গত
৩ নভেম্বর
বিদ্যুৎ, জ্বালানি
ও খনিজ
সম্পদ মন্ত্রণালয়ের
জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির
ঘোষণা একটি
দুঃসময়ে এসেছে।
ঠিক যখন
অর্থনীতি স্বাভাবিক
হচ্ছে, মানুষ
ধীরে ধীরে
কিছুটা স্বস্তির
নিঃশ্বাস ফেলতে
শুরু করেছে,
কাজে ফিরতে
শুরু করেছে
এবং করোনাসৃষ্ট
অর্থনৈতিক চাপ
থেকে বের
হতে প্রাণপণে
লড়ছে, তখন
জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি
তাদের বাড়তি
চ্যালেঞ্জের মুখে
ফেলে দিয়েছে।
সবচেয়ে দুঃখের
বিষয় হলো,
এটি প্রকৃতিসৃষ্ট
চ্যালেঞ্জ নয়,
এটি মানবসৃষ্ট।
এরই মধ্যে
প্রায় তিন
মাস ধরে
খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি
ক্রমে বেড়ে
চলেছে। সাম্প্রতিক
সময়ে নিত্যপণ্যের
দামও বেড়েছে।
এর মধ্যে
২৩ শতাংশের
মতো ডিজেল
ও কেরোসিনের
মূল্যবৃদ্ধি অসহায়
ভোক্তার ওপর
দ্বিগুণ খড়্গ
হিসেবে আবির্ভূত
হয়েছে, যারা
সব দিক
থেকেই ক্ষতিগ্রস্ত।
দেশে যখনই
জ্বালানি পণ্যের
মূল্য বাড়ানো
হয়, সবসময়
সরকার মানুষের
কাছে অনেক
কারণ ও
যুক্তি তুলে
ধরে। সেগুলো
খুব পরিচিত
যুক্তি এবং
প্রায় সবারই
জানা। প্রকৃত
বিষয় হলো,
উচ্চমূল্যের চূড়ান্ত
ভার ভোক্তাদের
চাপিয়ে দেয়া
একটি বহুল
প্রচলিত কৌশল।
কেন তাহলে
নীতিনির্ধারকরা এ
ধরনের পদক্ষেপ
নেন? কোথায়
প্রকৃত সমস্যা
লুকিয়ে রয়েছে
তা বোঝার
জন্য যুক্তিগুলো
তলিয়ে দেখা
যেতে পারে।
বিশ্বব্যাপী অর্থনীতিগুলোর
দ্রুত ঘুরে
দাঁড়ানোর চেষ্টার
কারণে জ্বালানির
আন্তর্জাতিক দামে
ঊর্ধ্বমুখী চাপ
দেখা দিয়েছিল।
বস্তুত, ২০১৬
সালের এপ্রিলে
পেট্রোলিয়ামের মূল্য
ব্যারেলপ্রতি ৪২
দশমিক ৩
ডলার ছিল।
এটি বেড়ে
২০২১ সালের
অক্টোবরে ব্যারেলপ্রতি
৮৩ দশমিক
৭ ডলারে
পৌঁছে। কভিড
থেকে উত্তরণ
পর্যায়ে যেহেতু
অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড
বেড়েছে এবং
তার সঙ্গে
উচ্চ ভোক্তা
চাহিদা বাড়ছে,
সেহেতু বাজারে
সরবরাহের ঘাটতি
রয়েছে। এভাবে
উচ্চ চাহিদা,
সরবরাহে ঘাটতি
এবং ভোগ্যপণ্যের
দামের ঊর্ধ্বগতি
কিছু উন্নত
ও উন্নয়নশীল
দেশে মূল্যস্ফীতি
বাড়িয়েছে। আইএমএফ
তার ‘ওয়ার্ল্ড
ইকোনমিক আউটলুক’
প্রতিবেদনে পূর্বাভাস
দিয়েছে এ
প্রবণতা ২০২২
সালের মাঝামাঝি
পর্যন্ত অব্যাহত
থাকবে।
বাংলাদেশে এটাই
যদি জ্বালানি
তেলের মূল্যবৃদ্ধির
পেছনে যুক্তি
হয়, তাহলে
কেন আন্তর্জাতিক
বাজারে দাম
কমে গেলে
আমরা দেশে
জ্বালানি তেলের
দাম কমাতে
দেখিনি? সাত-আট
বছর ধরে
জ্বালানি তেলের
দাম কম
ছিল। ফলে
বাংলাদেশের মতো
আমদানিনির্ভর অর্থনীতিগুলো
ওই সময়ে
ব্যাপকভাবে লাভবান
হয়েছিল। বাংলাদেশ
পেট্রোলিয়াম করপোরেশন
(বিপিসি) অনেক
মুনাফা করেছিল।
তবে ওই
সময়ে বিদ্যুতের
দাম কয়েক
দফা বাড়ানো
হয়েছে। করোনার
সময় দাম
কম থাকায়
বিপিসির মুনাফা
বিপুল পরিমাণে
বেড়েছিল। বাংলাদেশ
অর্থনৈতিক সমীক্ষা
২০২১-এর
তথ্যানুযায়ী ২০২০-২১
অর্থবছরে বিপিসি
প্রায় ৫
হাজার ৮৩৯
কোটি টাকা
মুনাফা করেছিল;
২০১৯-২০
অর্থবছরে যা
ছিল প্রায়
৫ হাজার
৬৭ কোটি
টাকা।
জ্বালানি পণ্যে
এ ধরনের
নিম্নদাম থেকে
ভোক্তারা সুফল
পাননি। বাংলাদেশে
জ্বালানির দাম
চাহিদা ও
সরবরাহের নিরিখে
নির্ধারণ হয়
না। সরকার
জ্বালানির মূল্য
নির্ধারণ করে
দেয়। সেক্ষেত্রে
আন্তর্জাতিক বাজারে
নিম্ন দামের
সুফল ভোক্তাদেরও
পাওয়ার কথা।
সর্বোপরি, বিপিসি
যে লোকসান
করে তা
ভোক্তাদের দোষ
নয়। এটা
সংস্থাটির অব্যবস্থাপনা,
সিস্টেম লস
ও দুর্বল
সরবরাহ শৃঙ্খলের
কারণে। সংস্থাটির
দুর্বল সুশাসনের
কারণে জ্বালানি
বিপণন কোম্পনিগুলো
দুর্নীতিতে জড়িয়ে
পড়ে এবং
ভোক্তাস্বার্থ ক্ষুণ্ন
হয়। কাজেই
বিপিসিকে শুধু
জ্বালানির মূল্য
প্রক্রিয়া উন্নত
করলে চলবে
না, সরবরাহ
শৃঙ্খল ও
ক্রয় প্রক্রিয়াও
(প্রকিউরমেন্ট) শক্তিশালী
করতে হবে।
বর্তমানে অনেক
দেশই জ্বালানি
পণ্যসহ কমোডিটি
ট্রেডিংয়ের জন্য
ফিউচার মার্কেটে
অংশগ্রহণ করে।
বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক
বাজারের নিম্নদামের
সুযোগ নিতে
পারে না,
যেহেতু দেশের
বিদ্যমান আইন
বিপিসিকে ফিউচার
মার্কেটে অংশ
নেয়ার সুযোগ
দেয় না।
দাম যখন
কম ছিল
তখন আমাদের
দেশ জ্বালানি
তেল আগাম
কিনে রাখতে
পারত এবং
অর্থ সাশ্রয়
করতে পারত।
অবশ্য এর
সঙ্গেও কিছুটা
ঝুঁকি যুক্ত।
যেমন যদি
দাম দ্রুত
ও অত্যধিক
কমে তাহলে
লোকসান হবে।
প্রশ্ন আসতে
পারে, বাংলাদেশের
মতো দেশ
কি সেটি
পোষাতে পারবে?
এর উত্তর
হলো, যদি
কেউ ফিউচার
মার্কেটে অংশগ্রহণ
করে তাহলে
প্রত্যেককেই বাজারে
খেলার নিয়ম
পরিপালন করতে
হবে এবং
ইতিবাচক ও
নেতিবাচক উভয়
ফল মেনে
নিতে হবে।
প্রাথমিকভাবে ফিউচার
মার্কেটের মাধ্যমে
দেশ সার্বিক
জ্বালানি প্রয়োজনের
অন্তত কিছুটা
অংশ কেনা
শুরু করতে
পারে। অবশ্যই
হ্যাঁ, এসব
উদ্যোগের জন্য
বিপিসির দৃষ্টিভঙ্গির
পরিবর্তন ও
দক্ষতা বৃদ্ধি
প্রয়োজন।
দাম পুনরায়
সমন্বয়ের পক্ষে
নীতিনির্ধারকরা অন্য
যে সাধারণ
যুক্তি দিয়ে
থাকেন সেটি
হলো, আমাদের
প্রতিবেশী দেশগুলোয়
বিশেষত ভারতে
জ্বালানির দাম
কম। কাজেই
আমাদের দেশে
জ্বালানির দাম
কম হলে
এটা দেশ
থেকে ভারতে
পেট্রোলিয়াম পাচার
উৎসাহিত করবে।
যদি পাচার
হয়েও থাকে,
তা মোট
জ্বালানি মজুদের
কত পরিমাণ
হবে? তাছাড়া
এটি তো
নিরীহ ভোক্তাদের
কোনো দোষ
নয়। এটি
আরেকটি সুশাসন
সম্পর্কিত বিষয়।
ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধি
আমাদের অর্থনীতির
অনেক খাতকে
ক্ষতির মুখে
ফেলেছে। বাংলাদেশে
ব্যবহূত মোট
জ্বালানির প্রায়
৭০ শতাংশই
হলো ডিজেল।
সড়ক ও
নৌ-পরিবহন,
বিদ্যুৎ উৎপাদন
ও কৃষি
উৎপাদনের মতো
খাতগুলো ডিজেলের
ওপর নির্ভরশীল।
সরকারের ডিজেলের
মূল্যবৃদ্ধির সিদ্ধান্তে
পরিবহন খাতের
নেতারা বাস,
ট্রাক, কাভার্ড
ভ্যান ও
লঞ্চের ভাড়া
বাড়াতে সময়
নেননি। এরই
মধ্যে ভাড়া
বাড়ানো হয়েছে।
করোনাকালীন ক্ষতি
উল্লেখ করে
পরিবহন নেতারা
বলেছেন, তারা
বর্ধিত জ্বালানি
মূল্যের আঘাত
পোষাতে চান।
তবে অতিমারী
হোক বা
না হোক,
যাত্রীর ঘাড়ে
অতিরিক্ত ব্যয়
চাপানো তাদের
একটা পুরনো
অভ্যাস, পুরনো
কৌশল। শুধু
তা-ই
নয়, সেচ
ব্যয়ও বেড়ে
গেছে। ফলে
কৃষিপণ্য উৎপাদনের
খরচ বেড়ে
গেছে, যদিও
দুঃখজনকভাবে কৃষক
কৃষিপণ্যের উচ্চমূল্য
পান না।
উচ্চ পরিবহন
ব্যয়ের কারণে
ভোক্তাদেরও ভুগতে
হচ্ছে, যেহেতু
নিত্যপণ্যের দাম
ক্রমেই বেড়ে
চলছে। এদিকে
একটি ক্ষুদ্র
জনগোষ্ঠী আজকাল
কেরোসিন ব্যবহার
করলেও এর
উচ্চমূল্য দরিদ্র
ভোক্তাদের ওপর
ব্যাপক নেতিবাচক
প্রভাব ফেলছে।
এটি এমন
একটি সময়,
যখন দাম
বাড়ানোর পরিবর্তে
সরকারের উচিত
মানুষকে কিছুটা
স্বস্তি দেয়া,
যাতে মানুষ
ভালোভাবে ঘুরে
দাঁড়াতে পারে।
সরকার কিছুদিনের
জন্য জ্বালানি
পণ্যে শুল্ক
কমাতে পারে,
যাতে মানুষের
ওপর চাপ
কমে এবং
মহামারীসৃষ্ট অভিঘাত
থেকে ঘুরে
দাঁড়াতে পারে।
জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির
বোঝা শুধু
সাধারণ ভোক্তা
নয়, ব্যবসায়ী
বিশেষত ক্ষুদ্র
ব্যবসায়ীদের ওপরও
পড়েছে, যারা
অতিমারীতে সবচেয়ে
পর্যুদস্ত হয়েছেন।
সরকার জ্বালানির
দামের ওপর
মূল্য সংযোজন
কর, শুল্ক
ও বাণিজ্য
করসহ বিভিন্ন
ধরনের কর
আহরণ হরে।
এসব কর
এখন জ্বালানির
দামের প্রায়
৩০ শতাংশ।
এ দুঃসময়ে
এর একটা
অংশ কমানো
যেতে পারে।
এসব পদক্ষেপ
অশ্রুত, অজানা
কিছু নয়।
দাম কমাতে
ভারত পেট্রল
ও ডিজেলের
ওপর কর
কমিয়েছে এবং
জনগণকে কিছুটা
স্বস্তি দিয়েছে।
চলতি বছর
বিদ্যুৎ ও
গ্যাসের খুব
উচ্চমূল্য বিবেচনায়
নিয়ে ইউরোপীয়
ইউনিয়নের ২০টি
দেশ জ্বালানিতে
কর কমাতে
জরুরি পদক্ষেপ
নিয়েছে কিংবা
দরিদ্র পরিবারগুলোয়
ভর্তুকি দেয়ার
ব্যবস্থা করেছে।
প্রতিবার যখন
সরকার ঊর্ধ্বমুখী
দাম সমন্বয়ের
উদ্যোগ নেয়
তখন একটা
অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির
সৃষ্টি হয়।
এ ধরনের
পরিস্থিতি এড়াতে
স্বচ্ছ মূল্য
নির্ধারণ প্রক্রিয়া
থাকাটা অত্যাবশ্যক।
উচ্চপর্যায় থেকে
একতরফা সিদ্ধান্তের
পরিবর্তে পরিবহন
মালিক, কৃষি,
ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী,
ভোক্তা অধিকার
সংগঠনের প্রতিনিধিসহ
সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের
সঙ্গে পরামর্শক্রমে
সিদ্ধান্ত নেয়া
হলে তা
সাধারণ মানুষের
ভোগান্তি হ্রাসে
সাহায্য করতে
পারত।
দুর্ভাগ্যজনকভাবে যখনই
সরকার জ্বালানির
দাম বাড়ায়,
তখনই এর
তাত্ক্ষণিক প্রভাব
খুব তাড়াতাড়ি
অনুভূত হয়।
এবারো তার
ব্যতিক্রম হয়নি।
বিভিন্ন ধরনের
পণ্য ও
সেবার মূল্যে
এরই মধ্যে
ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা
দেখা যাচ্ছে।
এটা দেশের
অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার
বিলম্বিত করতে
পারে। দুঃখজনক
বিষয় হচ্ছে,
আন্তর্জাতিক বাজারে
অতিসম্প্রতি জ্বালানির
দাম কমলেও
বাংলাদেশে তার
প্রতিফলন দেখা
যাচ্ছে না।
বিশ্ববাজারে জ্বালানির
দাম বাড়ার
কারণে বাংলাদেশেও
সেটি বাড়াতে
হবে—এটিই
যদি যুক্তি
হয়, তাহলে
এখন কেন
বিপিসি দাম
কমাচ্ছে না?
ড. ফাহমিদা খাতুন:
অর্থনীতিবিদ
ও নির্বাহী
পরিচালক
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)