করোনার বন্ধে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডির রেকর্ড

শুধু সংখ্যাগত উল্লম্ফন নয়, গবেষণার মানও বাড়ুক

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাথমিক লক্ষ্য গবেষণা করা। গবেষণার মাধ্যমে নতুন জ্ঞান সৃজন, নতুন কিছু উদ্ভাবন তা বিতরণ করা। জ্ঞান-বিজ্ঞানে জাতিকে উচ্চশিখরে নিয়ে যাওয়া, পথ দেখানো। অথচ দেশের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ই সেই লক্ষ্য পূরণ করতে পারছে না। আইনে বাধ্যবাধকতা থাকলেও দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো গবেষণায় এখনো বেশ পিছিয়ে, যা উচ্চশিক্ষার বৈশ্বিক র্যাংকিংয়ে আমাদের নাজুক অবস্থানের একটা বড় কারণ। তবে করোনা অতিমারীর মধ্যে গবেষণায় কিছুটা উল্লম্ফন ঘটেছে। করোনার বন্ধে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পিএইচডি ডিগ্রি দেয়ার হার বাড়ার খবর মিলছে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের (ইউজিসি) তথ্য বলছে, ২০২০ সালে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে পিএইচডি ডিগ্রি পেয়েছেন ৬৪১ জন, যা স্মরণকালের সর্বোচ্চ। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সংখ্যায় বাড়লেও গবেষণার মান বেশ প্রশ্নবিদ্ধ। কাজেই শুধু সংখ্যাগত উল্লম্ফন নয়, মান বাড়াতেও কার্যকর পদক্ষেপ জরুরি।

গত দুই দশকে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক নতুন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদন দিয়েছে। ইউজিসির তথ্যানুযায়ী দেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা এখন ৫০। বেড়ে চলা জনসংখ্যার উচ্চশিক্ষার চাহিদা মেটানোর জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বৃদ্ধি ইতিবাচক বটে, কিন্তু তার সঙ্গে সংগতি রেখে সেখানে বাড়ছে না গবেষণার মান। এর পেছনে কিছু কারণ বিদ্যমান। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অবকাঠামোগত উন্নয়ন খাতে বেশি ব্যয় করতে আগ্রহী। তার তুলনায় গবেষণা খাত অনেকটা মনোযোগহীন। পর্যালোচনায় দেখা যাচ্ছে, মোট বাজেটের মাত্র শতাংশের মতো গবেষণায় ব্যয় করছে না উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো। আবার যা বরাদ্দ দেয়া হয়, তাও যথাযথভাবে ব্যয় হয় না। সঠিক খাতে যায় না, এতে হয় নানা অনিয়মও। সম্প্রতি সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা খাতে বরাদ্দকৃত অর্থের বড় অংশই ব্যয় হয়নি, এটা হতাশাজনক। এখানে প্রাতিষ্ঠানিক কিছু দুর্বলতাও রয়ে গেছে। অনেক ক্ষেত্রে রাজনৈতিক বিবেচনায় শিক্ষক নিয়োগ হচ্ছে, মেধা-যোগ্যতার মূল্যায়ন নেই। অনেক সময় পদোন্নতির ক্ষেত্রেও গবেষণা তেমন প্রয়োজন হয় না। নামমাত্র কোনো প্রকাশনা হলেই চলে। সর্বোপরি, উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গবেষণার একটা সহায়ক পরিবেশ, সংস্কৃতি গড়ে ওঠেনি। সব মিলিয়ে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো গবেষণায় পিছিয়ে।

আমরা দেখছি, কিউএস, সাংহাই, স্কপাস টাইমস প্রভৃতি স্বীকৃত বৈশ্বিক র্যাংকিংয়ে ইউরোপীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সঙ্গে এগিয়ে যাচ্ছে এশিয়ার অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ও। বিশেষ করে সিঙ্গাপুর, হংকং, দক্ষিণ কোরিয়া, চীন, জাপান, মালয়েশিয়া তাইওয়ানের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ধারাবাহিকভাবে ভালো করছে। খুব একটা পিছিয়ে নেই ভারতও। দেশটির কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ও বৈশ্বিক ক্রমের উপরের দিকে থাকছে। উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রে তাদের সাফল্য সম্ভব হয়েছে মৌলিক গবেষণায় অবদানের জন্য। শিক্ষক-শিক্ষার্থী নির্বিশেষে একটা প্রতিযোগিতামূলক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে নিজস্ব ডিসিপ্লিনে বিচিত্রমুখী গবেষণা করছে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক জার্নালে সেগুলো নিয়মিত প্রকাশ করছে। একে অন্যের সঙ্গে খোলামনে জ্ঞান বিনিময় করছে। কর্তৃপক্ষও নতুন গবেষণায় নিরন্তর উৎসাহ দিচ্ছে। গবেষণায় জোগানো হচ্ছে পর্যাপ্ত অর্থ। সেগুলো যথাযথ ব্যয় হচ্ছে কিনা, কাজে লাগছে কিনা তা নিয়মিত তদারকি হচ্ছে। সর্বোপরি গড়ে তোলা হয়েছে গবেষণার সংস্কৃতি। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ক্রমেই উচ্চশিক্ষা গবেষণার মানে এগিয়ে যাচ্ছে। তাদের পরিচালন পদ্ধতি, কর্মপ্রক্রিয়া আমাদের জন্য শিক্ষণীয়।

বলা হচ্ছে, সাম্প্রতিক সময়ে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি প্রদানের হার বেড়েছে। এটাকে বেশ একটা ইতিবাচক প্রবণতা হিসেবে তুলে ধরা হচ্ছে। তবে বাস্তবে প্রকৃত অবস্থা বরং কিছুটা ভিন্নতর। তথ্য বলছে, সম্প্রতি পিএইচডি ডিগ্রি অজর্নকারীদের বড় অংশই নন-একাডেমিক পেশাজীবী। বিশেষ করে আমলা, পুলিশ সামরিক কর্মকর্তাদের মধ্যে উচ্চতর ডিগ্রি নেয়ার ঝোঁক বেড়েছে। এটা মূলত সামাজিক মর্যাদা, পদোন্নতির জন্য। এর সঙ্গে জ্ঞানগত উত্কর্ষের কোনো সংযোগ নেই। কাজেই এর মধ্য দিয়ে যে গবেষণায় ব্যাপক উন্নয়ন ঘটেছে, সেটি দাবি করার সুযোগ নেই।

একাডেমিক জগতে নতুন জ্ঞান উন্মেষে পিএইচডির মতো গবেষণা কার্যক্রম একটা ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। বিশ্বব্যাপী শিক্ষক গবেষকরা পেশাগত উত্কর্ষের জন্যই পিএইচডি গবেষণা শুরু করেন। কাজের স্বীকৃতি হিসেবে তাদের ডিগ্রি দেয়া হয়। কঠোর পরিশ্রম অধ্যবসায়ের মধ্য দিয়ে ডিগ্রি লাভ করেন তারা। এর প্রভাবও থাকে বিপুল। পিএইচডি গবেষণার নিবন্ধ মানসম্মত পিআর রিভিউড ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টর জার্নালে প্রকাশ হলে ওই গবেষণা ফলাফলের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি মেলে সাইটেশন হয়। এতে এর সাফল্য প্রভাব অনেকটা দৃশ্যমান হয়। দুঃখজনকভাবে আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে দেয়া পিএইচডি ডিগ্রির গবেষণা নিবন্ধের শতাংশও আন্তর্জাতিক মানসম্মত জার্নালে প্রকাশ হয় বলে খবর মিলছে। এটি গবেষণার মানে দৈন্যের বিষয়টিই তুলে ধরে। কাজেই সংখ্যা নয়, মানেও নজর দেয়ার সময় এসেছে এখন।

উচ্চশিক্ষার বিশ্বায়ন ঘটেছে। তাই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যকার প্রতিযোগিতা এখন বৈশ্বিক। আর প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা সম্ভব কেবল মানসম্মত গবেষণা দিয়ে, জ্ঞানগত প্রভাব দিয়ে। কাজেই সেভাবেই দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে গড়ে তুলতে হবে। ভারত ২০টি বিশ্ববিদ্যালয়কে বিশ্বমানে উন্নীতের ঘোষণা দিয়েছে। এমনকি নাইজেরিয়ার মতো দারিদ্র্যপীড়িত দেশও অদূর ভবিষ্যতে অন্তত দুটি বিশ্ববিদ্যালয়কে বিশ্বের শীর্ষ ২০০টির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করার লক্ষ্য নিয়েছে। আমাদেরও ধরনের লক্ষ্য নির্ধারণ এখন সময়ের দাবি। দেশে এখনো উচ্চশিক্ষায় বরাদ্দ প্রতিযোগী দেশগুলোর চেয়ে কম। এর মধ্যেও বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ব্যয় করছে অবকাঠামোয়। গবেষণায় ব্যয় করছে যৎসামান্য। খাতে বিনিয়োগ আরো বাড়াতে হবে। বরাদ্দকৃত অর্থ যথাযথভাবে ব্যয় হচ্ছে কিনা, ঠিক গবেষকের কাছে যাচ্ছে কিনা, সেটি নিশ্চিত করতে হবে। সর্বোপরি দেশে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোয় বিনির্মাণ করতে হবে একটি গবেষণাবান্ধব পরিবেশ। সরকারসহ সব পক্ষের সম্মিলিত প্রয়াসে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো জ্ঞান-বিজ্ঞানে, গবেষণায় উত্তরোত্তর এগিয়ে যাবে বলে প্রত্যাশা।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন