতে নিতে হবে কর্মসূচি। পাশাপাশি ব্যক্তিগত পর্যায় থেকেও আমাদের করণীয় আছে ঢের। আমাদের সবাইকে বুঝতে হবে যে কারো স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা যেমন অন্যদের করোনার সংক্রমণ থেকে রক্ষা করবে আবার কেউ বিধি লঙ্ঘন করলে সমূহ সর্বনাশ হতে পারে। সুতরাং ব্যক্তিগত পর্যায় থেকে আমাদের আরো দায়িত্বশীল আচরণ করতে হবে। ইতিবাচক বিষয় হলো, সরকার টিকাদান কর্মসূচি জোরদার করেছে। বয়স্ক জনগোষ্ঠীকে বুস্টার ডোজও দেয়া হচ্ছে। যারা এখনো টিকার আওতায় আসেনি, তাদের দ্রুত টিকাকরণ নিশ্চিত করতে হবে। এটা বিরাট চ্যালেঞ্জের। আমাদের এনজিওগুলোর ধরনের কর্মযজ্ঞের বিপুল অভিজ্ঞতা আছে। এক্ষেত্রে তাদের সক্ষমতা কাজে লাগানো যেতে পারে। 

টিকা যুগে লকডাউনের যৌক্তিকতা নেই। সংগত কারণে সব দেশই অর্থনীতি সচল রেখে স্বাস্থ্যবিধি মানা টিকা দেয়ার ওপর জোর দিচ্ছে। সেদিক থেকে এফবিসিসিআই লকডাউন না দেয়ার যে আহ্বান জানিয়েছে তা যুক্তিসংগত বাস্তবসম্মত। এটা আমলে নিয়ে আমাদেরও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা টিকার ওপর বেশি নজর দিতে হবে। এরই মধ্যে কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করেছে সরকার। উন্মুক্ত স্থানে সব ধরনের সামাজিক, রাজনৈতিক ধর্মীয় অনুষ্ঠান কিংবা সভা-সমাবেশ বন্ধ রাখতে বলা হয়েছে। ট্রেন, বাস লঞ্চে সক্ষমতার অর্ধেক যাত্রী নেয়া যাবে। রেস্তোরাঁয় বসে খেতে, আবাসিক হোটেলে থাকতে দেখাতে হবে টিকা সনদ। ১২ বছরের বেশি বয়সের শিক্ষার্থীদের টিকা সনদ ছাড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যেতে নিষেধ করা হয়েছে। এগুলো ইতিবাচক। সরকারের নজরদারি ব্যক্তিগত সচেতনতায় আমরা ওমিক্রন মোকাবেলায়ও ভালোভাবে সমর্থ হব, এটিই প্রত্যাশা।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন