পরিচালন মুনাফা

শীর্ষস্থানে ইসলামী ব্যাংক,হাজার কোটি টাকার ক্লাবে অনেক ব্যাংক

হাছান আদনান

একদিকে করোনার মতো বৈশ্বিক মহামারী, অন্যদিকে ঋণের সুদহার শতাংশে নামিয়ে আনার বাধ্যবাধকতা। দুইয়ের আঘাতে ২০২০ সালে পরিচালন মুনাফায় ধস নেমেছিল দেশের ব্যাংক খাতে। তবে এক বছরের মাথায়ই ব্যাংকগুলোর আয় খাত ঘুরে দাঁড়িয়েছে। সদ্যসমাপ্ত ২০২১ সালে দেশের প্রায় সব ব্যাংকেরই পরিচালন মুনাফা বেড়েছে। কোনো কোনো ব্যাংকের মুনাফা বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। পরিচালন মুনাফার দিক থেকে গত বছর শীর্ষস্থানে ছিল ইসলামী ব্যাংক। একই সময় হাজার কোটি টাকার বেশি পরিচালন মুনাফার ক্লাবে যুক্ত হয়েছে অর্ধডজন ব্যাংক।

সুদ খাতের আয় নয়, বৈদেশিক বাণিজ্যের কমিশনসহ বিভিন্ন সেবার বিপরীতে প্রাপ্ত ফিই ব্যাংকগুলোর পরিচালন মুনাফার বড় উল্লম্ফনে ভূমিকা রেখেছে। পাশাপাশি কস্ট অব ফান্ড বা আমানতের সুদহার কমিয়ে আনার প্রভাবও দেখা গিয়েছে। যে ব্যাংক আমানতের সুদ যত বেশি কমাতে পেরেছে, সে ব্যাংকের পরিচালন মুনাফায় তত বেশি প্রবৃদ্ধি হয়েছে। ব্যাংকগুলোর পরিচালন মুনাফার বড় প্রবৃদ্ধিকে দেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানোর বার্তা হিসেবে দেখছেন সংশ্লিষ্টরা।

আগের ধারাবাহিকতা ধরে রেখে সদ্যসমাপ্ত বছরেও সবচেয়ে বেশি পরিচালন মুনাফা করেছে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড। ব্যাংকটি ২০২১ সালে হাজার ৪৩০ কোটি টাকা পরিচালন মুনাফা অর্জন করেছে। আগের বছর ব্যাংকটির পরিচালন মুনাফা ছিল হাজার ৩৫০ কোটি টাকা।

গত বছর হাজার কোটি টাকার বেশি পরিচালন মুনাফা অর্জনকারী ব্যাংকগুলোর তালিকায় রয়েছে পূবালী, দ্য সিটি, ইস্টার্ন, সাউথইস্ট, ব্যাংক এশিয়া ব্র্যাক ব্যাংকের নাম। তবে দেশের বড় ব্যাংকগুলোর মধ্যে ন্যাশনাল ব্যাংকের পরিচালন মুনাফায় বড় ধরনের বিপর্যয় ঘটেছে। ২০২১ সালে মাত্র ২৪৮ কোটি টাকা পরিচালন মুনাফা দেখাতে পেরেছে ব্যাংকটি। যদিও আগের বছর ৯২০ কোটি টাকা পরিচালন মুনাফা অর্জনের দাবি করেছিল ন্যাশনাল ব্যাংক। পরিচ্ছন্ন হিসাবের কারণে এবার ব্যাংকটির পরিচালন মুনাফা কমেছে বলে ব্যাংকটির দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বণিক বার্তাকে জানিয়েছেন।

আয় থেকে ব্যয় বাদ দিয়ে যে মুনাফা থাকে, সেটিই কোনো ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা। পরিচালন মুনাফা কোনো ব্যাংকের প্রকৃত মুনাফা নয়। মুনাফা থেকে খেলাপি ঋণ অন্যান্য সম্পদের বিপরীতে প্রভিশন (নিরাপত্তা সঞ্চিতি) সংরক্ষণ এবং সরকারকে কর পরিশোধ করতে হয়। প্রভিশন কর-পরবর্তী মুনাফাই হলো একটি ব্যাংকের প্রকৃত বা নিট মুনাফা।


আগের বছরের মতো ২০২১ সালেও ঋণ শ্রেণীকরণ বা খেলাপি ঋণের মেয়াদ গণনায় উদারতা দেখিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ঋণ পরিশোধের বাধ্যবাধকতা শর্ত শিথিলের কারণে অনেক ব্যাংকই প্রদেয় কিস্তির পুরো অর্থ আদায় না করেই অনাদায়ী সুদ আয়ের খাতে স্থানান্তরের সুযোগ পেয়েছে। বছরের শেষ দিন পর্যন্ত ব্যবসায়ীদের ঋণ পরিশোধে ছাড় দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংককে প্রজ্ঞাপন জারি করতে হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দেয়া বহুমুখী ছাড়ের প্রভাবেই দেশের ব্যাংক খাতে পরিচালন মুনাফায় বড় ধরনের উল্লম্ফন হয়েছে। তবে পরিচালন মুনাফায় বড় ধরনের প্রবৃদ্ধির পরও অনেক ব্যাংকই কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় নিট মুনাফা অর্জন করতে ব্যর্থ হবে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশে আমদানি প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৫১ শতাংশেরও বেশি। একই সময়ে রফতানি প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২৪ দশমিক ২৯ শতাংশ। বৈদেশিক বাণিজ্যের বড় প্রবৃদ্ধি দেশের ব্যাংকগুলোর ঋণপত্র কমিশন খাতের আয় বাড়াতে বড় ধরনের ভূমিকা রেখেছে।

অন্যদিকে করোনার প্রভাবে ২০২০ সালের শুরু থেকেই দেশের ব্যাংক খাতে অতিরিক্ত তারল্যের জট তৈরি হয়। ২০২১ সালের মাঝামাঝি সময়ে এসে দেশের ব্যাংক খাতে সৃষ্টি হয় অলস তারল্যের পাহাড়। তারল্যের সহজলভ্যতার সুযোগে দেশের বেশির ভাগ বেসরকারি ব্যাংক আমানতের সুদহার ইতিহাসের সর্বনিম্নে নামিয়ে আনে। কোনো কোনো ব্যাংকের মেয়াদি আমানতের সুদহার নেমে আসে - শতাংশে। পরিস্থিতিতে আমানতকারীদের স্বার্থরক্ষায় মূল্যস্ফীতির সঙ্গে আমানতের সুদহার বেঁধে দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করতে বাধ্য হয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

২০২১ সালে প্রথমবারের মতো হাজার কোটি টাকা পরিচালন মুনাফা অর্জনের ক্লাবে প্রবেশ করেছে দ্য সিটি ব্যাংক লিমিটেড। গত বছর হাজার ১০১ কোটি টাকা পরিচালন মুনাফা পেয়েছে ব্যাংকটি। আগের বছর সিটি ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা ছিল ৭১৪ কোটি টাকা।

বেসরকারি খাতের ব্যাংকটির শীর্ষ নির্বাহী মাসরুর আরেফিন বণিক বার্তাকে বলেন, ২০২১ সালে ব্যাংকগুলোর সুদ খাতের আয় বেড়েছে এমনটি বলার সুযোগ নেই। বহুমুখী সেবা ব্যবসা পরিচালনা করে, এমন ব্যাংকগুলোই সদ্যসমাপ্ত গত বছরে ভালো করতে পেরেছে। বিদায়ী বছরে সিটি ব্যাংক সাড়ে বিলিয়ন ডলারের বৈদেশিক বাণিজ্যের অংশীদার ছিল। ঋণপত্রের কমিশন হিসেবে আমরা ভালো আয় করতে পেরেছি।

তিনি বলেন, পরিচালন মুনাফা কোনো ব্যাংকের মুনাফার প্রকৃত চিত্র নয়। খেলাপি ঋণের হিসাব চূড়ান্ত করার পর ব্যাংকগুলোকে মুনাফার বড় একটি অংশ সঞ্চিতি হিসেবে সংরক্ষণ করতে হবে। ২০২১ সালে যেসব ব্যাংক আমানতের সুদ কমিয়ে কস্ট অব ফান্ড কমাতে পেরেছে, সেগুলোও ভালো পরিচালন মুনাফা পেয়েছে।

প্রাপ্ত তথ্য অনুুযায়ী, ২০২১ সালে দেশের বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পরিচালন মুনাফা পেয়েছে পূবালী ব্যাংক লিমিটেড। ব্যাংকটি বিদায়ী বছরে পরিচালন মুনাফা পেয়েছে হাজার ১৪৫ কোটি টাকা। ২০২০ সালে ৯৩১ কোটি টাকা পরিচালন মুনাফা অর্জন করতে পেরেছিল ব্যাংকটি।

২০২১ সালে ইস্টার্ন ব্যাংক পরিচালন মুনাফা পেয়েছে হাজার ৫০ কোটি টাকার। ২০২০ সালে ৮৭০ কোটি টাকা পরিচালন মুনাফায় ছিল ব্যাংকটি। হাজার কোটি টাকা পরিচালন মুনাফা পাওয়া অন্য ব্যাংকগুলোর মধ্যে সাউথইস্ট হাজার ১৬ কোটি ব্যাংক এশিয়া হাজার কোটি টাকা পরিচালন মুনাফা পেয়েছে। এর আগে ২০২০ সালে ব্যাংক দুটির পরিচালন মুনাফা ছিল যথাক্রমে ৮১৬ ৭১০ কোটি টাকা।

বিদায়ী বছরে ৮৮১ কোটি টাকা পরিচালন মুনাফা পেয়েছে দ্য প্রিমিয়ার ব্যাংক লিমিটেড। ২০২০ সালে ব্যাংকটির পরিচালন মুনাফা ছিল ৬৮০ কোটি টাকা। ২০২১ সালে ৭২২ কোটি টাকা পরিচালন মুনাফা পেয়েছে মার্কেন্টাইল ব্যাংক। এর আগের বছরে ব্যাংকটির পরিচালন মুনাফা ছিল ৪১১ কোটি টাকা। শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক ২০২১ সালে ৭১৭ কোটি টাকার পরিচালন মুনাফা পেয়েছে। যদিও আগের বছরে ব্যাংকটির পরিচালন মুনাফা ৪৮১ কোটি টাকায় নেমে এসেছিল।

শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. শহিদুল ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, উজ্জ্বল ভাবমূর্তি, মূলধন কাঠামো, কস্ট অব ফান্ডসহ বিভিন্ন সূচকে শাহজালাল ব্যাংকের অবস্থান সামনের সারিতে। গত কয়েক বছরে আমরা মুনাফার চেয়েও আর্থিক ভিত শক্তিশালী করার প্রতি বেশি নজর দিয়েছিলাম। ফলে করোনার মধ্যেও শাহজালাল ব্যাংকের অবস্থান দৃঢ় হয়েছে। আগামী বছরগুলোয় আমাদের ব্যাংক আরো ভালো করবে। 

এছাড়া ২০২১ সালে এক্সিম ব্যাংক ৭৮০ কোটি টাকা, আইএফআইসি ব্যাংক ৭৭৫ কোটি, আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংক ৭৫০ কোটি, যমুনা ব্যাংক ৭৫০ কোটি, ঢাকা ব্যাংক ৭২১ কোটি, এনসিসি ব্যাংক ৭১৭ কোটি, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক ৬৯০ কোটি সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক ৫০৪ কোটি টাকা পরিচালন মুনাফা করেছে। ২০১৩ সালে কার্যক্রম শুরু করা চতুর্থ প্রজন্মের ব্যাংকগুলোও বিদায়ী বছরে ভালো মুনাফা পেয়েছে। এর মধ্যে ইউনিয়ন ব্যাংক ৩৭৫ কোটি, সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স ব্যাংক ২১০ কোটি, এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক ৪৫০ কোটি, মেঘনা ব্যাংক ১০৫ কোটি, মিডল্যান্ড ব্যাংক ১৬২ কোটি, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক ২৬৮ কোটি মধুমতি ব্যাংক ২১৬ কোটি টাকা পরিচালন মুনাফা পেয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো নিশ্চিত করেছে।

রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মধ্যে সোনালী ব্যাংক গত বছর পরিচালন মুনাফা পেয়েছে হাজার ১০৭ কোটি টাকা। ২০২০ সালে ব্যাংকটি হাজার ১৫৪ কোটি টাকা পরিচালন মুনাফা অর্জন করেছিল। রূপালী ব্যাংক ২০২১ সালে পরিচালন মুনাফা করেছে ১৫০ কোটি টাকা। আগের বছর পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ব্যাংকটি ১৫৯ কোটি টাকা পরিচালন মুনাফা অর্জন করেছিল।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন